শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণিদের জীবনধারা (প্রথম ভাগ)
প্রাণি মাত্রই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নানান ধরণের রঙ, আকার, আচরণ সবই এক কথায় যে কাওকেই নিমেষেই বিস্ময়ের রাজ্য থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারে। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে আপনাদের সামনে এই আকর্ষণীয় প্রাণিদের এমন দুই গ্রুপের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট উপস্থাপন করবো যার বেশীরভাগই হবে আপনাদের অজানা… এই দুই গ্রুপ হচ্ছে উভচর ও সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণি।
উভচর ও সরীসৃপ প্রাণিদেরকে অন্যান্য সব গ্রুপের প্রাণিদের থেকে অনেক কারণেই আলাদা করা যায়। প্রধান কারণ হচ্ছে, উভচর শ্রেণির প্রাণিদের নরম, গ্রন্থিময় ত্বক আর সরিসৃপ শ্রেণির প্রাণিদের খসখসে আইশযুক্ত ত্বক, এই বৈশিষ্টগুলো আমাদের সকলেরই জানা কিন্তু এদের আরো এমন কিছু বৈশিষ্ট আছে যা তাদেরকে অন্য সব গ্রুপ থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। এরা তীব্র বিষাক্ত, অদ্ভুত মায়াময় এবং খুবই অভিজাত যার কারণে অতি সহজেই এরা যে কারোর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। শিকার ধরতে এবং নিজেদেরকে অন্যের হাত থেকে রক্ষা করতে এরা সুপটু, খুবই দ্রুত দৌড়াতে পারে এবং অনেক আকর্ষণীয় উপায়ে নিজেদের মধ্যে শক্তির লড়ায় করতে পারে।
কিছু সদস্য অদ্ভুত সুন্দর রঙে সজ্জিত এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে, কেও নানান ভাবে ডাকে আবার কেও নানান ইঙ্গিত প্রদর্শন করে। এদের আবাস কোন নির্দিষ্ট স্থানে নয় বরং খুব দ্রুত এরা নিজেদের আবাসের পরিবর্তন আনে এবং শক্তি সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পূর্ণ অন্যরকম, এরা সূর্যরশ্মি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। শীতল রক্তবিশিষ্ট হলেও বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি এরা অনেক উষ্মপ্রকৃতির হয়ে থাকে যার প্রমাণ মেলে সন্তান ও স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার মাধ্যমে।
গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপের নাম শোনেনি এমন কাওকে খুঁজে পাওয়া ভার! আর এই দ্বীপের একটি প্রধান উল্লেখযোগ্য প্রাণিদের গ্রুপ হচ্ছে সরীসৃপ প্রাণি। এরা খুবই কৌশলের সাথে সূর্যরশ্মির সাহায্যে নির্দিষ্ট সময় পরপর শরীরের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। সামুদ্রিক ইগুয়ানা এমনই এক সরীসৃপ যারা কিনা প্রতিদিন এরকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। রাতের বেলাতে এদের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় যার কারণে এরা কোন কাজ করতে পারেনা তাই সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথেই এরা নিজেদেরকে গরম করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার এদের গায়ের ত্বকের রঙও কালো যার কারণে এরা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী তাপ শোষণ করে রাখতে পারে। অতিবেগুনী রশ্মি সম্বলিত ক্যামেরার সাহায্যে দেখলে তাপ শোষণের সাথে সাথে এদের ত্বকের পরিবর্তনের মাত্রা বোঝা যায় যা কিনা খালি চোখে বোঝা অসম্ভব। তাপ গ্রহণের পূর্বে এরা গাঢ় বেগুণি থাকে এবং তাপ গ্রহণের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে এদের গায়ের রঙ আস্তে আস্তে সোনালী হতে থাকে। এরা আমাদের মতোনই শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে এবং সূর্যের নীচে প্রায় আধাঘন্টা থাকার পরে এদের শরীরের তাপমাত্রা এদের নীচে অবস্থির গরম পাথরের মতোনই হয়ে পড়ে।
এরপরে এদের খাবারের প্রয়োজন হয় কিন্তু এই পাথরময় দ্বীপে এদের খাবারের উপযোগী রয়েছে একমাত্র সামুদ্রিক আগাছা যা কিনা সাগরের তলদেশে বিস্তৃত। এখানকার সাগরের পানির তাপমাত্রা প্রায় ১৫-১৬ সেন্টিগ্রেড এজন্য আকারে ছোট ইগুয়ানার পক্ষে এই পানিতে নামা অসম্ভবের কাছাকাছি কারণ তারা তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারেনা। আবার দ্বীপ তীরবর্তী অঞ্চলে ভাল খাবার পাওয়া যায়না যার কারণে এদের কমপক্ষে ৫মিটার গভীরতায় যাবার প্রয়োজন পড়ে। এই গভীরতায় যাবার পরে এরা এদের হাত-পায়ের রক্ত চলাচল বন্ধ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেস্টা করলেও কিছু সময়ের মধ্যেই এদের শরীরের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রীর কাছাকাছি হয়ে যায়, মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রানিদের ক্ষেত্রে এমন অবস্থায় মৃত্যু অবধারিত। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই এদেরকে তীরে ফিরে আসতে হয় এবং তখন তারা আবার খাবার পরিপাক ও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য রোদ পোহাতে থাকে। শেষ বিকেলের দিকে রোদের তীব্রতা কমে যাওয়ায় শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনা এ জন্য পরদিন সকাল পর্যন্ত এদেরকে না খেয়ে থাকতে হয়!
ক্যালিফোর্নিয়ার Side Blotched Lizard ও একইভাবে রোদ পোহানোর মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। আমরা খাবার গ্রহনের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম হলেও এরা এরকম সুযোগ পায়না যার কারনে গরম পাথরের ওপরে বসে থেকে এরা দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে চেস্টা করে। কোন পুরুষ সদস্যের পাথর বেশী গরম সেটা দেখে স্ত্রীসদস্যেরা মিলনসংগী খুঁজে নেয় যার কারনে কে কোন পাথরে বসবে সেটার জন্য একাধিক পুরুষ সদস্যের মধ্যে লড়াই হয় এবং বিজয়ী সদস্য আবার সেই গরম পাথরের ওপরে ফিরে আসে। এদের এই গরম পাথরের ওপরে বসে থাকাকে অনেকেই অবান্তর ভেবে ভূল করে বসতে পারেন, এদের এরকম করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আশেপাশের ঘাসযুক্ত অঞ্চল অপেক্ষা এইসব পাথর অনেক তাড়াতাড়ি বেশী গরম হয়ে পড়ে এবং তাপ বিকিরণ করতে থাকে যার কারণে এইসব গিরগিটি শ্রেণির প্রাণিদের অনেক সুবিধা হয়। যদি কৃত্রিমভাবে আশেপাশে কোথাও একটার ওপর আরেকটা পাথর বসিয়ে উঁচু স্থান তৈরী করা হয় তাহলে পুরুষ সদস্য যেয়ে ঐ স্থান দখল করবে। এভাবেই এদের কতৃত্ত প্রকাশ পায়।
মেডিটেরিয়ান অঞ্চলে আরেক ধরণের গিরগিটি পাওয়া যায়, এদের রোদ পোহানোর পদ্ধতিও আরেকরকম। এরা এদের চারপাশের পরিবেশকে বুঝতে তার স্বাদ গ্রহণ করে। এখানে এক ধরণের ফুল পাওয়া যায় যার গন্ধ অনেক উৎকট। এরকম গন্ধ এক ধরণের রাসায়নিক নিঃসরণের জন্য দায়ী। এরকম রাসায়নিক নিঃসরণের কারণে এদের ফুলের পাপড়ির তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের তুলনায় অনেক বেশী হয়ে থাকে যার কারণে এই গিরগিটিগুলো এই ফুলের পাপড়িতে অবস্থান করে। এসব ফুলের পাপড়ির মাঝখানে সরু অঞ্চল থাকে, মধু খোজার জন্য যদি কোন মাছি এসে আটকা পড়ে তাহলে এরা ঐ মাছিকে শিকার করে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এসব ফুলের গাছগুলোতে ফল ধরে তখন এইসব ফল এসব প্রাণিদের প্রিয় খাদ্য হয়ে যায় যদিও ১৫-২০ বছর পূর্বে এরা এসব ফল হতে দূরে থাকতেই পছন্দ করত। এসব ফলের চারপাশে আবরণ থাকার কারণে এই গিরগিটিগুলোর কাছে আগে এগুলো আকর্ষণের বস্তু ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে এরা আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকার কারণে এদের বিস্তৃতির পেছনেও এসব গিরগিটির যথেস্ট অবদান রয়েছে। এসব গিরগিটির কারণেই আজ এই ফলের গাছ সমস্ত উপকূল জুড়ে ছেয়ে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলবর্তী উইন্ডসব্যাক দ্বীপ সরীসৃপদের জন্য উপযুক্ত না হলেও কচ্ছপদের জন্য স্বর্গরাজ্য। এই ছোট দ্বীপে প্রায় ৫০০০ কচ্ছপের আবাস। দিনের প্রথমভাগে এরা কিছু সময় রোদ পোহায় এবং পরে খাবারের জন্য বের হয়। দিনের মাঝামাঝিতে যখন তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায় তখন অতিরিক্ত তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য এরা ছোট ছোট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে আশ্রয় নেয়। বিকালের দিকে যখন তাপমাত্রা আবার কমে যায় তখন এরা আবার বের হয়, ততোক্ষণে এদের খাবার হজম হয়ে যায়। মাঝেমাঝে একাধিক পুরুষ সদস্যের মধ্যে শক্তির পরীক্ষা হয়, এদের প্লাস্ট্রনের সামনের দিকে এক ধরণের বর্ধিত অংশ থাকে যা দ্বারা এরা প্রতিপক্ষকে আঘাত করে। এই লড়াই প্রায় আধা ঘন্টা স্থায়ী হয়, যে জেতে সে স্ত্রী সদস্যের সাথে মিলনে অংশ নেয়।
অ্যামেরিকার আরাইজোনাতে এক ধরণের Regal Horned Lizard পাওয়া যায় যারা কিনা দিনের বেলাতে তাদের শরীরের গলা পর্যন্ত অংশ মাটির নীচে ও শুধু মাথা বাইরে রেখে রোদ পোহাতে থাকে। মাথা বাইরে থাকার কারণে মাথার ধমনীগুলো প্রথমে গরম হয় এবং এখানকার রক্ত গরম হয়, পরবর্তীতে এই গরম রক্ত সারা শরীরে প্রবাহিত হয় ও শরীরের অন্যান্য অংশকে গরম করে। ঘাড়ের পেছনদিকে অনেকগুলো স্পাইক থাকে যেগুলো কিনা মুকুটের মতোন থাকে যার কারণেই এদের এরকম নামকরণ।
দক্ষিণ আফ্রিকার Armadilo Lizard এর রোদ পোহানোর পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, এরা সমগ্র পরিবারের সাথে করে পাথরের ওপরে বসে শরীর গরম করে। তখন এদের একেকজনের চোখ থাকে একেকদিকে যাতে করে সহজেই শত্রুর আগমণ লক্ষ্য করা যায়! এরা পরিবারের সবাই একত্রে পাথরের খাঁজের মধ্যে বাস করে। যখনি কোন শিকারি প্রাণিকে দেখে কোন সদস্য বুঝতে পারে তখন সবাই একত্রে পাথরের খাঁজের ভেতরে চলে যায়। যদি শিকারি প্রাণিটি খুব বেশী দ্রুততার সাথে আসতে পারে তাহলে তারা এদের শিকার করতে পারে যদিও আপত্তিকর কিছুর সংস্পর্শে আসলেই এরা এদের লেজ কামড়ে ধরে ফলে এদের শরীরের তীক্ষ্ণ আইশগুলো চারপাশে থাকে ফলে এদেরকে গলাধকরণ করা সম্ভব হয়না। নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত এরা এরকম করেই থাকে।
সূর্যাস্তের সাথে সাথে বেশীরভাগ সরীসৃপেরই কার্যকলাপের ইতি ঘটে কিন্তু এখানেও ব্যতিক্রম আছে। গেকোর বেশিরভাগ প্রজাতিই নিশাচর এর মধ্যে Leopard Gecko বিশেষ ধরণের, এরা বালি থেকে তাপ শোষণ করে শরীরে ধরে রাখে এবং এভাবে সূর্যাস্তেরও প্রায় ২-৩ ঘন্টা পর পর্যন্ত তাপ ধরে রাখতে পারে। এদের পুরুষ সদস্য স্ত্রী সদস্য অপেক্ষা বেশী সুন্দর হয় এবং স্ত্রী সদস্যকে দেখা মাত্রই এরা জিহ্বা বের করে বাতাসের স্বাদ গ্রহণ করে এরা বুঝতে পারে যে ঐ স্ত্রী সদস্য মিলনে আগ্রহী কিনা!! পুরুষ সদস্যও যদি মিলনে আগ্রহী হয়ে থাকে তাহলে লেজ নাড়া দিয়ে জানান দেয় এবং স্ত্রী সদস্যের কাছে যেয়ে ঘাড়ে কামড় দেয় এবং মিলনে অংশ নেয়। পরবর্তীরে ঐ স্ত্রী সদস্য ডিম পাড়তে যায়, এরা গরম বালির মধ্যে ডিম পাড়ে। এরা কিন্তু গরম রক্তবিশিষ্ট প্রাণিদের মতোন ডিমে তা দেয় না। ঐ ডিমকে এমন তাপমাত্রায় রাখতে হয় যাতে করে শরীরের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য থাকে! কিছুদিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সব থেকে মজার বিষয় হচ্ছে, সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা নির্ভর করে পরিবেশের তাপমাত্রার ওপরে।
কুমিরের ক্ষেত্রেও বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে হবে সেইটা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপরে নির্ভর করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পরে বাচ্চার ডাকে মা ঘড়িয়াল সন্তানকে পথ দেখিয়ে পানিতে নিয়ে আসে। এই পুকুর জাতীয় স্থান এসব বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত স্থান। অন্যান্য কুমির সদস্যদের মতন এরাও নির্বিঘ্নে রাত্রে শিকার করতে পারে।
রাত্রের বেলায় সক্রিয় থাকা সরীসৃপ শ্রেণির সদস্যদের বেলায় অনেক কম দেখা গেলেও উভচর শ্রেণির প্রাণিদের ক্ষেত্রে এটা একটি সাধারণ দিক। আবার সরীসৃপদের মতন এদের ত্বক নয় যার কারণে এরা যদি রোদ পোহাতে যায় তাহলে ত্বক শুকিয়ে এরা মারা যাবে যার কারণে বেশীরভাগ ব্যাঙ রাতের বেলাতেই সক্রিয় থাকে। এরা এদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশ থেকে গ্রহণ করে কিংবা শরীরের চর্বি থেকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ব্যাঙও পাওয়া যায় যারা কিনা রোদ পোহাতে ভালবাসে!
South American Waxy Monkey Frog এই ব্যতিক্রমের তালিকায় পড়ে। এদের রোদ পোহানোর পেছনেও কারণ রয়েছে। অনবরত এদের ঘাড় থেকে তরল পদার্থের নিঃসরণের কারণেই এরা ত্বক ঠিক রাখতে পারে এবং মারা যায়না। এরা ঐ তরল পদার্থ সারা শরীরে অনবরত মেখে নেয় যার কারনে রোদের হাত থেকে এদের শরীর রক্ষা পায়। এদের এরকম রোদ পোহানোর পেছনে আরো এক ধরণের সুবিধা রয়েছে, রোদে থাকার কারণে অন্যান্য উভচরদের মতন এদের ছত্রাকের আক্রমণে কোন রোগের শিকার হতে হয়না।
মধ্য অ্যামেরিকার বনগুলোতে বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী যার কারণে এখানে বসবাসকারী Poison Arrow Frog এর জন্য অবস্থা কিছুটা প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এরা রোদে কিছু সময় থাকে আবার বড় পাতার নীচে চলে যায়, আবার রোদে আসে আবার পাতার নীচে চলে যায়, এভাবেই এরা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই সূর্যের আলো থেকে এরা শক্তি সঞ্চয় করে যার কারণে নিজেদের সীমানায় এরা অনবরত ডেকে চলে। আবার মাঝে মাঝে প্রতিবেশীর সাথে হাতাহাতি করতেও পিছপা হয়না। এই লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ এরা সম্পূর্ণরূপে ক্লান্ত না হয়ে পড়ে।
শিকারের সময়ে সাপের মতোন ধৈর্য মনেহয় আর কোন প্রাণির নেই। African Gigantic Python এমন এক ধরণের অজগর সাপ যারা কিনা সপ্তাহের পর সপ্তাহ শিকার ধরার আশায় এমনভাবে বসে থাকে যে হঠাত দেখলে মনে হবে যেন এদের নড়াচড়া করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে! শিকার কাছে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এরা এদের স্থান থেকে নড়ে না কিন্তু শিকার সীমার মধ্যে আসার সাথে সাথেই এরা আলোর গতিতে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে। শিকারকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরে যে আর দম নেবার ফুরসৎ মেলেনা যার কারণে কিছু সময়ের মধ্যেই মারা যায়। এরা সাধারণত বড় বড় স্তন্যপ্রায়ী প্রাণি শিকার করে যাদের শরীরের ব্যস তাদের মুখের তুলনায় কয়েক গুণ বড়! হয়তো অনেকেই ভাবছেন কিভাবে তারা এই খাবারকে গলাধঃকরণ করবে কারণ তাদেরতো হাত কিংবা পা কিছুই নেই! এদের ওপরের ও নীচের চোয়াল এক ধরণের লিগামেন্ট দ্বারা যুক্ত থাকে যা কিনা অনেক বেশী ইলাস্টিক ক্ষমতা সম্পন্ন, একারণে সহজেই এরা অনেক বড় শিকারকেও মুখে পুড়ে ফেলতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, এরা এতো বড় খারাপ হজম করবেই বা কি করে!! ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ খাবার গলাধঃকরণের পর এদের আর নড়ার শক্তি থাকেনা। এরা খোলা স্থানে সূর্যের আলোর নীচে পড়ে থাকে, তখন এদের পরিপাক হার প্রায় ৪০ গুণ বেড়ে যায়, যকৃত ২ গুণ এবং হৃৎপিণ্ড শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ বেড়ে যায়। সূর্যের আলোর সহায়তায় এদের ঐ খাবার পরিপাক হতে প্রায় এক সপ্তাহ এবং মাঝে মাঝে আরো বেশী সময় লাগে। এই খাবার পরিপাকের পরে এদের মাসের পর মাস এমনকি সারা বছরে আর না খেয়ে থাকলেও চলে।
North American Painted Turtle এক বিশেষ ধরণের কচ্ছপ। এরা যখন গর্তে ডিম পেরে আসে তখন আশেপাশে কোন খাবার থাকে না। তাই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পরে খাবার জন্য কিছুই খুঁজে পায়না আবার তখন শীতের প্রকোপ শুরু হয়ে যায়। এসময় তাপমাত্রা -১০ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায় ফলে এসব বাচ্চা কচ্ছপগুলোর চারপাশে এমনকি এদের শরীরের ভেতরেও প্রায় সবকিছু বরফ হয়ে যায়। কিন্তু এদের টিস্যুতে বরফের বিরুদ্ধে কাজ করার মতোন এক ধরণের উপাদান থাকে। ফলে এরা মারা যায়না, স্তন্যপায়ী প্রাণি কিংবা পাখিদের ক্ষেত্রে এরকম হলে তাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত হতো। এভাবে মৃতপ্রায় অবস্থায় এরা প্রায় ছয়মাস পর্যন্ত থাকে, এরপরে বসন্তের আগমন ঘটে এবং বরফ গলা শুরু হয়। তখন এদের শরীরের ভেতরকার এবং চারপাশের বরফ পানিতে পরিণত হয় এবং এদের ক্রিয়াশীল হতে কিছুটা সময় লাগে। ক্রিয়াশীল হবার পরেই এরা পরিণত অবস্থায় বাইরে বের হয়ে যায়।
অন্যতম বড় এবং শক্তিশালী সরীসৃপ হচ্ছে লবণাক্ত পানির কুমির, এরা খুবই আক্রমণাত্মক প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরা প্রায় ২০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। পুরুষ সদস্য স্ত্রী সদস্যের নিকটবর্তী হলে পানিতে বুদবুদ তৈরী করতে থাকে। স্ত্রী সদস্য আকারে পুরুষের তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ হয়ে থাকে, ইচ্ছা করলে পুরুষটি মুহূর্তের মধ্যেই স্ত্রীকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু এরা যখন মিলনের ইচ্ছা পোষণ করে তখন পুরুষ কুমিরটি খুবই আলতোভাবে স্ত্রী কুমিরকে জড়িয়ে ধরে রাখে, পিঠে আস্তে আঘাত করে খুবই যত্নের সাথে তার শরীরের ওপরে নিজের শরীর নিয়ে যায় এবং এইভাবেই তারা যৌন মিলনে অংশ নেয়।
কুমির হচ্ছে প্রাচীনতম সরীসৃপ, এদের প্রাচীন পুরুষের সূত্রপাত ঘটেছিল ডাইনোসর যুগের দিকেই। উত্তর অ্যামেরিকার পশ্চিম প্রান্তের পাথরে ডাইনোসরদের অনেক জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এমনকি এসব স্থানে পায়ের ছাপও পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এখনকার প্রাণিদের তুলনায় অনেক আগে প্রাপ্ত শীতলরক্তবিশিষ্ট প্রাণিগুলো শরীরের তাপমাত্রা অনেক সুন্দর উপায়ে ঠিক রাখতে পারত। এদের শরীর এখনাকার প্রাণিদের তুলনায় অনেক বড় হবার কারণে এরা অনেক বেশী সময় ধরে তাপ ধরে রাখতে পারতো এবং অনেক বেশী পরিশ্রম করতে পারত যার কারণে এরা প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বছর পৃথিবীর ওপর নিজেদের কতৃত্ত বজায় রাখতে পেরেছিল।
এমন অনেক সরীসৃপ পাওয়া যায় যারা কিনা শরীরের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে পারেনা। Leatherback Turtle, কুমিরের মতোন এদের আবির্ভাবও ডাইনোসরের যুগেই হয়েছিল। এরা আকারে সর্ববৃহৎ এবং সব থেকে বিস্তৃত সরীসৃপ সদস্য। সাগরের উষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে প্রায় জমে যাওয়া পানিতেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাগরপারে ডিম পাড়ার জন্য উঠে আসে। এরা এমন এক ধরণের প্রাণি যারা কিনা শরীরের শক্ত ক্যারাপেসের নীচে অবস্থিত চর্বি থেকে তাপ সৃষ্টি করতে পারে এভাবে এরা চারপাশের তাপমাত্রা থেকে প্রায় ৮ডিগ্রি সেন্ট্রিগেড তাপমাত্রা বেশী রাখতে পারে।
শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণিদের জীবনধারা (পর্ব-২)
শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণিদের জীবনধারা (পর্ব-৩)
লেখক পরিচিতি-
Shawan Chowdhury
Department Of Zoology
University of Dhaka
E-mail add- shawan_zl@yahoo.com
Interest- To be with nature
Facebook id: Shawan Chowdhury
(Search by using this e-mail,shawan1094061@yahoo.com)