প্রকৃতির পাঠশালা- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
23 April, 2016
বারেক কায়সার :
বন-পাহাড়ের এই ক্যাম্পাসে বিচরণ করে মায়া হরিণসহ ৩১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণি, রয়েছে হাজার রকম উদ্ভিদ, ২৫০ একর পাহাড়ি ও ৬শ একর সৃজিত বন
কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি, পাখির কিচিরমিচির, মায়া হরিণের ভালোবাসা মাখা চাহুনি, ঝর্নার ঝিরি ঝিরি শব্দ, হাজারো প্রজাতির গাছের সমারোহ – কী নেই এখানে! প্রকৃতি এখানে উদার ও মায়াময়। বন-পাহাড়ের সেই মায়াবী ডাক কিংবা ঝর্নার হাতছানি এড়াতে পারেন না কেউ। বলছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথা। এ এক বিস্ময় জাগানিয়া ক্যাম্পাস। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার পাশাপাশি খুব সহজেই প্রকৃতির পাঠও শিখে নেয় এখানকার শিক্ষার্থীরা। এ যেন প্রকৃতির এক উন্মুক্ত পাঠশালা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাই আমরা ক্যাম্পাসভিত্তিক পর্যটনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর কথা ভাবছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, শিক্ষার পাশাপাশি পর্যটনের ক্ষেত্রেও এটি অনবদ্য স্থান হয়ে উঠবে। পরিকল্পিত কাজগুলো শেষ হলে ক্যাম্পাস পর্যটনের বিষয়টি প্রচারে নিয়ে আসা হবে বলে তিনি জানান।
বন্যপ্রাণির নিরাপদ আশ্রয় : বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণি ও পাখির নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই হরিণ দেখা যায়। এ ছাড়া বানর, বন্য শূকর, সজারু, খরগোশ এবং বহু প্রজাতির সাপ, ব্যাঙও প্রায়ই দেখা যায়। ক্যাম্পাসে ছয়টি শ্রেণির ৯৯টি পরিবার এবং ২১১টি গণের অন্তর্ভুক্ত ৩১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণির দেখা মেলে। এর মধ্যে ১৯টি স্তন্যপায়ী, ১৩৮টি পাখি, ২০টি সরীসৃপ, ১২টি উভচর, ১৩টি মাছ এবং ১১৭টি পতঙ্গ শ্রেণির প্রজাতি। এ ছাড়া কীট-পতঙ্গের সংখ্যা রেকর্ডকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ : প্রায় হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে ক্যাম্পাসে। পাহাড় কিংবা সমতলভূমি সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে এসব উদ্ভিদ। এত বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদ থাকলেও এর প্রত্যেকটির নাম ও বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ গবেষকরা। বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে ২৫০ একর। ৬০০ একর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৃজিত বন। এছাড়া ১৫০ একর ভূমির ওপর একটি উদ্ভিদ উদ্যানও রয়েছে। লেক আছে ২৫টি। বড় পুকুর আছে পাঁচটি। এ ছাড়া সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছড়া-ঝর্না তো রয়েছেই।
জানা গেছে, বর্তমানে ক্যাম্পাসে ১৩৬টি পরিবার এবং ৫১২টি গণের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৮৩৫ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদের উপস্থিতি রয়েছে। এই ৮৩৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩৯৬টি বীরুত্, ১৭৪টি গুল্ম, ৭৮টি আরোহী এবং ১৮৭টি বৃক্ষ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৩৪ প্রজাতির ঔষধি, ৫৫ প্রজাতির কাঠ উত্পাদনকারী, ৫৩ প্রজাতির শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ রয়েছে। ক্যাম্পাসের আবাসিক বাসা-বাড়িগুলোতে প্রায় ৩০ প্রজাতির ফল প্রদানকারী উদ্ভিদের চাষ করা হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ২৮ প্রজাতির সবজি উত্পাদনকারী উদ্ভিদ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ৪৪ প্রজাতির অর্কিড, ৫২ প্রজাতির ফার্ন এবং ৪৭ প্রজাতির শৈবাল।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আল আমিন জানান, ক্যাম্পাসে বাজপাতা, সিবিথ, গুটগুটিয়াসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় গাছের বাগান আছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেসব গাছপালা বিলুপ্ত হতে পারে সেগুলোরও সংগ্রহ আছে এখানে।
সবুজায়নের যত উদ্যোগ:১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ শহীদ আব্দুর রব সড়কে স্বল্প পরিসরে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পতিত পাহাড়ি ভূমিতে ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রির তত্ত্বাবধানে নিবিড় বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবে ক্যাম্পাসে প্রায় ৫৫০ একর এলাকায় বৃক্ষরোপণ করা হয়। এ পর্যন্ত দেশীয় সাধারণ বৃক্ষ ছাড়াও বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতি, ফলদ, বনজ ও ঔষধির প্রায় ৩০০ প্রজাতির বৃক্ষের প্রায় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। বন সৃষ্টি ও বৃক্ষরোপণে ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি ১৯৯৪ ও ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারও লাভ করে।
হরিণের ক্যাম্পাস: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই হরিণ চরে বেড়ায়। এই হরিণের নাম মায়া হরিণ। এর বাংলা আরেকটি নামও রয়েছে কাকর হরিণ। মায়া হরিণের ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার বা Indian Muntjac। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মায়া হরিণগুলো রয়েছে সেগুলো খর্বকায় ও লাজুক স্বভাবের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়, ব্যবসায় অনুষদের পেছনে, ফরেস্র্বি এরিয়াসহ পুরো ক্যাম্পাসেই চোখে পড়ে শরীরে ফোটা-বিহীন ছোট আকারের লালচে-বাদামী রংয়ের এই হরিণগুলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মায়া হরিণের সংখ্যা জানতে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গাজী আজমতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে হরিণের প্রকৃত সংখ্যা তার জানা নেই। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হরিণগুলোর গড় ওজন ১৭ কেজি ও উচ্চতা ২২ ইঞ্চি পর্যন্ত। পুরুষ মায়া হরিণের এক জোড়া শিং থাকে। শিং জোড়া এক থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা। এই শিংয়ে আবার দুই থেকে তিনটি শাখা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এরা সাধারণত একলা চলাফেরা করে। এখানকার মায়া হরিণ সর্বভুক। এরা ঘাস-লতাপাতা থেকে শুরু করে পাখির ডিম এবং ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণিও খায়!
পর্যটন স্পট : চট্টগ্রাম শহর থেকে শাটল ট্রেনে চেপে এই ক্যাম্পাসে যেতে হয়। এমন আকর্ষণীয় শাটল ট্রেন পৃথিবীর আর কোনো ক্যাম্পাসে আছে কী না সন্দেহ রয়েছে। এই শাটল ট্রেন এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনযাপনের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের পেছন দিকে পাহাড়ের ধার বেয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলেই শোনা যাবে অবিরাম ধারায় গড়িয়ে পড়া পানির ঝিরি ঝিরি শব্দ। দেখে মনে হবে, যেন এক খণ্ড মাধবকুণ্ড নেমে এসেছে ক্যাম্পাসে। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে কলা অনুষদে যেতেই চোখে পড়বে লাল-হলুদ রঙ মাখানো একটি ঝুলন্ত সেতু। এ যেনো একখণ্ড রাঙ্গামাটি! বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাবেক এক ছাত্রের অর্থায়নে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন এই ঝুলন্ত সেতুটি।
ছাত্রী হল থেকে একটু সামনেই ইট-সুরকির রাস্তা ধরে এগোলেই বোটানিক্যাল গার্ডেন। বিশাল এ উদ্যানে রয়েছে ছোট-বড় ২২টি বাগান।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ঔষধি গাছের বাগান, মৌসুমি ফুল বাগান, গোলাপ বাগান, মসলা ও বেত বাগান, হিজল বাগান, আনারস ও কাঁঠালসহ ফলদ বাগান। এছাড়া দেশীয় অর্কিডের বিশাল সংগ্রহও রয়েছে।
ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত সৌধ ‘স্মরণ’। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে রয়েছে বুদ্ধিজীবী চত্বর, শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালসহ বিভিন্ন স্মারক। রয়েছে বিশ্বশান্তি প্যাগোডা। বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে রয়েছে পাল, সেন, গুপ্ত, সুলতানি, মোঘলসহ বিভিন্ন আমলের প্রায় দুই হাজার ১৭টি নিদর্শন। যে সবের মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার হরিকেল জনপদকে চিনতে পারবেন পর্যটক-দর্শনার্থীরা।
Source: http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/last-page/2016/04/23/115670
Photo Source: www.dhakatribune.com