দাদা
ছোট্ট একটি নামের এই ডাক-‘দাদা’। শিশির, রেখা আর আমি-আমাদের এই তিন ভাই-বোনের দাদা; আর আমাদের বড় তিন দিদির ছোট্ট ভাই। পর পর তিন মেয়ের পর যখন আমাদের দাদা জন্মালো, বাবা-মায়ের কাছে তখন নিশ্চয়ই এটা ‘Special’আনন্দের বার্তা নিয়েই এসেছিল। যদিও আমাদের বাবা-মাকে সেই অর্থে কখনো ছেলেতে-মেয়েতে তফাত করতে দেখিনি।
ফিরে আসি দাদার কথায়। দাদার সাথে আমার বিগত বেশ কয়েক বছর কোনই যোগাযোগ ছিল না। কারণটা কিছুটা পারিবারিক জটিলতা, বাকীটা আমার প্রবাসে বসবাস। ২০১১ সালের আগষ্ট মাসে আমি তখন একটা Family trip-এ গিয়েছি British Columbia তে। সেখানেই প্রথম দাদার অসুস্থতার খবর পাই। তারপর থেকেই আবার দাদার সাথে আমার যোগাযোগটা প্রতিষ্ঠিত হয়। গত কয়েক মাসে মাঝে মাঝেই তার সাথে ফোনে কথা হতো; অথবা E-mail/Facebook এ যোগাযোগ। চিকিৎসার জন্য আমেরিকা/কানাডায় আসার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেছিলেন। আমি কিছুই করতে পারিনি। মনে হলেই খারাপ লাগছে।
মনে পড়ছে সেই স্কুল বয়সের কথা। বাসায় ছিল একটা পুরনো Show case| তবে Show case ভর্তি ছিল না কোন Show piece; ছিল শুধুই দাদার Collection-এর যত রাজ্যের বই। আমার কিশোর জীবনের অনেকটাই সেই বই পড়েই কেটেছে। কখনো সত্যজিতের ফেলুদা অথবা প্রফেসর শঙ্কু, কখনো সুকুমার রায়ের কবিতা, কিংবা, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, অথবা নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা; আরো ছিল কলকাতার শারদীয় পূজা সংখ্যা, ইত্যাদি। এগুলো সবই ছিল দাদার কেনা বই। পরবর্তীতে তার Collection এ যোগ হল প্রকৃতি বিষয়ক বিভিন্ন বই; butterflies, birds, flower, plants ইত্যাদি। কখনো বা এগুলো ছিল নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে নেয়া, আবার কখনো বা ঢাকার কোন ফুটপাত থেকে সংগ্রহ। বইগুলো দাদা এতটাই যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখতো যে, এমনকি Plastic wrap-এর মলাটও ছিল সেগুলোতে। বইগুলো নিশ্চয়ই তাঁর পরম আদরের সম্পদ ছিল। তা না হলে এই কিছুদিন আগেও তাঁর অসুস্থতার মাঝেও আমাদের বড়দিদি যখন দাদার কাছে একটা বই ধার চাইল, দাদা দিতে নারাজ। বলে কিনা, বই ছাড়া অন্য কিছু চাইলে দিতাম। Notre Dame Nature Study Club-এর সাথে আজীবন সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত হয়ে বোধ করি এই বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল। আসলে দাদার তো Materialistic life-এর প্রতি তেমন আসক্তি বা আকর্ষণ ছিল না; কেমন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে জীবনে, সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণই উদাসীন দেখেছি তাকে। বরং ছুটোছুটি করত তার Camera আর দূরবীন নিয়ে- কখনো Bird-watching, কখনো বা নাম-না-জানা কোন ফুল অথবা গাছের সনাক্তকরণ, কখনো Photography-র আকর্ষণে, আবার কখনো বা কোন চিড়িয়াখানার পশু-পাখির পর্যালোচনায়। এ নিয়ে বাড়ীতেও বড়দের গালমন্দ কম শুনতে হয়নি তাকে। আবার কখনো দেখতাম দাদাকে রাস্তায় পড়ে থাকা কোন আহত চড়ুই পাখি অথবা কোন সঙ্গীহীন বিড়ালছানাকে নিয়ে বাড়ীতে হাজির। এই ছিল দাদা। অসুস্থতার পরের দিনগুলোতে ডাক্তারের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এখানে ওখানে ছুটে যেত ক্যামেরা হাতে; নিকটজনদের বারণ শুনতো না। কানাডা থেকে আমার পরিচিত জনদের দেশে যাবার কথা শুনে দাদাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, দরকারী কিছু চাই কিনা, তো বলল ক্যামেরার কথা- সেই ক্যামেরা পেয়ে সে নাকি মহাখুশি। শুনে আমার মনটাও ভরে গেল।
আজকেও সব কিছই আগের মতই আছে। Every single thing in its own place. শুধু আমাদের দাদাই নেই। দাদা নেই বলে কিছুই তো থেমে নেই। আমরা সবাই যার যার প্রতিদিনের কাজগুলো রুটিন-মাফিক করে যাচ্ছি। কোথাও কোন বিরতি নেই। শুধু দাদাই Missing|
সেই ছোটবেলার একটা স্মৃতি আবছাভাবে মনে পড়ছে। আমরা ভাই-বোনেরা আপার সাথে বাড়ীর কাছের রমনা পার্কে বেড়াতে গেছি; কিংবা হয়ত অন্য কোথাও- ঠিক মনে নেই। ফেরার পথে রিকশায় চেপে ফিরছি; সামনের সীটে জায়গা হয়নি বলে দাদা সম্ভবত; রিকশার পেছনে চড়ে আসছিল। হঠাৎ করে দাদা পেছনে পড়ে গেল; আমরা কেউ টের পাইনি প্রথমে; একটু পরে তার চিৎকারে আমাদের হুঁশ হল, তখন রিকশা থামল।
আজকে কেন যে এই কথাটা মনে হচ্ছে – আমরা দাদাকে যেন সত্যিই পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি, ২০০৪-এ। তখনই কি নিয়তিতে এটাই ছিল। দাদার সতীর্থ রুবেল ভাই-এর কাছে যখন প্রথম জানলাম – “Shekhar-da is no more among us”- কথাটা শুনে কোনই reaction হলো না সাথে সাথে; বুঝতে যেন সময় লাগল।
এমন তো কথা ছিল না দাদা – এমন করে তো যাবার কথা ছিল না। কথা ছিল, আমাদের দেখা হবে, কথা হবে – অনেক গল্প হবে – পুরনো দিনের গল্প – সেই তো কিছুই হল না আর।
By- Shikha Roy (Sister)