বিলুপ্তির পথে চশমাপরা ঽনুমান , চলছে গবেষণা
যুক্তরাজ্যের THE RUFFORD FOUNDATION এর আর্থিক অনুদানে বাংলাদেশের মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান নিয়ে “Status and Conservation Initiative of Phayre’s Langur in Northeast Bangladesh” শিরোনামে একটি গবেষনা প্রকল্প চলছে সাতছরি জাতীয় উদ্যান, লাউয়াছরা জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, আদমপুর ও জুরি বনে ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি দল “Status and Conservation Initiative of Phayre’s Langur in Northeast Bangladesh” শিরোনামে একটি গবেষনা প্রকল্প শুরু করেছে ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে। চশমাপরা হনুমানের বর্তমান অবস্থা ও কমে যাওয়ার কারনগুলো জানতে সিলেট বিভাগের সাতছরি জাতীয় উদ্যান, লাউয়াছরা জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, আদমপুর ও জুরি বনে চলছে এই গবেষণা। যুক্তরাজ্যের THE RUFFORD FOUNDATION এর আর্থিক অনুদানে বাংলাদেশের মহাবিপন্ন এই হনুমান নিয়ে অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রকল্পের অনুমতি ও সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করছে বাংলাদেশ বন বিভাগ।
প্রকল্পটির প্রধান গবেষক তানভীর আহমেদ বলেন , বর্তমানে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা খুব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৫ সালে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইউসিএন থেকে প্রকাশিত লাল তালিকা অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী এই হনুমান “বিপন্ন” এবং বাংলাদেশে “মহাবিপন্ন” অবস্থায় আছে। ধারণা করা হয় যে, আবাস্থল ধংস ও শিকারের কারনে গত তিন প্রজন্মে বা ৩৬ বছরে সারা পৃথিবীতে এই হনুমানের সংখ্যা আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮২ সালে গিটিন্স ও আকন্দের ধারণা মতে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমান ছিল ১৩০০ এর কাছাকাছি। বর্তমানে কি পরিমান টিকে আছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। উল্লেখ্য এই প্রাণী নিয়ে গবেষণাও আমাদের দেশে অপ্রতুল। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদআর্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলোজিকাল এন্থ্রপোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ক্রেইগ স্ট্যানফোর্ড বাংলাদেশের মুখপোড়া হনুমান নিয়ে পিএসডি করার সময় মুখপোড়া হনুমানের পাশাপাশি সর্ব প্রথম চশমাপরা হনুমানের “ইকোলজি” নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ “প্রাইমেট কনজারভেসন” জার্নালে লিখেছিলেন। তারপর মাত্র ২ টি গবেষণায় এই হনুমানের ব্যবহারিক ও খাবার বিষয়ক বেশ কিছু তথ্য প্রকাশিত হলেও, বাংলাদেশের কোন বনে কি পরিমান টিকে আছে এবং কি কারনে এই প্রাণীর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে সে তথ্য গুলো জানতে তেমন কোন গবেষণা হয় নি।
দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে লম্বা লেজওয়ালা কালো বানরের চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পরানো হয়েছে। কাছাকাছি গেলে স্পষ্ট হবে, চোখের চারপাশে সাদা রঙের লোমে আবৃত হয়ে চশমার আকার নিয়েছে। এ জন্যই প্রাণীটির নাম চশমা পরা হনুমান। Primates বর্গের Cercopithecidae পরিবারভুক্ত এ হনুমান ইংরেজিতে Phayre’s Leaf Monkey বা Phayre’s Langur নামে পরিচিত। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Trachypithecus phayrei.
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী বনগুলো, বিশেষ করে লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি, আদমপুর, জুরি, কাপ্তাই এবং সাঙ্গু সহ বেশ কয়েকটি মিশ্র-চিরহরিৎ বনে মুলত এই হনুমানের বসবাস। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাউস ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায় এই হনুমান। বাংলাদেশে যে তিন প্রজাতির হনুমান আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট আকারের হনুমান হচ্ছে এই চশমাপরা হনুমান। শরীরের তুলনায় লেজ লম্বা। শরীরের দৈর্ঘ্য ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার এবং লেজের দৈর্ঘ্য ৬৫ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা আকৃতিতে পুরুষের থেকে সামান্য বড়, যা সাধারনত এই গোত্রীয় অন্য হনুমানদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হনুমানের ওজন গড়ে ৭.৩ কেজি এবং মহিলার ওজন গড়ে ৬.২ কেজি হয়ে থাকে। প্রতি ২ বছরে কেবল একটি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে এই প্রাণী। বাচ্চা অবস্থায় শরীরের রং থাকে সোনালি বাদামির মিশ্রণে এবং মুখমণ্ডল গোলাপি। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হনুমানের শরীর কালচে বাদামি এবং বুকের দিকটা সাদাটে। প্রাপ্তবয়স্ক হতে পুরুষ হনুমানের ৫ থেকে ৬ বছর এবং মহিলা হনুমানের ৩ থেকে ৪ বছর সময় লাগে।
সাধারণত একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হনুমানের অধীনে ৩ থেকে ২২ জনের একটি দলে মহিলা-পুরুষ একসাথে বসবাস করে এরা। একের অধিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষও দেখা যায় কিছু দলে। দলপতি পুরুষ বিপদে-আপদে বা অন্য দলের সঙ্গে ঝগড়ার সময় নিজ দলের সদস্যদের রক্ষা করে এবং নিজ দলের বেশীরভাগ মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। পুরুষ দলনেতা অনেক সময় মা হনুমানকে দ্রুত ঋতুমতী করার জন্য বাচ্চাদের মেরে ফেলে। তবে এই অপকর্মটি হয় সাধারণত দলে কোনো নতুন হনুমান দলপতির উত্থান ঘটার সূত্রপাত হলে।
ঘন চিরজবুজ বনের এই বাসিন্দা মুলত নিরামিষভোজী। খাদ্যের ৪৭ শতাংশই বিভিন্ন গাছের পাতা এবং ১৪ শতাংশ ফল ও বীজ। এছাড়া বিভিন্ন গাছের ফুল, পত্রবৃন্ত, কুঁড়ি ও কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে। খাদ্য গ্রহনের সময় ও মলের মাধ্যমে গাছের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরতে সাহায্য করে এই প্রাণী যা মুলত বনকে নতুন জীবন দান করে। এছাড়া পাতা ও কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে একই সাথে পরাগায়নেও ভুমিকা রাখে।
বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে সাতছরিতে বাচ্চাসহ মা হনুমান এবং একইভাবে লাউয়াছরায়ও ১টি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটে কিছুদিন আগে। বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে আদিবাসীগুষ্টি খাদ্য হিসাবে অন্য প্রাণীর পাশাপাশি চশমাপরা হনুমানও শিকারের ঘটনাও জানা গেছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে এই প্রাণীর আবাসস্থল। সুতরাং, জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে মহাবিপন্ন এ প্রানীকে রক্ষা করা বাংলাদেশে অন্তত সম্ভব হবে না।