সাগর কিংবা নদীর তীর এমনকি অনেকসময় অনেক পুকুর পাড়ে মাথা তুলে রাখা অবস্থায় কিংবা কোন উঁচু স্থানে এদের দেখা মেলে, আবার মাঝে মাঝে ডাঙাতেও এরা চোখে পড়ে। সাধারণ মানুষের ভাষায় এরা সবাইই কচ্ছপ বা কাছিম বলে পরিচিত হলেও বই-পুস্তকের ভাষাতে, যারা পানিতে বাস করে তাদেরকে কাছিম, স্থলে বাস করলে কচ্ছপ এবং যারা ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে বাস করে তাদেরকে টেরাপিন বলে। কাছিমের পায়ের আঙ্গুলগুলোর মাঝে বুনট চামড়ার জাল থাকে কিন্তু কচ্ছপের এরকম থাকে না যার কারণে কচ্ছপ মাটিতে হাঁটতে পারলেও কাছিম পারেনা।
একসময় সমগ্র পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির দেখা মিললেও নানান কারণে এদের সংখ্যা লক্ষণীয় হারে কমে যাচ্ছে। যখনই কোন প্রাণী সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে এবং অনেক কিছু করেও তাদের সংখ্যা আগের মতোন ধরে রাখা সম্ভব হয় না কিংবা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে তাদের নামানুসারে একটা দিবস ঘোষণা করা হয়। ঠিক এভাবেই মূলত সামুদ্রিক কাছিমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার কারনে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। ২৩শে মে ‘বিশ্ব কাছিম দিবস’ হিসাবে পরিচিত। মূলত জীববৈচিত্র বজায় রাখার গুরুত্ব ও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেই ২০০০ সালে ‘অ্যামেরিকান কচ্ছপ উদ্ধার’ নামক প্রতিষ্ঠান এই দিবসের সূচনা করেন। তখন থেকেই সারা পৃথিবীজুড়ে এই দিবস পালিত হচ্ছে।
আসুন সামুদ্রিক কাছিম সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাকঃ
পৃথিবীর প্রায় সকল সমুদ্রেই এদের বিস্তৃতি রয়েছে এবং এরা বাসা বানানোর জন্য সাধারণত তুলনামূলক উষ্ম অঞ্চল পছন্দ করে। খাবার গ্রহণ, বিপরীত লিংগের সাথে মিলন থেকে শুরু করে সকল আনুষঙ্গিক কাজই সাগরে করলেও ডিম পাড়ার সময়ে স্ত্রী কাছিমকে দ্বীপে আসতেই হয়। এরা ডিম পাড়ার সময়ে খুব নির্জন স্থান বেছে নেয় এবং যদি সেখানে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে তাহলে সাথে সাথে ডিম পাড়া বন্ধ করে মা কাছিম আবার সাগরে ফেরত চলে যায়।
ডিম পাড়ার সময় বালিতে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং শেষ হবার সাথে সাথে বালি দিয়ে ঢেকে দেয় যাতে করে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সাথে সাথেই বাচ্চাগুলো আবার সাগরে চলে যেতে পারে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার জন্য মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। কুমিরের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার সামান্য হেরফের হলে লিঙ্গের রূপান্তর অর্থাৎ পুরুষ থেকে স্ত্রী কিংবা স্ত্রী থেকে পুরুষ হলেও এদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা পরিলক্ষিত হয়না। গড়ে ৬০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে বাচ্চাগুলো সাগরে পাড়ি জমায়। বলে রাখা ভাল যে, পুরুষ কাছিম একবার ডিম ফুটে গভীর সাগরে চলে যাওয়ার পরে আর কখনো দ্বীপে ফেরত আসেনা, সমগ্র জীবনচক্র তার সাগরেই কেটে যায়।
সমগ্র পৃথিবীতে মাত্র সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমের দেখা মেলে এর মধ্যে চার প্রজাতিকেই দুস্প্রাপ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই সাত প্রজাতির মধ্যে Leatherback Sea Turtle আকারের দিক থেকে সবথেকে বড়। এদের সামনের ফ্লিপারটি লম্বায় প্রায় নয় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। অন্যান্য সবার পিঠের অংশ শক্ত খোলস দিয়ে আবৃত থাকলেও এদের ক্ষেত্রে সেটা তৈলাক্ত মাংসল অংশ দিয়ে গঠিত হবার কারণেই এরকম নামকরণ। প্রজাতিভেদে এদের দেশান্তর হবার বৈশিষ্ঠের অনেক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। Green Sea Turtle যেখানে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে প্রায় ১৩০০ মাইল পথ পাড়ি জমায় সেখানে স্ত্রী Leatherback Sea Turtle প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে প্রায় ১২০০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়।
প্রজাতিভেদে এদের গড় আয়ু ৫০ বছর। এসব সামুদ্রিক কাছিমের খাবারের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন রকমের সামুদ্রিক আগাছা কিংবা বিভিন্ন সামুদ্রিক গাছ অপরদিকে কিছু প্রজাতি ছোট স্কুইড কিংবা মাছও শিকার করে থাকে।
জেনে রাখা ভাল যে, এরা যেই ডিম পাড়ে তা থেকে প্রায় সব ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেও তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক সদস্যই পরিণত অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে। এর পেছনে প্রধান কারণ ঐসব বাচ্ছা কাছিমগুলোর শারীরিক অক্ষমতা নয় বরং জলবায়ুর পরিবর্তন, উচ্চ অর্থ লোভের কারণে অনৈতিকভাবে খোলস বিক্রির বাণিজ্য, মাংসের চাহিদা থাকার কারণে নানান দেশে রপ্তানি, সাগরের মাঝে মাঝে জাল দিয়ে মাছ চাষ, বাসস্থান ধ্বংস, তৈলাক্ত পানি এবং নানাবিধ কারণ।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাচ্চা কাছিমগুলো বাইরের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা যার কারণে অনেক সদস্যই মারা পড়ে। টাকার লোভে অনেক চোরাচালানকারী কাছিমগুলোকে ধরে খোলস ছিড়ে এদের ফেলে দেয় যার কারণে প্রচন্ড কষ্ট পেতে পেতে এরা ধীরে ধীড়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। আবার পৃথিবীর অনেক দেশেই এদের মাংস খাওয়া হয় যার কারণে নির্বিচারে এদের ধরা হয় এবং মেরে ফেলে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আবার উপকূলীয় জেলে যারা সাগরে মাছ ধরেন তাঁরা মাঝে মাঝেই বড় বড় জাল দিয়ে রাখেন যার কারনে ঐসব বাচ্চা কাছিমগুলো আর গভীর সাগরে যেতে পারেনা এবং এখানেই মারা যায়। ঐসব জেলে জাল ওঠানোর পড়ে মাছ বা প্রয়োজনীয় সবকিছু রেখে কাছিমগুলোকে বালির মধ্যেই ফেলে দেয়। কিন্তু কচ্ছপের মতোন এদের শক্তিশালী পা না থাকার কারণে এরা হেটে পানি পর্যন্ত যেতে পারেনা।
এভাবেই প্রতিনিয়ত বিশ্বের নানান প্রান্তে হাজার হাজার সামুদ্রিক কাছিম মারা যাচ্ছে অথচ তাদেরকে বাচানো গেলেও বেশিরভাগ লোকই ঐসব না চিন্তা করে শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে নির্বিচারে নিধন করে চলেছে। এমন সোনার ডিমের আশাতেই যদি সবাই জীববৈচিত্রের কথা না ভেবে নির্বিচারে প্রকৃতির নানান প্রজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে থাকে তাহলে সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন পৃথিবীতে একটা মানুষও অবশিষ্ট থাকবে না।