পঙ্খিরাজ ফার্ণ
প্রায় দেড় হাজার কোটি বছর আগের কথা। মহাকাশে দু’টি বিশাল নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে দুটি নক্ষত্র ভেঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভাঙ্গা অংশগুলো থেকেই কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে পৃথিবী ও অন্যান্ন গ্রহের সৃস্টি হয়। প্রথম অবস্থায় পৃথিবী নামক গ্রহটি বসবাসের উপযোগী ছিলো না। সেখানে ধীরে ধীরে জন্ম নিল উদ্ভিদ তারপর সবুজ শ্যামলে পরিনত হলো ও পর্যায়ক্রমে তাপমাত্রা কমে এই গ্রহটি বসবাস যোগ্য হয়ে উঠলো। তার কিছুদিন পর প্রায় ৪ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতে বসবাস করতে শুরু করে অপুষ্পক ফার্ণ (Drynaria quercifolia)।এত বছর পরে ২০১০ সালে এই ফার্ণের ফসিল আবিস্কার করা হলো চীনের ইয়ানজি নামক এক কয়লা খনি থেকে যা পায়োসিন কালের পিয়াসেনজিয়ান যুগের উদ্ভিদ বলে বিজ্ঞানীরা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন।
লক্ষ লক্ষ বছর আগের উদ্ভিদ এই পৃথিবীতে এখনো দাপটের সাথে বসবাস করছে ও আমাদের জন্য নিঃস্বার্থভাবে প্রাণবায়ু সরবরাহ করে যাচ্ছে। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় সেটি হলো শৈবাল,বিভিন্ন প্রকার আগাছা,গুল্ম, ফার্ণ,ব্রায়োফাইটা ইত্যাদি উদ্ভিদ যদি প্রকৃতিগত ভাবে মানুষের সাহায্য ছাড়া না জন্মাতো তাহলে অক্সিজেন স্বল্পতায় অনেক প্রানী বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
Drynaria quercifolia কে ইংরেজিতে Oak-leaf ও basket fern বলা হয় যা Polypodiaceae পরিবার ভুক্ত একটি terrestrial অপুষ্পক উদ্ভিদ(Pteridophyta)। এরা পাথরের ফাটলে পুরানো দেয়াল গাত্রে ও পরাশ্রয়ী হিসেবে গাছের কান্ডে ছায়াযুক্ত স্থানে বসবাস করতে পছন্দ করে। এরা কেন ছায়া যুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা নিজেদের বসবাসের জন্য বেছে নেয় সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এই ফার্ণের আদিবাসস্থান অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিন পুর্ব এশিয়া। অন্য সব উদ্ভিদের তুলনায় এদের বংশ বিস্তার একটু আলাদা এরা স্পোরের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে।
Drynaria গনের কিছু প্রজাতির পরিপক্ক স্পোর বিচ্ছুরনের সময় হলে Amino acid সমৃদ্ব খুবই মিস্টি নেকটার সিক্রেশন করে ও এই নেকটারের লোভে পড়ে Iridomyrmex cordatus নামক এক প্রকার পিঁপড়া আকৃস্ট হয়ে এই ফার্ণের রাইজোম ও পাতায় বিচরন করতে থাকে তখন পিঁপড়াকে ব্যবহার করে এই জাতিয় ফার্ণগুলো এদের স্পোর বিচ্ছুরন করে বা স্পোর গুলোকে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়।
পরিনত উদ্ভিদের পাতার নীচে বাদামী ছোট ছোট বিন্দু আকারের সোরাস দেখা যায় এদেরকে স্পোরাঞ্জিয়া বলে। মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় স্পোর উৎপন্ন হয় যা সংখ্যায় পরিপক্ক উদ্ভিদের ক্রোমোজম থেকে অর্ধেক হয়। এই সব স্পোর গুলো বাতাসের যাহায্যে মাতৃ উদ্ভিদ দেহ থেকে মাটি,পুরানো দেয়াল,পাথর খন্ড অথবা বড় বড় বৃক্ষের কান্ডে পতিত হয়ে গ্যামেটোফাইট উৎপন্ন করে যা পরবর্তিতে একটি ফার্ণ উদ্ভিদে পরিনত হয়। Juvinile অবস্থায় প্রোথেলাস খুবই ছোট যা সাধারনত আঙুলের নখের সমান একটি সবুজ উদ্ভিদ মাটিতে বা অন্য কোন অবস্থানে এদের দেখলে মনে হয় এক টুকরা সবুজ চ্ছিন্ন পত্র পড়ে আছে।তারপর এরা যৌন কোষ উৎপন্ন করে যাতে Egg ও Sperm থাকে। এই অবস্থাকে গ্যামেটোফাইট বা প্রোথেলাস বলা হয়।
সালোকসংশ্লেষণ করতে সক্ষম প্রোথেলাস দেখতে সবুজ হার্ট আকৃতির যা সাধারনত ৩-১০ মিমি লম্বা ও ২-৮মিমি প্রশস্থ হয়। এরা যেহেতু খুব ছোট থাকে তাই এদের খোঁজে বের করা খুবই কঠিন। এই অবস্থায় এদের কোন কান্ড ও মূল থাকেনা কিন্তু রাইজয়েড থাকে যা দিয়ে মাটি বা অন্য অবস্থান থেকে খাদ্য সংশ্লেষণ করে বেঁচে থাকে। এই সব প্রোথেলাসে স্ত্রী জননাঙ্গ Archegonium ও পুং জননাঙ্গ Antheridium উৎপন্ন করে। Antheridium থেকে স্পাইরাল আকৃতির স্পার্ম ও Archegonium থেকে ফ্লাক্স আকৃতির ডিম উৎপন্ন হয়। এদের স্পার্ম গুলো ডিম্বকের সাথে মিলনের জন্য পানির প্রয়োজন হয় এমতাবস্থায় শুক্রানুগুলো অপেক্ষায় থাকে রাতে কুয়াশা অথবা প্রাকৃতিক ভাবে পানির সংস্পর্শ পেলেই সাঁতার কেটে ডিম্বকের সাথে মিলিত হয়। যেহেতু এদের জনন কার্যে পানির প্রয়োজন হয় তাই এরা ভিজা ও ছায়া যুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে স্থান পছন্দ করে। সঠিক ভাবে স্পার্ম ও ডিম্বানু মিলিত হতে পারলেই নিষেক ঘটে। তখন ডাবল ক্রোমোজম বিশিস্ট একটি নতুন Juvinile অনুরূপ ফার্ণের জন্ম দেয়। এরা অনুকুল পরিবেশে বড় হয়ে আবারো উপরের প্রক্রিয়াটি সংঘটিত করে। এভাবেই চলতে থাকে এদের জীবন চক্র।
বাংলায় একে পঙ্খিরাজ ফার্ণ বা পাংখা ফার্ণ বলা হয়। চাকমা ভাষায় এটি “চিলো ভাসা” নামে পরিচিত।আমাদের ছেলেবেলায় এর শুকনা পাতা আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ঘুড়ি বানাতাম। আকাশে উড়ানোর সময় দেখতে চিলের মত মনে হতো তাই একে আমরা চিলা ঘুড়ি বলতাম। এর শুকনা পাতা বাদামী রঙের আর চিলের (বাজপাখি) পালকের রঙও বাদামী হওয়ায় এই ঘুড়িকে উড়ন্ত অবস্থায় চিলের মতই মনে হতো।
পৃথিবীতে যত রকম উদ্ভিদ আছে তার সবই কোন না কোন চিকিৎসায় মানবকল্যানে ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে, ফার্ণ এর ব্যতিক্রম নয়। এদের সমস্ত অংশ Anthelmintic,
Pectoral,Expectorant ও Tonic হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও যক্ষা,ক্ষয়রোগ,বদহজম,চর্ম রোগ ও তীব্র কাশি উপশমে ব্যবহার করা হয়।
অযত্নে অবহেলায় জন্ম নেয়া এইসব ফার্ণের বংশ বিস্তার কোন অবস্থাতেই রোধ করা উচিৎ নয় কেননা এরা আমাদের নিরব বন্ধু যাদের কোন চাহিদা নেই কিন্তু ওদের কাছে আমাদের চাহিদা অনেক।
সতর্কতাঃ হার্বাল সহ যে কোন ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।
ছবির বিষয়বস্তুঃ
এক নং ছবিতে গাছের কান্ডে আশ্রিত Drynaria quercifolia ফার্ণ। দুই নং ছবিতে ফার্ণের পাতার নিন্মতলে সোরাস দেখানো হয়েছে। তিন নং ছবিতে ফার্ণের জীবন চক্র
দেখানো হয়েছে। চার নং ছবিতে ফার্ণের প্রোথেলাস দেখানো হয়েছে। পাঁচ নং ছবিতে ফার্ণের প্রোথেলাস থেকে নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেখানো হয়েছে। ছয় নং ছবিতে পাথরের উপর জন্ম নেয়া ফার্ণের শুকনা পাতা যা দিয়ে ছেলেবেলায় আমরা চিলা ঘুড়ি বানাতাম।
সময় স্বল্পতায় যেহেতু ফিল্ড ওয়ার্ক করা সম্ভব হয়নি তাই সব ক’টি ছবি গুগলের সৌজন্যে এই প্রবন্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।