প্রজাপতি ও মথদের মেকী চোখ

এ. এইচ. এম. শাফায়েত উল্লাহ প্রধান
নেচার স্টাডি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ (এনএসএসবি)

প্রাণীদের নকল বা মেকী চোখকে ইংরেজীতে fake eye, false eye, eyespot, false eyespot, বা ocellus বলে। এই চোখগুলো প্রাণীদের শরীরের যে কোন অংশে থাকতে পারে যা অন্য কোন প্রাণীর চোখের অনুরূপ হয়। মেকী চোখগুলো সাধারণত গোলাকার হয় এবং পার্থক্যযুক্ত বিভিন্ন রঙ এর সমকেন্দ্রিক বৃত্ত দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। প্রজাপতি, সরীসৃপ, বিড়াল গোত্রীয় প্রাণী, পাখি এবং মাছেদের মধ্যে প্রধানত এই বৈশিষ্ট দেখা যায়। এইসব প্রাণীরা নকল চোখগুলো তাদের শিকারী বা শিকারকে ধোঁকা দিতে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ করতেও নকল চোখগুলো ব্যবহৃত হয়। কিছু প্রাণী যেমন ময়ূর বিপরীত লিঙ্গের সদস্যকে আকর্ষণ করতেও এই চোখগুলো ব্যবহার করে। প্রাণীদের নকল চোখগুলো কখনো অভিযোজনের ফসল আবার কখনো দৈবক্রমে সৃষ্টি হওয়া নকশা হতে পারে। ভ্রূণবিকাশের সময় সক্রিয় থাকা কিছু জিনের মাধ্যমে নকল চোখগুলোর কাঠামো নিয়ন্ত্রিত হয় [1, 2]। প্রাণীজগতের মধ্যে প্রজাপতি ও মথদের মাঝে সব চেয়ে বেশি মেকী চোখ দেখা যায়।

সাধারণত প্রাণীদের শরীরের বিন্যাসগুলো তাদের শিকারীদের কাছ থেকে লুকাতে বিবর্তিত হয়, কিন্তু নকল চোখগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিগোচরতা বাড়িয়ে দেয়। তবে চোখগুলোর স্পষ্টতা তাদের কার্যকারীতা প্রমাণ করে, কারণ এই বৈশিষ্টটি যদি পতঙ্গটির ক্ষতির কারণ হত তবে তা এত ব্যাপকভাবে বিবর্তিত হত না [2]। প্রজাপতি বা মথেরা সাধারণত শিকারীদের হাত থেকে নিজেদের শরীরকে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে (যেমনঃ মাথা) রক্ষা করার জন্য অথবা শিকারীদের অনুকরণ করার জন্য নকল চোখ ব্যবহার করে [1]। প্রজাপতিদের মেকী চোখগুলো সঙ্গী শনাক্তকরণ ও যৌন নির্বাচনেও ব্যবহৃত হয় [1]।

মেকী চোখগুলো শিকারীদের এমন অঙ্গেসমূহের দিকে আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করে যেগুলো প্রজাপতি বা মথদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক নয়, যেমন পাখার শেষ প্রান্ত [2]। এজন্য দেখা যায় নকল চোখগুলো সাধারণত প্রজাপতি বা মথদের পাখার প্রান্তভাগের দিকে থাকে। শিকারী যদি সরাসরি পতঙ্গটির মাথায় আক্রমণ করে সেক্ষেত্রে তার মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু আক্রমণটি যদি পতঙ্গটির পাখার শেষ প্রান্তের দিকে হয় তবে পতঙ্গটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায় কারণ পতঙ্গটি একটি বিচ্ছিন্ন পাখা নিয়েও বেঁচে থাকতে পারে [2]। যেমনঃ Bicyclus anynana প্রজাতির প্রজাপতিরা যখন বর্ষাকালে খাওয়া ও বংশবৃদ্ধির জন্য বেশি উড়ে তখন তাদের পাখার শেষপ্রান্তে মেকী চোখগুলো বেশি স্পষ্ট হয়, কারণ এ সময় শিকারীদের দ্বারা আক্রমণের শঙ্কা বেশি থাকে। আবার শুষ্ক ঋতুতে তাদের মেকী চোখগুলো অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে যায় যাতে করে তারা পাখিদের কাছে থেকে লুকাতে পারে। হেয়ারস্ট্রিক বা Lycaenidae গোত্রের প্রজাপতিদের (যেমনঃ Calycopis cecrops) মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাখার শেষপ্রান্তে ছোট ছোট নকল চোখের সারি এবং ছোট লেজ দেখা যায় যা দেখে পাখি ও মাকড়সার মত শিকারীরা শুঙ্গসহ মাথা ভেবে বিভ্রান্ত হয়। এরা যখন ফুল বা ডালের ওপর বসে তখন এদের মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে এবং পাখার নিচের দিকে থাকা শুঙ্গের মত লেজ বারবার নাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এ কৌশলটি প্রজাপতির মাথায় আক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর [1-3]। নকল চোখ বড় হোক (যেমনঃ Caligo teucer-এ) বা ছোট (যেমনঃ Pyronia tithonus-এ), উভয়ই একটি পাখির আক্রমণকে প্রজাপতির শরীরের ওপর থেকে অন্যদিকে সড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট [4]।

Bicyclus anynana: বর্ষাকালে (বামে) বনাম শুষ্ক ঋতুতে (ডানে)
Pyronia tithonus
Calycopis cecrops: পাখার শেষপ্রান্তে নকল চোখের সারি ও লেজের সাহায্যে নকল মাথা গঠন
বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতিদের ডানায় নকল চোখ

মেকী চোখের মাধ্যমে শিকারীদের অনুকরণ অনেক প্রজাতির প্রজাপতিদের মধ্যে দেখা যায়। এ চোখগুলো শিকারীদের আক্রমণ প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে কারণ আক্রমণকারী শিকারীরা ভাবে তারা হয়ত আরও বড় ও সম্ভাব্য বিপজ্জনক কোন প্রাণীকে দেখতে পাচ্ছে [2]। যেমনঃ অ্যাটলাস মথ প্রজাতিদের (যেমনঃ Attacus atlas) পাখাদ্বয়ের উপরের প্রান্ত দেখতে অনেকটা গোখরা সাপের মত মনে হয় [3, 4]। আউল মথ প্রজাতিরা (যেমনঃ Caligo memnon) তাদের নকল চোখের সাহায্যে একই সাথে পেঁচা ও সাপের প্রতিমূর্তি ধারণ করে [5]। এক গবেষণায় দেখা গেছে পেঁচার চোখের ন্যায় অনুকৃতি এইসব মথদের অন্য পাখি যেমন বড় তিত-এর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে [3]। কিছু পতঙ্গবিজ্ঞানী দাবি করেন Eyed Hawk (Smerinthus ocellatus) মথদের নকল চোখের কারণে তাদের সামনে থেকে দেখতে অনেকটা শিয়াল বা কুকুরের মুখের মত মনে হয় যা শিকারীদের বিভ্রান্ত করে [3]।

Attacus atlas: গোখরা সাপের ন্যায় পাখার পার্শ্ব
Caligo memnon: পেঁচা ও সাপ উভয়ের অনুকরণ
Smerinthus ocellatus: খেকশিয়ালের অনুকরণ
Antheraea polyphemus

কিছু প্রজাতি যেমন Hipparchia semele বিশ্রামরত অবস্থায় তাদের নকল চোখগুলোকে পশ্চাৎপক্ষের পেছনে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু যখন তারা মনে করে তাদের শিকারী আশেপাশে এসেছে তখন হঠাৎ করে চোখগুলোকে মেলে ধরে যাতে শিকারী ভয় পেয়ে ওঠে [1, 2]। একইভাবে বুলসাই মথেরা যেমন Automeris liberia তাদের মেকী চোখগুলো সাধারণত তাদের মৃত পাতা সদৃশ সামনের ডানার নিচে লুকিয়ে রাখে। যদি তারা বিরক্ত হয় তবে সাথে সাথে তারা ভূমিতে পড়ে যায় এবং তাদের নকল চোখওয়ালা পশ্চাৎপক্ষদ্বয় ছন্দময়ভাবে দোলাতে থাকে যাতে করে তাদের নকল চোখের দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। মথটির এই রূপ সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং একটি পাখিকে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত করতে যথেষ্ট [4]। কিছু প্রজাতির নকল চোখের মাঝখানে একটু উজ্জ্বল সাদা অংশ দেখা যায় (যেমনঃ Automeris io, Automeris niepelti, Aglia tau) যা চোখে আলোর প্রতিফলনকে অনুকুরণ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব প্রজাতির মেকী চোখের মাঝে উজ্জ্বল কেন্দ্র আছে তারা উজ্জ্বল কেন্দ্রবিহীন প্রজাতিদের তুলনায় শিকারীদের দ্বারা কম আক্রান্ত হয়। শিকারীরা সাধারণত অস্বাভাবিক চেহারার শিকারদের আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে [2]। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে Inachis io প্রজাতির প্রজাপতিদের তাদের নকল চোখ ৯৭% ক্ষেত্রে নীল তিত পাখিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে [4]।

Hipparchia semele
Automeris niepelti
Automeris liberia
Aglia tau: উজ্জ্বল কেন্দ্র বিশিষ্ট নকল চোখ
Automeris io
Inachis io

তবে নকল চোখগুলো প্রকৃতপক্ষে আসল চোখের অনুকরণ করে কিনা কিংবা মানুষ যেভাবে এই নকল চোখগুলোকে দেখে প্রাণীরাও একইভাবে দেখে কিনা তা এখনও অস্পট। এক গবেষণায় বিভিন্ন আকার, আকৃতি ও রঙের পার্থক্যযুক্ত নকল চোখওয়ালা নকল প্রজাপতিদের উডল্যান্ড পাখিদের সামনে পরিবেশন করা হয়। দেখা যায়, পাখিগুলো আসল চোখের ন্যায় দেখতে কালো কেন্দ্র ও সাদা পারিপার্শ্ব বিশিষ্ট চোখগুলোকে যেভাবে পরিহার করে, ঠিক একইভাবে উল্টো বিন্যাসযুক্ত চোখগুলোকে পরিহার করে। এরপর চোখগুলোর আকার বৃত্তাকার থেকে আয়তাকার করে দেয়া হয় এবং দেখা যায় পাখিগুলো ঠিক আগের মতই চোখগুলোকে পরিহার করছে। তবে দেখা গেছে রঙের পার্থক্য বেশি হলে পাখিদের পরিহার করার প্রবণতাও বেড়ে যায়। এর থেকে ধারণা করা যায়, পাখিরা বড় ও রঙের বেশি পার্থক্য যুক্ত স্পষ্ট নকশাযুক্ত নকল চোখগুলো এড়িয়ে যায় যেখানে নকল চোখগুলোর আকৃতি কোন প্রভাব ফেলে না [6]। বিপরীতভাবে অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে স্পষ্টতার চেয়ে শিকারী পাখির চোখের অনুকরণই প্রজাপতিদের নকল চোখের বিবর্তনের কারণ [7]।

নকল চোখগুলো যে শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক মথ ও প্রজাপতিদের মধ্যে দেখা যায় তা নয়, লার্ভা (শুঁয়োপোকা) ও পিউপা দশায়ও এদের দেখা যায়। প্রজাপতি বা মথেরা লার্ভা ও পিউপা দশায় একদমই অরক্ষিত থাকে, তাই তাদের আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে নকল চোখগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক প্রজাতির শুঁয়োপোকার মধ্যেই নকল চোখ দেখা যায়। Hemeroplanes triptolemus প্রজাতির লার্ভারা তাদের সামনের ভাগকে স্ফীত করে তাদের নকল চোখের সাহায্যে এমন বেশ ধারণ করে যে শিকারীরা এমনকি মানুষও তাদের সাপ ভেবে ভুল করতে পারে [2]। Eumorpha phorbas এবং Eumorpha labruscae প্রজাতির লার্ভাদের পেছনের প্রান্তের শিং পড়ে গিয়ে একটি নকল চোখ তৈরি হয় যা পলক ফেলার মত স্পন্দিতও হয় এবং শরীরের সামনের প্রান্তের নকল চোখগুলোর মাধ্যমে তারা সাপের প্রতিরূপ ধারণ করে [2, 8]। পাশাপাশি শুঁয়োপোকাদের ওসমেটেরিয়াম নামক সাপের জিহ্বা এর মত একটি অঙ্গ থাকে যার কারণে তাদের আরও বেশি সাপ-সদৃশ মনে হয় [9]। এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শুঁয়োপোকার নকল চোখ তাদের সাপের মত রূপ দেয় তাদেরকে পাখিরা অনাগ্রহী থাকে [6]। মেকী চোখের কারণে Dynastor darius প্রজাতির পিউপাদের দেখতে শুধু যে পিট ভাইপার সাপের মাথার মত মনে হয় তা নয়, আশেপাশে শিকারীর উপস্থিতি অনুভব করলে এরা এদের মুক্ত প্রান্তকে এমনভাবে সামনে পেছনে নাড়ায় যে তাতে শিকারী ভীতিপ্রাপ্ত হয় [10]।

Hemeroplanes triptolemus প্রজাতির শুঁয়োপোকার সাপের অনুকরণ
Papilio troilus প্রজাতির শুঁয়োপোকা
Eumorpha labruscae প্রজাতির শুঁয়োপোকা
Dynastor darius প্রজাতির শুঁয়োপোকার পিট ভাইপারের অনুকরণ

প্রজাপতি বা মথদের মাঝে নকল চোখের বিস্তৃতি দেখলে বুঝা যায় যে প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য কত বিচিত্রভাবে এরা বিবর্তিত হয়েছে। নকল চোখগুলোর এত ব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও এদের বিবর্তনের ধারা ও কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা এখনও অপ্রতুল। বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি ও মথের নকল চোখের ওপর বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে এদের গুরুত্ব ও কর্মপ্রণালি নির্ধারণ করতে পারলে জীবজগতে প্রাণীদের টিকে থাকার অনেক রহস্য হয়তো উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্রঃ

1.            Wikipedia, Eyespot (mimicry), in Wikipedia. 2020, Wikimedia Foundation, Inc.

2.            Osterloff, E. Why do some butterflies and moths have eyespots?  03/10/2020]; Available from: https://www.nhm.ac.uk/discover/why-do-butterflies-have-eyespots.html.

3.            Gray, R. Eye knew it! Markings on butterflies really do mimic a predator’s gaze. 2015  05/10/2020]; Available from: https://www.dailymail.co.uk/sciencetech/article-3030780/Eye-knew-Markings-butterfly-wings-really-mimic-predator-s-gaze.html.

4.            Hoskins, A. Strategies for Survival.  05/10/2020]; Available from: https://www.learnaboutbutterflies.com/Survival%20Strategies%203.htm.

5.            Gracejeanyu. Mimicry – The Owl Butterfly. 2015  05/10/2020]; Available from: https://bioventures.wordpress.com/2015/02/12/mimicry-the-owl-butterfly/.

6.            Ogden, L.E. Siz ways animals use fake eyes. 2014  03/10/2020]; Available from: http://www.bbc.com/earth/story/20141112-six-ways-animals-use-fake-eyes.

7.            Bona, S.D., et al., Predator mimicry, not conspicuousness, explains the efficacy of butterfly eyespots. Proceedings of the Royal Society B: Biological Sciences, 2015. 282(1806): p. 20150202.

8.            Zielinski, S. Caterpillars Can “Blink” A Fake Eye. 2013  03/10/2020]; Available from: http://wildthings.sarahzielinski.com/blog/caterpillars-can-blink-a-fake-eye/.

9.            Wikipedia, Papilio troilus, in Wikipedia. 2020, Wikimedia Foundation, Inc.

10.         Andrei, M. Mimicry at its finest — or why this is not a snake. 2017  05/10/2020]; Available from: https://www.zmescience.com/other/great-pics/mimicry-larvae-snakes/.