উদ্ভিদের যৌনতা।

উদ্ভিদের যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে।

যৌন প্রজনন হল অধিকাংশ প্রানী এবং উদ্ভিদের প্রজনন পদ্ধতি। কিছু প্রোটিস্টা এবং ছত্রাকও এই পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে। যৌন প্রজননকারী জীবগুলি দুটি আলাদা যৌনতা বা লিঙ্গবিশিষ্ট হয় যেমন পুরুষ ও নারী। নারীর ডিম্ব বা ডিম্বাণু পুরুষের শুক্রকীট বা শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে নবজাতক সন্তানের জন্ম হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পর্যায় জড়িত রয়েছে।উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ফুলেরা হল সপুষ্পক উদ্ভিদসমূহের যৌনাঙ্গ, যাতে সাধারনত পুরুষ ও স্ত্রী উভয় অংশ বিদ্যমান থাকে।

উদ্ভিদ প্রজনন হল উদ্ভিদের নতুন সন্তান জন্মলাভ প্রক্রিয়া, যা যৌন এবং অযৌন উভয় প্রক্রিয়াতেই ঘটতে পারে। যৌন প্রজননে গ্যামেটের মিলনের মাধ্যমে জিনগত ভাবে মাতা-পিতা থেকে পৃথক সন্তান উৎপন্ন হয়। প্রানীদের মতই, উদ্ভিদেরও উন্নত ও বিশেষায়িত পুরুষ ও নারী গ্যামেট রয়েছে। সবীজী(যাদের বীজ আছে) উদ্ভিদে, পুরুষ গ্যামেট কঠিন চামড়ায় আবৃত হয়ে পরাগরেণু গঠন করে। উদ্ভিদের নারী গ্যামেট তার গর্ভাশয়ে অবস্থান করে, যা পরাগরেণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে বীজ গঠন করে, যাতে নিষিক্ত ডিমের মত ভ্রূণীয় উদ্ভিদের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য যথেষ্ট পরিমান পুষ্টি সঞ্চিত থাকে। সপুষ্পক উদ্ভিদে, নিষিক্ত গ্যামেট বীজের ভেতর রক্ষিত থাকে, যা উদ্ভিদের বংশধরকে দুর দূরান্তে ছড়িয়ে দিতে বাহক প্রতিনিধির কাজ করে।

যেহেতু ফুলেরা সপুষ্পক উদ্ভিদসমূহের যৌনাঙ্গ, এবং এতে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় অংশ বিদ্যমান থাকে যেমন কেন্দ্রীয় অংশে থাকে গর্ভাশয় যাতে ডিম্বক উপস্থিত থাকে, এর উপরের অংশের নাম গর্ভমুণ্ড এবং এর চারপাশে থাকে পরাগধানী, যাতে পরাগরেণু উৎপন্ন হয়। পরাগরেণু পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় গর্ভমুণ্ডে পৌঁছালে পরাগরেণু হতে পরাগনালি গর্ভমুণ্ডের ভেতর দিয়ে গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে পুংজনন কোষে পৌঁছে দেয়, যা ডিম্বককে নিষিক্ত করে বীজ ও বীজ ধারনকারী ফল উৎপন্ন করে। এবং বিভিন্ন প্রানীদের জীবন ধারনের জন্য সেই সুস্বাদু ফল ভক্ষন করা হয়।সাইকাস ও পাইনাস গাছের মত পিনোফাইটা পর্বের উদ্ভিদের যৌনাঙ্গ কোনিফার কোন নামে পরিচিত।পুরুষ ও স্ত্রী কোন আলাদা এবং তা একই গাছে জন্ম নেয়, স্ত্রী কোনে বীজ এবং পুরুষ কোনে পরাগরেণু উৎপন্ন হয়, যা পরাগায়নের মাধ্যমে স্ত্রী কোনে পৌঁছে বীজকে নিষিক্ত করে।

অযৌন প্রজননে (যেমন অঙ্গজ প্রজনন) গ্যামেটের মিলন ছাড়াই সন্তান উৎপন্ন হয় যা জিনগতভাবে মাতৃউদ্ভিদের অনুরূপ,যদি মিউটেশন প্রক্রিয়া না ঘটে। এজন্যই আজকাল মাতৃ উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য পরবর্তি বংশধরে টিকিয়ে রাখার জন্য বা অনুরূপ ফল পেতে যৌন প্রজননের পরিবর্তে অঙ্গজ প্রজননের
(Vegetative Reproduction) দিকে বিজ্ঞানিরা বেশী মনোনিবেশ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা অঙ্গজ জনন করার এক বছরের মধ্যেই দ্রুত উদ্ভিদের ফলন পাচ্ছি ও বিভিন্ন সুস্বাদু ফলের স্বাদ গ্রহন করতে পারছি।

নিন্ম শ্রেনীর কিছু উদ্ভিদ আছে যারা মৃতজীবী তারাও যৌন প্রজননের মাধ্যমে বা যৌন প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে, যাদের জীবনচক্রে হ্যাপ্লয়েড ও ডিপ্লয়েড উভয় পর্যায় রয়েছে। এই অবস্থাটি ছত্রাকের ক্ষেত্রে প্রজোয্য। ছত্রাক সাধারনত আইসোগ্যামাস (একই রকম গ্যামেট বিশিষ্ট), যাদের পুরুষ ও নারী বিশেষত্ব নেই। হ্যাপ্লয়েড ছত্রাকেরা একে অপরের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে পরস্পরের কোষের মিলন ঘটায়। কিছু ক্ষেত্রে এই মিলন হয় অসম, এবং এই কোষ দুটোর মধ্যে যেই ছত্রাকটি একটি নিউক্লিয়াস (অন্যান্য কোষীয় অঙ্গানু ছাড়া) দান করে, তাকেই বাচনিকভাবে পুরুষ হিসেবে বিবেচনা হয়।

ইস্ট সহ কিছু কিছু ছত্রাকের এমন মিলন কৌশল আছে যা যৌথভাবে পুরুষ ও নারী অবদানের একটি সদৃশ দ্বৈততা সৃষ্টি করে। একই রকম যৌন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ইস্ট ডিপ্লয়েড কোষ গঠনের জন্য একে অপরের সাথে কোষ বিনিময় করে হয় না, শুধুমাত্র তাদের সঙ্গেই বিনিময় করে যারা ভিন্ন যৌন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী,ছত্রাক যৌন প্রজননের অংশ হিসেবে মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতা তৈরি করে। মাশরুমের ভেতরেই ডিপ্লয়েড কোষ তৈরি হয়, যা পরবর্তিতে হ্যাপ্লয়েড স্পোরে বিভাজিত হয়। মাশরুমের যৌন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই সকল সন্তানকে (স্পোর) বিস্তৃতভাবে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে।

অধিকাংশ প্রানীতেই উভলিঙ্গিয় যৌন প্রক্রিয়া দেখা যায়, যাতে একই দেহে পুরুষ ও নারী উভয় গ্যামেট উৎপন্ন হয়।শামুকের মত কিছু প্রাণী এবং অধিকাংশ সপুষ্পক উদ্ভিদে এটি দেখা যায়। তবে বহু ক্ষেত্রে, যৌনতার বিশেষত্ব বিবর্তিত হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কিছু প্রানী তাদের কোন একটি দেহে শুধুমাত্র পুরুষ অথবা শুধুমাত্র নারী গ্যামেট উৎপন্ন করে। যে জৈবিক কারনে কোন জীবের প্রতিটিতে নির্দিষ্টভাবে নারী অথবা পুরুষ যৌনতার উন্মেষ ঘটে তাকে লিঙ্গ নির্ধারন বলা হয়।

কনিফার উদ্ভিদের স্ত্রী যৌনাঙ্গ।

আবার লিঙ্গ নির্ধারন ব্যবস্থাটি দুই রকম দেখা যায়। জিনগত ও পরিবেশগত কারনেও লিঙ্গের পরিবর্তন বা গঠন হতে পারে। এক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য উদ্ভিদ ছেড়ে প্রানী জগতের দিকে নজর দিতে হবে। ড্রসোফিলার এক্সওয়াই লিঙ্গ-নির্ধারন মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে, জিনগত এক্সওয়াই লিঙ্গ-নির্ধারণ ব্যবস্থার দ্বারা কোন প্রাণীর যৌনতা নির্ধারিত হয়। এছাড়া কমন ফ্রুটফ্লাই এবং কিছু উদ্ভিদেও এই প্রক্রিয়া দেখা যায়।এক্ষেত্রে কোন প্রাণীর যৌনতা নির্ভর করে তার পিতামাতা থেকে সে কোন প্রকারের সেক্স ক্রোমোজোম লাভ করেছে তার উপর। একজন নারীর ডিম্বাণু বা ডিম্ব কোষে একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজোম বিদ্যমান থাকে। একজন পুরুষের শুক্রাণুতে হয় একটি এক্স ক্রোমোজোম অথবা একটি ওয়াই ক্রোমোজোম বিদ্যমান থাকে। যখন একটি শুক্রাণু ও একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত ডিম্বাণু গঠনের জন্য মিলিত হয়, তখন শিশু এই দুটি ক্রোমোজোমের যে কোন একটি তাঁর বাবা থেকে লাভ করে। শিশুটি যদি দুটি এক্স ক্রোমোজোম লাভ করে তবে সে মেয়ে শিশুরূপে বেঁড়ে ওঠে আর যদি সে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম লাভ করে তবে সে ছেলে হিসেবে বেঁড়ে ওঠে।শিশু জন্মের পূর্বেই তাদের দেহে পুং জননাঙ্গ অথবা স্ত্রী জননাঙ্গ বিকশিত হয়।জিনগত প্রক্রিয়ায় আরও অনেক লিঙ্গ-নির্ধারণ ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন পক্ষীকুলে জেডডব্লিউ লিঙ্গ-নির্ধারণ ব্যবস্থা, পিপড়া ও মৌমাছিতে হ্যাপ্লয়েড-ডিপ্লয়েড লিঙ্গ-নির্ধারণ ব্যবস্থা এবং পতঙ্গরাজ্যে এক্সজিরো লিঙ্গ-নির্ধারণ ব্যবস্থা।

পরিবেশের প্রভাবে লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে পারে।
অনেক প্রজাতি রয়েছে যেগুলোতে জীবের যৌনতা পিতামাতা নয় বরং জীবনদশায় প্রাপ্ত পরিবেশের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বহু সরীসৃপে তাপমাত্রা নির্ভর যৌনতা নির্ধারন ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন কচ্ছপের যৌনতা নির্ধারিত হয় ডিম ফোটানোর তাপমাত্রার উপর,কম তাপমাত্রায় ফোটানো ডিমগুলোতে পুরুষ এবং বেশী তাপমাত্রার ডিমে নারী কচ্ছপ বেড়ে ওঠে।
আবার কিছু জীবের ক্ষেত্রে জীবনভর যৌনতা পরিবর্তিত হয়,যেমন সকল ক্লাউনফিশ’ই জন্মগতভাবে পুরুষ কিন্তু তাদের দলের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী মাছটি নারী মাছে রূপান্তরিত হয়। যা প্রতিবার প্রজননের সময় ঘটে।কিছু ফার্ণ উদ্ভিদে সাধারন যৌনতা হল উভলিঙ্গ, কিন্তু আগে উভলিঙ্গ ফার্ণ জন্মেছিল এমন মাটিতে আবার নতুন ফার্ণ জন্ম নিলে তা পুরুষ ফার্ণে পরিণত হয়।

কনিফার উদ্ভিদের পুরুষ যৌনাঙ্গ।

যৌন দ্বিরূপতা না থাকলে পরিষ্কার বুঝাই যাবে না কে পুরুষ বা কে স্ত্রী, যদি বুঝা না যায় তাহলেও বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হবে বিশেষ করে উন্নত শ্রেনীর প্রানীকুলের মধ্যে পরষ্পরে যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে না এবং নতুন বংশধরের সৃষ্টি হবে না। আসলে যৌন দ্বিরূপতা বলতে কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির জীবের বা উদ্ভিদের স্ত্রী ও পুরুষ সদস্যের মধ্যে বাহ্যিক শারীরিক বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এমন তারতম্য দেখা যায় যাতে করে স্ত্রী-পুরুষে খুব সহজে পার্থক্য করা যায়। সাধারনত প্রধান পার্থক্যটি হল যৌনাঙ্গের বিভিন্নতা। এছাড়া বর্ণ, আকার-আকৃতি, গঠন অথবা কোন বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে এদের আলাদা করা যায়।

পুরানো কাঠের উপর জন্মানো ছত্রাকের ফ্রুটবডি।

প্রধানত দু’টো কারনে যৌন দ্বিরূপতা দেখা যায়। প্রথমত, বিপরীত লিঙ্গের জীবকে আকৃষ্ট করার লক্ষে যৌন বিবর্তনের মাধ্যমে দ্বিরূপতা সৃষ্টি (যেমন পুরুষ ময়ূরের ঝলমলে পালক) এবং দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে দ্বিরূপতা সৃষ্টি (যেমন পুরুষ বেবুনের দেহ অনেক বড় থাকে)। প্রধানত পাখিদের মধ্যে যৌন দ্বিরূপতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ পাখিদের ঝলমলে ও উজ্জ্বল পালক থাকে, এতে প্রজনন ও সীমানা বজায় রাখতে সুবিধা হয়। স্ত্রী পাখিদের পালক সাধারণত খুব সাদামাটা হয়, যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে তা একদম মিশে যায়। ফলে বাসায় বসে থাকা স্ত্রী পাখিরা শত্রুর হাত থেকে বেঁচে যায়।একই কারনে স্তন্যপায়ী ও অমেরুদণ্ডী
প্রাণীদের মধ্যে যৌন দ্বিরূপতা দেখা যায়।এছাড়া
আচরনের দিক থেকেও বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন প্রানীজগতে অনেক পুরুষ সদস্যদের খাদ্যাভ্যাস স্ত্রী সদস্যদের তুলনায় ভিন্ন। আর এই ভিন্নতা থেকেও যৌন দ্বিরূপতা খুব সহজেই বুঝা যায়।