পাথরকুচির অভিমান

লেখক- আজহারুল ইসলাম খান।

আজ ভোর বেলা হটাৎ আমার বন্ধু নিহার রঞ্জন সাহার ফোন, রিসিভ বাটনে চাপ দিতেই প্রথম জিজ্ঞাসা ছিলো কি করছিস বন্ধু? তারপর আর কোন ভনিতা না করেই পাথরকুচি নিয়ে কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করলো। আমিও কোন ভনিতা না করে তাঁকে কথা দিলাম,কারন পাথরকুচি অনাদরে অবহেলায় আস্তে আস্তে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন একদিন বেশী দুরে নেই আমাদের নতুন প্রজন্ম এই উদ্ভিদ আর চিনবেই না। আমাকে বিষয় নির্বাচন করে দেয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

বাচ্চাদের নাম রাখার সময় যেমন আমরা বইপত্র ঘেটে নামের সুন্দর অর্থ দেখে তারপর নাম রাখি ঠিক তেমনি কোন উদ্ভিদের নামকরনের সময় যে বিষয় গুলো বিবেচনা করা হয় তা হলো সেই উদ্ভিদের গন বা প্রজাতিতে প্রাপ্ত উপক্ষার,ফাইটোহরমোন,ক্যামিক্যাল,সর্বাধিক প্রাপ্তিস্থান,বাহ্যিক বৈশিস্ট,গবেষক বা আবিস্কারকের নাম ইত্যাদি।

সুধী পাঠক প্রথমে পাথরকুচি নামকরনের কারন বর্ননা করছি। একে বলা হয় “Mother of thousands” কারন একটি গাছের সবকয়টি পাতাকে যদি মাটির সংস্পর্শে নেয়া হয় তাহলে অগনিত চারা গাছের জন্ম নিবে যার পরিমান এক হাজারের কম হবে না। আর এই কনসেপ্ট থেকেই বাংলা নাম পাথরকুচি যেমন একটি পাথরকে কুচি কুচি করার পর অগনিত টুকরায় পরিনত হয় এই উদ্ভিদের পাতা মাটির সংস্পর্শ পেলেও অগনিত চারা গাছের জন্ম দেয়। এছাড়াও কেউ কেউ এর ভেষজ গুনের উপর ভিত্তি করে পাথরকুচি নামকরনের কারন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন পাথরকুচি পাতার রস নিয়মিত সেবন করলে মুত্রথলির পাথর ভেংগে পশ্রাবের সাথে বের হয়ে আসে তাই এর বাংলা নাম “পাথরকুচি”।

পাথরকুচি Bryophyllum গনভূক্ত একটি সপুস্পক উদ্ভিদ ও এই গনের উদ্ভিদে Bryophollenone,Bryophollone ও Bryophyllin নামক ক্যামিক্যাল বিদ্যমান থাকায় এই গনের নামকরন করা হয়েছে Bryophyllum. এছাড়াও একে Air plant, Cathedral bells, Life plant, Miracle leaf, Goethe plant ও Succulent plant বলা হয়। পাথরকুচির কিছু প্রজাতির ফুল দেখতে গির্জার ঘন্টার মত তাই একে Cathedral bells বলা হয়। এছাড়া এর ঔষধি গুনাগুনের উপর ভিত্তি করেই সম্ভবত একে লাইফ প্লান্ট বা মিরাকেল লিফ বলা হয়। পাথরকুচির পাতা পুরু ও রসালো তাই একে Succulent plant বলা হয়।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে পাথরকুচি পাতার কিনারা থেকে কেন নতুন গাছের জন্ম(vegetative reproduction)হয়(!) অন্য গাছের পাতা থেকে কেন হয় না। উত্তরটা এক কথায় দিলে বলতে হয় পাথরকুচির Natural Vegetative Propagation এর জন্য এর পাতার কিনারায় Epiphyllous Buds থাকে যা থেকে নতুন কান্ড ও শেকড় উৎপন্ন হয়। এর পাতা খুবই ক্ষুদ্র মূল (Tiny shoot buds) উৎপাদনে ও এর উন্নয়নে সাহায্য করে ও এই Shoot গুলি মুল পত্র (Original leaf)থেকে ভেংগে আলাদা হয়ে যায় ও মাটির সংস্পর্শে এসে মুল গজায় নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। এখানে সাইটোকাইনিন(Cytokinins)নামক প্লান্ট হরমোন পাতার কিনারায় জমা হয়ে কোষ বিভাজনকে(Cell division) উদ্দিপ্ত করে ফলে এই জাতিয় সুবিধাভোগী মুল উৎপন্ন হয়।

পাথরকুচিতে প্রাপ্ত উপক্ষার ও ফাইটোক্যামিক্যালের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ। যেমনঃ Arachidic Acid, Astragalin,Behenic acid,Beta amyrin, Benzenoids, Bersaldegenin, Beta-sitosterol,Bryophollenone,Bryophollone, Bryophyllin, Bufadienolide orthoacetate, Caffeic acid, Ferulic acid, Quercetin, Steroids and Taraxerol.

রোগ প্রতিরোধে পাথরকুচির পাতা অতুলনীয়। দীর্ঘদিন যারা সর্দি-কাশিতে ভুগছেন, তারা পাথরকুচি পাতার রস গরম করে খেলে উপকার পাবেন। মূত্র রোগ প্রতিরোধে পাতার রস খেতে পারেন। মূত্রনালির যে কোনো সংক্রমণে, পেট ফাঁপায়, শিশুদের পেটব্যথা ও মৃগী রোগীদের পাথরকুচির রস খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। নিয়মিত পাথরকুচি পাতার রস খেলে মূত্রথলির পাথর দূর হয়। এ ছাড়া ব্রণ, ক্ষত ও মাংসপেশী থেঁতলে গেলে পাথরকুচির পাতা থেঁতলে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। বিষাক্ত পোকা কামড়ালে এ পাতার রস আগুনে সেঁকে লাগালে উপকার হয়। পাথরকুচি পাতার রস নিয়মিত খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল আলম খান তাঁর গবেষনায় প্রমান করেছেন পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। জনমনে প্রশ্ন জাগবে এটা কিভাবে সম্ভব? যে গাছটি যেখানে-সেখানে হয়, যার জন্য নেই কোনো আদর-যত্ন, সেই গাছ আবার বিদ্যুৎ দেবে? অলৌকিক এক গাছ পাথরকুচি। এক কেজি পাথরকুচি পাতা থেকে ২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। পাশাপাশি একই পরিমাণ পাথরকুচি দিয়ে নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব কয়েক বছর। এক একর জমিতে উৎপন্ন পাথরকুচি পাতা থেকে বছরে প্রায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে।পাথরকুচিদিয়ে তৈরিকৃত মণ্ডটি আয়রন ও ক্লোরিনসমৃদ্ধ থাকে। এ দু’টি উপাদানের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় ডিসি বিদ্যুৎ। একে কনভার্টার দিয়ে এসিতে রূপান্তরিত করে বাতি ও পাখা চালানো সম্ভব। এক কেজি পাথরকুচিতে উৎপাদিত ২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ দিয়ে এলইডি ল্যাম্প ও পাখা চালানো সম্ভব।

পাথরকুচি পাতা দিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানকল্পে এ প্রযুক্তি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ দের ভাবা উচিৎ,কেননা বাংলাদেশে এই উদ্ভিদ অযত্নে অবহেলায় জন্মে সুতরাং এর উৎপাদন খরচও কম হবে। পাথরকুচি সত্যিই মিরাকেল উদ্ভিদ যা আমাদের গ্রাম প্রধান দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে অপার সম্ভাবনা। সুতরাং এখনই সময় অভিমান ভাংগিয়ে একে সংরক্ষন করা।

সতর্কীকরণঃ যে কোনো ভেষজ ঔষধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
Epiphyllous buds– Is growing on, or attached to the leaf or another plant.