দিরাই-শাল্লার সব হাওরের বোরো ধান পানির নিচে

23 April, 2016

23.04.16 n-1

হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী, সিলেট অফিস ও হাবিবুর রহমান তালুকদার দিরাই সুনামগঞ্জ)

গত বুধবার পর্যন্ত ২৬২ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকার ফসলহানি হয়েছে সিলেট বিভাগে। স্বপ্নের সোনালী ধান এখন ভাসছে পানিতে। কপাল পুড়েছে এক লাখ ৮ হাজার কৃষকের।

কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে ৬ এপ্রিল থেকে সিলেটের চার জেলায় শিলাবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ী ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ২২ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে উত্পাদন ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার ৬৭৪ মে. টনে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জেই ২০৩ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এই জেলার ৭২ হাজার কৃষকের গোলা এখন শূন্য।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান সুনামগঞ্জ জেলার পানিতে তলিয়ে যাওয়া কয়েকটি হাওর এলাকা পরিদর্শনকালে কৃষকদের অবশিষ্ট ধান কেটে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছরের মত এবারও সুনামগঞ্জ জেলার ৪২টি হাওরের ফসল রক্ষার জন্য হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করে। ২০৯ কি.মি. বাঁধের কাজ হয়, ব্যয় হয় ৩২ কোটি টাকা। কিন্তু ধান কাটার আগ মুহূূর্তে ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই জগন্নাথপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে, কোনো কোনো স্থানে বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করে। এতে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাওরে পানি প্রবেশ করার মুহূর্তে প্রশাসন দ্রুত কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মাইকিং করে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দরুন এবং ধান কাটার শ্রমিকের অভাবে কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারেনি। অবস্য কোনো কোনো স্থানে ‘কম্পাইন্ড হারভেস্টার’ ও ‘রিপার’ দিয়ে কৃষি বিভাগ ধান কেটে তুলতে কৃষকদের সহায়তা করে। এবার সিলেটের চার জেলায় ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লক্ষ ৮২ হাজার ১৩৮ মে. টন ধান। এদিকে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাওরগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার ও পিআইসিদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন।

এদিকে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার সবকটি হাওর একে একে তলিয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার নতুন করে বৈশাখী, মাছুয়ারখাড়া ও কাদিরপুর বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে চাপতি, উদগল ও বরাম হাওর। পাকা বোরো ফসল হারানোর বেদনায় কৃষাণ-কৃষাণীদের চোখে পানি নেমে এসেছে। তাদের কষ্টে ভারি হয়ে উঠেছে হাওরের বাতাস। বুধবার দিবাগত রাতে ২ দিনের ব্যবধানে চাপতি হাওরের ৪ হাজার হেক্টর জমির ধান এবং মাছুয়ারখাড়ার বাঁধ ভেঙ্গে উদগল হাওরের ৫শ হেক্টর ফাটা কাওরির বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে ভরাম হাওরের ভাঙ্গাডহর গ্রামের বাকি অংশটুকুর জমির ধান। শুধু হাওর নয়, অসময়ে পানির চাপে মাঠ-ঘাট সবই তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষণ-কৃষাণী কাটা ধান নিরাপদ স্থানে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এদিকে শাল্লা উপজেলার জোয়ারিয়া বাঁধ ভেঙ্গে শ্রীহাইল, হোসেনপুর, গোবিন্দপুর, ইছাকপুর ও শংকরপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসল তলিয়ে গেছে। শাল্লা উপজেলায় ২২ হাজার হেক্টর বোরো জমির মধ্যে ৩০ ভাগ ফসল কাটা হয়েছে বলে কৃষি অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে। ফলে স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনায় বিবর্ণ হাওর পাড়ের কৃষককুল। ফসল হারানোর দুঃখে হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারের চোখে যখন পানি, তখন ‘বাঁধ বাণিজ্যের নায়করা’ হাসছেন আনন্দের হাসি। কৃষকদের অভিযোগ, তারা বাঁধের মাটি কাটলেও শেষ সময়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বাঁধ রক্ষার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

দিরাই-শাল্লা উপজেলা কালনী-দাড়াইন-কুশিয়ারার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত সবকটি বাঁধ। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকার হাওর এলাকার বাঁধ নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সে টাকা সাধারণ কৃষকের কোনো কাজেই আসেনি। পাউবো’র একশ্রেণির কর্মকর্তা, ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য ও স্থানীয় সরকার দলীয় নেতারা যোগসাজশ করে সেই টাকা পকেটস্থ করেছে। জানা গেছে, বাঁধ বাণিজ্যের নায়করা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রক্ষায় এলাকার স্থানীয় কৃষকদের কাগজে-কলমে শ্রমিক দেখিয়ে হাজার হাজার বস্তা ও বাঁশ ক্রয়ের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সঠিকভাবে ও সময়মত বাঁধ নির্মাণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি পাউবো। স্থানীয় জনগণ নিজেদের উদ্যোগে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামত ও উঁচু করতে দিন-রাত মাটি ফেলে গেছেন হাওর পাড়ের শত শত কৃষক। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। দিরাই উপজেলা কৃষি অফিসার মাজেদুল ইসলাম জানান, সব হাওরই এখন পানির নিচে। চাপ্টা, ঘনিয়াধরা, কান্দকলা ব্রিজের বাঁধ, পুইট্টা হাওরের বাঁধ, সুখলাইনের ছায়ার হাওরের বাঁধ, ভাটিকান্দি বাঁধসহ বিভিন্ন হাওরের বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম আসিফ বিন ইকরাম বলেন, সবকটি বাঁধ রক্ষায় প্রশাসনের লোক এবং স্থানীয় কৃষকরা কাজ করেছেন। যেসব বাঁধের কাজে দুর্নীতি হয়েছে, সেক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এ বছর দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১২টি হাওরের ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধের জন্য ৭৬টি প্রকল্পের অনুকূলে পিআইসির মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা ও কালিয়াকুটা হাওরে দুটি বাঁধে ঠিকাদারের মাধ্যমে ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়।

বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বোরো ফসল

নেত্রকোনা প্রতিনিধি ও মোহনগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি এবং বর্ষণজনিত কারণে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাইজদিয়া বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় হাওর এলাকার কয়েকশ হেক্টর জমির আধা পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিকে গতকাল শুক্রবার কৃষি সচিব মোঃ মঈন উদ্দীন আব্দুল্লাহ এবং নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক ড. মোঃ মুশফিকুর রহমানসহ কৃষি কর্মকর্তাগণ মোহনগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার পানিতে নিমজ্জিত কয়েকটি হাওর পরিদর্শন করেছেন।

নেত্রকোনা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল বলেন, কৃষকরা ধান কেটে ফেলছে। আর যদি পানি না বাড়ে তাহলে বোরোর তেমন ক্ষতি হবে না। উল্লেখ্য, এবার নেত্রকোনায় ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে।

Source: http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/last-page/2016/04/23/115666
Photo Source: http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/last-page/2016/04/23/115666