কাউবয় লিপস্টিক ও দইগোটা

দইগোটা (Bixa orellana L)

দইগোটা (Bixa orellana L) এর ফুল

শুরুতেই একটা কথা বলে রাখছি আমার লেখার প্রথম অংশটি শুধু ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য হবে সুতরাং ভগ্নিরা মন খারাপ করবেন না। আমরা সকলেই সৌন্দর্য পিপাষু আর আমাদের ভগ্নিরাও সাজতে পছন্দ করেন ও আমরাও তা চাই। মানব সৃস্টির প্রথম থেকেই এই ব্যাপারটা চলছে। প্রেম প্রীতি ও প্রনয় ঘটলেই নারী পুরুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা হয় ফিস ফিস করে কথা বিনিময়ের ফাকে বাদাম খাওয়া হয়। যখন পরস্পরকে বিদায় দেয়ার সময় হয় তখন ছেলে বন্ধুটি যে বিষয়টি খুব ভাল করে পরীক্ষা করেন তা হলো তার জামা কাপড় বা শরীরের কোন অংশে লাল,গোলাপি,মেজেন্ডা ইত্যাদি কোন রঙ লেগে আছে কিনা! সুধী পাঠক দয়া করে আমাকে আপনারা ছেলেটির আসনে বসাবেন না কেননা আমি কখনোই এহেন কর্মের সাথে লিপ্ত ছিলাম না। কথায় আছে প্রিয়ার ঠোটের লিপস্টিক ২০ ভাগ যায় পানিতে ধুয়ে, ৪০ ভাগ যায় প্রিয়ার পেটে আর বাকি থাকে ৪০ ভাগ তা ভক্ষন করে ছেলেরা(যদিও এখন বাজারে Kiss proof লিপস্টিক পাওয়া যায়)
পিগমেন্ট দিয়ে রাঙানো হাতআদিকালে মানুষ লিপস্টিক কি তা জানতো না। তবে লিপস্টিক নিয়ে বিভিন্ন রকমের কথা জনমনে প্রচলিত আছে। একদা আমেরিকান এক তরুন কাউবয় মাঠে পশু চড়ানোর সময় কৌতুহল বশত এক গাছ থেকে ফল ছিড়ে হাতে নিয়ে দেখছিলেন হঠাৎ খেয়াল হলো তার হাত রঙিন হয়ে উঠেছে। তখন থেকেই কাউবয়ের মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল “এই রঙ তার প্রিয়তমাকে রাঙাতে ব্যবহার করবে”। নাছোড়বান্দা কাউবয় শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গিনী কে রাঙিয়েই ছাড়লো। প্রথমে পায়ে আলতা হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো তার পর লিপস্টিক হিসেবে। তার পর থেকে শুরু হলো লিপস্টিকের ব্যবহার যা আজ আধুনিক সমাজে তরুনী দের অন্যতম প্রধান প্রসাধনী।

লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট

লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট

১৬৫০ সালে ব্রিটেনের সংসদে লিপস্টিক দেয়া নিষিদ্ধ করতে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছিলো। যদিও সে বিল পরে পাস হয়নি। রোমান সাম্রাজ্যে অবশ্য লিপস্টিককে মর্যাদা সম্পন্নদের সাজ বলে গণ্য করা হতো। এমনকি পুরুষরাও সে সময়ে লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙাতেন জাতে ওঠার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের জনক বলে পরিচিত জর্জ ওয়াশিংটন মাঝে মধ্যে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতেন। এছাড়া তিনি মেকআপ নিতেন বাইরে বের হওয়ার সময়।
যুক্তরাষ্ট্রের কানাসে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ৪৪ বছরের কম বয়সী নারীদের জন্য লিপস্টিক ব্যবহারে বারণ ছিল। এ সময়ে লিপস্টিক ব্যবহারের কারণে অনেককেই জেলে যেতে হয়। কারন হিসেবে বলা হয়েছিল লিপস্টিক অন্যদের বিভ্রান্তি তৈরি করে। ১৯৫২ সালে বিবাহ সংবর্ধনায় ব্যবহার করার জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ নিজস্ব লিপস্টিক প্রস্তুত করিয়েছিলেন। অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলর লাল লিপস্টিক খুব পছন্দ করতেন। তিনি পরিচালকদের কাছে দাবি তুলেছিলেন যে, তার অভিনীত সিনেমায় অন্য কেউ যেন লাল লিপস্টিকে ঠোঁট না সাজায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে লিপস্টিকের বাজার ছিল রমরমা। কারণ উইনস্টন চার্চিল লিপস্টিক পছন্দ করতেন। তার আশপাশের নারীরা লিপস্টিক লাগিয়ে ঘুরছেন, তা দেখতে তিনি পছন্দ করতেন। ফলে লিপস্টিকসহ অন্যান্য প্রসাধনীর উৎপাদন বন্ধ না করতে তিনি নির্দেশ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের আশি শতাংশ নারী লিপস্টিকের ভক্ত, যা ফ্রান্সের তুলনায় ১০ ভাগ বেশি।
Kiss proof লিপস্টিকলিপস্টিক হচ্ছে এক প্রকার প্রসাধনী দ্রব্য যা বিভিন্ন রকম রঞ্জক পদার্থ, তেল, মোম, এবং ত্বক কোমল কারী পদার্থের সন্নিবেশে তৈরি হয় যা আমাদের ভগ্নিরা মুখমন্ডলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ঠোঁটে প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু আমরা কি জানি এই প্রিয় প্রসাধনী তৈরিতে লেড(Lead) ব্যবহার করা হয় যা কার্সিনোজেনিক। বিশ্বের মোট মহিলা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১০% হলো লিপস্টিক ব্যবহারের জন্য। কারন অনেক প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিস্টান লিপস্টিক তৈরিতে ক্যান্সার সৃস্টি কারি উপাদান লেড ব্যবহার করে। সুতরাং ক্রয় করার সময় দাম যতই বেশী হোক নে কেন নামকরা কোম্পানী দেখে নেয়া উচিৎ।
প্রাচীন মিশরীয় মেয়েরা Rhodophyta বিভাগের সামুদ্রিক লাল শৈবাল বা লোহিত শৈবাল থেকে আহরিত পার্পল-লাল রঙের রঞ্জক পদার্থের সাথে ০.০১% আয়োডিন, এবং কিছু ব্রোমিন মিশিয়ে এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ তৈরি করতেন, যা লিপস্টিক হিসেবে প্রয়োগ করা হতো। রানী ক্লিওপেট্রা তাঁর ঠোঁটে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন যা তৈরি হতো মেরুন রংয়ের বিটল পোকা থেকে। সুধী পাঠক আপনাদের ধৈর্যের বাধ আমি ভাঙ্গতে চাই না কেননা গাছটির নাম না বলায় এতক্ষনে হয়ত অনেকেই আমাকে বেরসিক লেখক বলে গালমন্দ করতে শুরু করেছেন। আপনারা সকলেই একে চিনেন বাংলায় দইগোটা,লটকন,লটকা,সিন্দুর ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইংরেজিতে Achiote বা lipstick tree নামে পরিচিত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় Bixa orellana নামে পরিচিত।
দইগোটা (Bixa orellana L) এর ফল ও বীজদইগোটা নামটি যথার্থ কেননা এর বীজে প্রাপ্ত বিক্সিন নামক পিগমেন্ট দই,মিস্টি ও মিস্টি জাতিয় খাবার রাঙাতে ব্যবহার করা হয়। ইংরেজ সাহেবরা লিপস্টিক ট্রি নামকরন করার একটাই কারন যা ভুমিকায় বর্ননা করেছি অর্থাৎ এর পিগমেন্ট লিপস্টিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। উদ্ভিদ বিজ্ঞানি কার্ল লিনিয়াস এর জেনাসের নামকরন করেছেন Bixa তাও এই উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত পিগমেন্ট বিক্সিন এর উপর ভিত্তি করে।

বর্গঃ Malvales
পরিবারঃBixaceae
গনঃBixa
প্রজাতিঃ B. orellana
উদ্ভিদতাত্বিক নামঃBixa orellana L.
দইগোটা (Bixa orellana L) হচ্ছে আমেরিকা অঞ্চলের ছোট গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ এই ফুলের হালকা গোলাপি রঙ যে কারো মন কাড়ে। এর বীজ থেকে হলুদাভ-কমলা বর্ণের রঞ্জক (বিক্সিন) পাওয়া যায়। এই পরিবারের ১টি মাত্র গন আছে যার ৫ টি প্রজাতি বিদ্যমান। এই প্রজাতিগুলির মধ্যে শুধু orellana প্রজাতিটি চাষাবাদ করা হয়।দইগোটা (Achiote বা lipstick tree)ফুলের মাঝে ঘন পুংকেশরগুলো কুকড়িয়ে ফুলের সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এ গাছের ফলগুলোও বেশ সুন্দর। ফলগুলো লাল বর্নের এবং এর ত্বক স্পাইনযুক্ত। কলম্বিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লোক ঔষধি কাজে এবং সাধারণ সংক্রমণে ব্যবহার করা হয়। দইগোটা ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণের চিকিৎসায় কলম্বিয়াতে ব্যবহৃত হয়।
খাদ্য,ঔষধ,প্রসাধনী ও শিল্প কারখানায় দইগোটার ব্যবহার অনেক। এর পাল্প থেকে প্রাপ্ত বিক্সিন red-orange dye হিসেবে ভাত,পনির,কোমল পানীয়,তেল,মাখন এবং সাবানে রঙ করতে ব্যবহার করা হয়। এর রঙ কাপড়ে রঙ করতেও ব্যবহার হয়।ফিলিপাইনে এর বীজের পাল্প থেকে প্রাপ্ত রঞ্জক দিয়ে লেদার পলিশ করা হয়। দইগোটার বীজে বিদ্যমান carotenoids এ bioactive sesquiterpenes থাকার কারনে Candida albicans ও T. mentagrophytes এর বিরুদ্বে এন্টি ফাংগাল ফলাফল প্রদর্শন করে। এছাড়াও Escherichia coli,Staphylococcus aureus, ও P. aeruginosa বিরুদ্বে এন্টি ব্যাক্টেরিয়াল ফলাফল প্রদর্শিত হয়। এর পাতার নির্যাস ম্যালেরিয়া জ্বরে ব্যবহার করা হয় এছাড়া Bacillus pumilus এর বিরুদ্বেও চমৎকার ফলাফল প্রদর্শন করে।
টীকাঃ
★লেড(Lead)–এক প্রকার ক্যামিকেল যা neurotoxin ও এর সামান্যতম Doses এর জন্য মহা বিপদ হতে পারে। It is a cancer causing agent.
★Carotenoids–একে tetraterpenoids বলা হয়। এটি একটি অর্গানিক পিগমেন্ট যা সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে এমন উদ্ভিদ ও ব্যাক্টেরিয়ার ক্লোরোপ্লাস্ট ও ক্রোমোপ্লাস্টে পাওয়া যায়।
★Sesquiterpenes–এক প্রকার terpenes.
সতর্কীকরণঃ যে কোনো ভেষজ ঔষধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
ছবিঃ গুগল থেকে সংগৃহীত।