কী ফুল ঝরিল
শেখরের একটি ফটো আছে – কাঁধে ক্যামেরা, মাথায় টুপি, তাতে বসা বসন্তবাউরির ছানা। মিরপুর বোটানিক গার্ডেনে ওটি কুড়িয়ে পেয়েছি। বাঁচাতে পারেনি। একটি রবাহুত চড়ূইছানাও পুষেছিল অনেক দিন। এসব নিয়ে তার লেখা আমরা পড়েছি। প্রথম আলো দৈনিকের পাঠকেরা তাকে ভালোই চেনেন। পত্রিকার শেষ পাতায় বেরোত ফুল, প্রজাপতি নিয়ে তার লেখা।
আমার সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৫ সালে। এটি অনিবার্য ছিল, কেননা শেখর নটর ডেম কলেজে পড়েছে, সেখানকার নিসর্গী অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে প্রকৃতির পাঠ নিয়েছে এবং তাঁর ‘ন্যাচর ষ্টাডি ক্লাবে’ ক্যামেরার তালিম পেয়েছে। আমিও একসময় ওই কলেজে অধ্যাপনা করেছি, মিজানুর রহমান আপনজন, প্রবাসে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
শেখর প্রায়ই সকালবেলা আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় হুট করে হাজির হতো, বলত – চলেন স্যার পার্কে, ছবি তুলব। যেতাম তার সঙ্গে, ফুলের ডাল ধরে দাঁড়াতে হতো নানা ঢঙে, তা-ও অনেকক্ষণ অনড় হয়ে। ভারি খুঁতখুঁতে আলোবচিত্রী ছিল সে। ছবি তুলতে তুলতে শেখর লেখক হয়ে গেল। পড়েছিল প্রাণিবিদ্যা, গাছপালার চেয়ে অধিক আকৃষ্ট ছিল প্রাণিজগতে, হতে চেয়েছিল বিহঙ্গবিদ, চলেও গিয়েছিল মুম্বাই, সালিম আলীর জীব-ইতিহাস ইনস্টিটিউটে। কিন্তু, স্বপ্ন আর সফল হয়নি, যেমনটি হয় না অনেকের জীবনে।
কিছুদিন বেকার থাকার পর সে চাকরি পেল সরকারি ব্যাংকে। অবশ্যই লোভনীয়, কিন্তু তার জন্য হলো বড় এক বিড়ম্বনা। বনবাদাড় ছেড়ে আটকা পড়ে গেল চার দেয়ালের বানিজ্যিক ফাটকে। চাকরিটা ছাড়তে চাইত, বকাঝকা করে থামাতাম। এক সময় নিজেই একটা সমঝোতা খুঁজে পেল। কর্মস্থল নবীগঞ্জ থেকে ছুটির দিনে চলে যেত হবিগঞ্জে, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারে; ঘরে বেড়াত হাওর-বাঁওড়, বনজঙ্গল, জুটিয়ে নিয়েছিল প্রকৃতিপ্রেমী বন্ধুবান্ধব। ঢাকা এলে ছুটে আসত সিদ্ধেশ্বরী, যেতাম রমনা পার্কে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, কার্জন হলের বোটানিক গার্ডেনে। সে ছবি তুলত, আমি এগুলোর সঙ্গে জড়িত স্মৃতিকথা শোনাতাম। মাঝেমধ্যে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানেও যাওয়া হতো। প্রকৃতিবিষয়ক বিদেশি বই কিনত শেখর তার জন্য, আর কিশোরপাঠ্য বই ভাগনেদের জন্য।
একসময় বদলি হয়ে সে ঢাকা আসে, বিয়ে করে এবং অচিরেই জীবনের তিনটি শ্রেষ্ঠ কর্তব্য – অন্তত একটি সন্তান, একটি বৃক্ষ রোপণ ও একটি বই লেখা শেষ করল। ছেলেটি হাঁটতে শিখতেই তাকে নিয়ে ঘুরতে লাগল পার্কে, পাখি ও প্রজাপতি মেলায়, বইয়ের দোকানে। ‘তরুপল্লব’ সংস্থার অন্যতম সংগঠক ছিল শেখর, গাছ চেনার অনুষ্ঠানে নিয়মিত হাজির থাকত ছেলেকে নিয়ে।
হঠাৎ করেই শেখর কর্কট রোগে আক্রান্ত হলো। প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ ও খাদ্যে ভেজালের দরুন রোগটি এখন বহুব্যাপ্ত। অনেক সময় ভাবি, অতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারের জন্যই কি তার মস্তিষ্কে টিউমারের এ প্রকোপ? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন সতর্কবার্তা আছে। যাহোক, দেশ-বিদেশে চিকিৎসার ফলে কিছুটা সেরে উঠেছিল সে, কাজে যেতে শুরু করেছিল এবং কোনো কোনো অনুষ্ঠানেও।
আমাদের শেষ দেখা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের প্রজাপতি মেলায়। সঙ্গে ক’জন বন্ধুবান্ধব, বেশ হাসিখুশি। ভেবেছি সম্পূর্ণ আরোগ্য না হলেও এভাবেই চলতে পারবে অনেক দিন। কিন্তু কর্কট এক কুটিল হন্তারক। আমাদের সব আশার বিলুপ্তি ঘটাল অকস্মাৎ। ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’।
শেখর দিনাজপুর থেকে আমাকে একটি বুনো লতা এনে দিয়েছিল কয়েক বছর আগে। ফুল ফোটে সারা বছর। তার মৃত্যুদিনেও ফুলে ফুলে সাদা হয়ে ছিল। সেদিকে তাকিয়ে ভেবেছি, মানুষের প্রতি প্রকৃতির কী অপার ঔদাস্য, অথচ আমরা তাকে ভালোবাসি। তাই কবির অন্তিম নিবেদন –
‘হে উদাসীন প্রথিবী
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি’।
-দ্বিজেন সর্মা
(সূত্র: ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ৬৮৭, শনিবার, ৮ জুন, ২০১৩ খ্রী.; ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২০ বং.)