খুলনাঞ্চলে অনাবৃষ্টি লবণাক্ততা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে পানি ও মাটি
25, April 2016
আবু হেনা মুক্তি:
অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততার প্রভাবেই উপকূলীয় অঞ্চল ও বৃহত্তর খুলনার নদ-নদীর পানি ও কৃষি জমির মাটি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। চৈত্র বৈশাখ মাসে এবার বৃষ্টির দেখা নেই। চারদিকে তাপদাহ। তেতো হয়ে উঠেছে যেন প্রকৃতি। ধানের মূল্য কম, লবণাক্ততা ও পানির অভাবে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল আশানুরূপ হয়নি। এক সময় ধান্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত পলি মাটি বিধৌত উপকূলীয় অঞ্চলের সে জৌলুস হারিয়ে ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে এখন চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কৃষক হতাশ। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে চিংড়ি চাষে গিয়েছিল। সেখানে তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ভালো ফলাফল করতে পারেনি। কৃষিতে ফিরে এসেও সবুজ বিপ্লব ঘটাতে পারছেনা তারা। মাটিতে দস্তা, ফসফরাস ও নাইট্রোজোনের ঘাটতি এতোটাই প্রবল যে, মাটির উর্বরা শক্তিকে নিমেষেই তছনছ করে দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক পরিবার চরম উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছে। সূত্রমতে, বৃহত্তর খুলনার মোট কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ১৪০ হাজার হেক্টর। কিন্তু সিডর ও আইলার কারণে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যায়। বর্তমানে প্রায় ৯০/৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। আমন এ অঞ্চলের প্রধান ফসল। কিন্তু প্রায় ৪০-৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এখন ভালো আমন চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। খুলনার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, গেল মার্চে শেষ হওয়া রবি মৌসুমে ৪৮ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়। এ মৌসুমে ১২৯ হাজার হেক্টর গম, ৩২৫ হাজার হেক্টর আলু, ১৬ হাজার হেক্টরে মিষ্টি আলু, ৩৫৬ হাজার হেক্টরে শরিষা, ২০ হাজার হেক্টরে ভুট্টা, ৭৫ হাজার হেক্টরে ইক্ষু, ২৩০ হাজার হেক্টরে মরিচ, ১৭৫ হাজার হেক্টর পেঁয়াজ, ৬৫ হাজার হেক্টরে রসুন, ৩৬ হাজার হেক্টরে ধনিয়া, ২৪৮ হাজার হেক্টরে মাষকলাই এবং ৫ হাজার ৩৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে শাক-সবজি চাষ করা হয় । তবে গত বছর (খরিপ-২) মৌসুমে ৮০ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। এছাড়া আসন্ন (খরিপ-১) মৌসুমে ৬ হাজার ৭৫০ হেক্টরে আউশ ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই সূত্রটি জানায়, মূলত খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় আইলার প্রভাব, লবণাক্ততা এবং পানিবদ্ধতার কারণে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে চিত্র একই রকম। এরই ধারাবাহিকতায় আগে কয়রায় সাড়ে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হলেও বর্তমানে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। একইভাবে দাকোপে সাড়ে ১৯ হাজার হেক্টরের স্থলে ১৫ হাজার ৪শ’ এবং পাইকগাছায় ২২ হাজার হেক্টরের স্থলে চাষ হচ্ছে ১৫ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে। এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলেন, কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলা কৃষি জমি পানিবদ্ধ থাকায় কৃষকরা চাষ করতে পারেনি। তবে এসব এলাকায় বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ায় আসন্ন মৌসুমে পুরো জমিতে চাষ করা সম্ভব হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকদের মধ্যে পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট, খুলনার আঞ্চলিক গবেষণাগারের প্রিন্সিপ্যাল সাইন্টিফিক অফিসার ইনকিলাবকে জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনাঞ্চলের মাটিতে দস্তা, ফসফরাস ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি রয়েছে। অপরদিকে, গন্ধক, পটাশিয়াম ও বোরনের পরিমাণ বেশি রয়েছে। তিনি বলেন, মাটিতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৭টি পুষ্টি উপাদান থাকতে হবে। এরমধ্যে মুখ্য পুষ্টি নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এবং গৌণ পুষ্টির মধ্যে, দস্তা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, মানিকটেনাম, ক্লোরিন, বোরন ও তামা উল্লেখযোগ্য। তবে এ অঞ্চলের মাটিতে গৌণ পুষ্টির মধ্যে দস্তার ঘাটতি থাকলেও ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম পর্যাপ্ত পরিমাণ রয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ জৈবসার শতকরা ৫ ভাগ থাকার কথা থাকলেও ১/২ ভাগ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি । সূত্রমতে, অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততার প্রভাবে খুলনাঞ্চলের মাটি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে ৬ ধরনের মাটি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ননস্যালাইন (অলবণাক্ত) মাটি (২ পয়েন্ট ডিএস পারমিটার), ভেরি স্যালাইনিটি (অতি সামান্য-২ থেকে ৪ ডিএস পারমিটার), সামান্য লবণাক্ত (৪ থেকে ৮ ডিএস পারমিটার লবণাক্ত মাটিও ব্যবহার করা যায়। তবে এ অঞ্চলের মাটিতে লবণের পরিমাণ অতিরিক্ত হওয়ায় তা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে সাড়ে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ ডেসিসিমেন/ মিটার লবণাক্ত রয়েছে। সূত্রানুযায়ী, গত মাসে রূপসা নদীর রূপসা ফেরিঘাটে ১৮ দশমিক ৪, ভৈরবের ফুলতলা ঘাটে ১৭, পশুর নদীর মংলা বন্দর ঘাটে ২৩ দশমিক ৪, কালিগঞ্জের কাকশিয়াল ঘাটে ২৩ দশমিক ২, ভদ্রা নদীর খর্ণিয়া ঘাটে ১৫ দশমিক ৪, কাজীবাছা নদীর গাগরাগাতি ঘাটে ২২ দশমিক ৭, শিবসার শিববাড়ী ঘাটে ২৪ দশমিক ১, শোলমারির কৈয়া ঘাটে ৮ দশমিক ৭, জলমা ঘাটে ১৪ দশমিক ৭, কপোতাক্ষের পাটকেলঘাটা ঘাটে ১৪, ঝপজপিয়া নদীর পানখালি ঘাটে ২৪ দশমিক ৪, চৈতন্য নদীর বিনেরপোতা ঘাটে ২৫, মরিচান নদীর আশাশুনি ঘাটে ২৩ দশমিক ৮, মধুমতির মোল্লাহাট ঘাটে ৪ দশমিক ৩, দড়াটানা নদীর ব্রীজ ঘাটে ১৪ দশমিক ৬, বলেশ্বরের হিজলা ঘাটে ২ দশমিক ৯, চিত্রা নদীর তেরখাদা ঘাটে ২ দশমিক ৩ এবং আতাই নদীর দিঘলিয়া ঘাটে লবণাক্ততার পরিমাণ ১৪ দশমিক ৫ পয়েন্ট ডেসিসিমেন/ মিটার। দশমিক ৭৫ পয়েন্ট ডেসিসিমেন/ মিটার লবণাক্ত পানি ব্যবহার ও চাষের জন্য নিরাপদ। এরপরে দশমিক ৭৫ থেকে ৩ পর্যন্ত ক্ষতিকর এবং দশমিক ৭৫ থেকে ৩ মিটারের বেশি হলে সে পানিকে অধিক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করা হয়। এ ধরনের পানি কৃষি কাজে ব্যবহার অনুপযোগী।
Source: www.dailyinqilab.com/details/15561
Photo Source: www.lcnewsgroup.com <http://www.lcnewsgroup.com/acute-water-crisis-hits-khulna-residents/>