সাক্ষাৎকার: প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন
প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী, বাংলাদেশে প্রাণিবিজ্ঞানীদের পুরোধা, প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন, বাংলাদেশের প্রবীনতম প্রাণিবিদদের অন্যতম। তিনি এদেশের বহু প্রাণিবিজ্ঞানীরই শিক্ষাগুরু এবং একাধারে ‘বন্যপ্রাণিতত্ত্ব’, ‘বাস্তুতত্ত্ব’ এবং ‘প্রাণিভূগোল’ বিশেষজ্ঞ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ‘বন্যপ্রাণিতত্ত্ব শাখা’র প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণিতত্ত্ব সমিতি’ এবং ‘বাংলাদেশ পাখি সংরক্ষণ সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। তিনি জাতীয় ‘বন্যপ্রাণি উপদেষ্টা বোর্ড’ এবং ‘ঢাকা চিড়িয়াখানা উপদেষ্টা বোর্ড’-এর সদস্য। এছাড়া তিনি ‘বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর’-এর প্রজেক্ট সাব-কমিটির চেয়ারম্যান এবং এর ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচিত সদস্য।
স্বনামধন্য এই পরিবেশবিদের জন্ম কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট থানার পাটোয়ার গ্রামে, ১ জানুয়ারি ১৯৩১ সনে। তিনি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র এবং পরবর্তীতে ১৯৫৩ সন থেকে এখানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুদীর্ঘ ৯ বছর তিনি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান পদটিকে অলংকৃত করেন এবং পরবর্তীতে ‘জীববিদ্যা অনুষদের’ ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা শীর্ষক তাঁর প্রনীত পাঠ্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক জার্নালে তাঁর প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সংখ্যা ৮০টিরও বেশী। দেশের ‘বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন’ এবং এসম্পর্কিত বহু সরকারী নীতিমালা প্রণয়নে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশী-বিদেশী বহু সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তিনি সভাপতিত্ব করেছেন; তাছাড়া এ দেশের প্রাচীন বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা যেমন – ‘বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতি’, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান সমিতি’ ইত্যাদির সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির’ প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং তিন বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৯৬ সনে তিনি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ’-এর তরফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পর্যবেক্ষণের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাছাড়া তাঁর ইংল্যান্ডে শিক্ষারত অবস্থায় তিনি ১৯৫৯ সনে ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের’ তরফ থেকে দক্ষিন আমেরিকার ‘ব্রিটিশ গায়ানায়’ পরিচালিত অভিযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে এযাবৎ ১৪ জন প্রাণিবিদ পি.এইচ.ডি. এবং ১০ জন এম.ফিল. ডিগ্রী লাভ করেছেন।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বরেন্য মনীষী UNEP-এর তরফ থেকে ‘পরিবেশ উন্নয়ণে’ বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন “Global 500 Roll of Honor Laureate” পুরষ্কার (১৯৯০), ‘বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির’ পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘Recognition Crest’ (১৯৯১) এবং ‘সিলভার জুবিলী গোল্ডমেডেল’ (১৯৯৭), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘স্বাধীনতা দিবস স্বর্ণপদক’ (১৯৯২), ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’-এর তরফ থেকে পেয়েছেন ‘রিসার্চ গাইড পুরষ্কার’ (১৯৯৩), বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘Distinguished Son of the Soil Crest’ (১৯৯৫) এবং বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার যুব সংস্থার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘Great Sons of the Soil Crest’ (১৯৯৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে পেয়েছেন ‘এলামনাই এসোসিয়েশন ক্রেস্ট’ (১৯৯৬), ‘N.C.C. Crest’ (২০০৩) এবং জীববিদ্যা বিষয়ক পুস্তক প্রণয়ণে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরষ্কার’ (২০০৫)।
বাংলাদেশের প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা ও শিক্ষার অগ্রদূত এ শিক্ষাগুরু সকলের শ্রদ্ধেয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস প্রফেসর কাজী জাকের হুসেন বিগত ২১ জুন, ২০১১, মঙ্গলবার বেলা ২:৩০মি.-এ লালমাটিয়ায় নিজ বাস ভবনে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ এমন এক বরেন্য গুণীজন হারিয়েছে, যা আর কোনদিন পুরণ হবার নয়।
আমরা নেচার স্টাডি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (NSSB)-এর পত্রিকা ‘নেচার স্টাডি’-এর পক্ষ থেকে স্বনামধন্য এ প্রাণিবিজ্ঞানীর মুখোমুখি হয়েছিলাম ২০০৬ সনে।
সাক্ষাৎকার ও চিত্রগ্রহণ করেছিল প্রয়াত শেখর রায় (৭/১/১৯৭০ – ১৩/২/২০১৩)। পাঠকদের সুবিধার্থে তাঁর ভাষ্য এখানে তুলে ধরা হল।
নেচার স্টাডি : আপনার ছেলেবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন। তখনকার পরিবেশ-প্রকৃতি কেমন ছিল ?
প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন : আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে। আর দশটি গ্রামের মতো সে গ্রামও ছিল ‘পাখি ডাকা – ছায়া ঢাকা’। যেসব গাছ ছায়া দিত সেগুলো ছিল, “আম-জাম-নারিকেল-সুপারি-কাঁঠাল, দাড়িম্ব-কমলালেবু-কামরাঙ্গা-তাল”। অর্থাৎ, সব ছিল একান্তই দেশী গাছ, তাই পরিবেশ ছিল একেবারে প্রাকৃতিক। এখনকার পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। শহরের মতো গ্রামেও এখন সরকার ও বিভিন্ন সূত্র থেকে বিতরণ করা হয় মেহগনি, ইউকেলিপ্টাস, এ্যাকাশিয়া, ইপিল-ইপিল, মিন্জিরি, রাজকড়ই, রেইনট্রি ইত্যাদি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির বা বাড়ির আঙ্গিনায় এখন এসব গাছ লাগানো হচ্ছে। এমনকি ক্ষেতের আইলেও দেখা যায় মেহগনি। বিদেশী গাছের কৃত্রিম পরিবেশে আমাদের জীবজন্তুও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে – এটাই বাস্তব।
নেচার স্টাডি : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : আমি ১৯৪৬ সালে চাঁদপুর ঘনিয়া হাই স্কুল থেকে এস.এস.সি. পাশ করি। ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি পাশ করি। তারপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. পাশ করি। তখন এখানে বি.এস.সি. পাশ কোর্স ছিল, অনার্স কোর্স ছিল না। আমি ছিলাম ফজলুল হক হলের ছাত্র। এরপর আমি ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে চলে যাই এবং ১৯৫৩ সালে ‘লাহোর গভঃ কলেজ’ থেকে এম.এস.সি. (প্রাণিবিদ্যা)-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হই। পড়াশোনা শেষ করে সে বছরই আমি দেশে চলে আসি। পরবর্তীতে জানতে পারি যে, সে বছরই এম.এস.সি.-তে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে ‘বেস্ট পারফর্মেন্স’-এর জন্য আমাকে ‘গোল্ড মেডেল’ দেওয়া হয়েছে। দেশে চলে আসায় সেটা হাতে হাতে গ্রহন করতে না পারলেও আমার কাছে তা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। লাহোর গভঃ কলেজ তখন ছিল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ কলেজগুলোর অন্যতম। পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য কলেজ থেকে আমাকে ‘একাডেমিক রোল অব অনার’ সূচক সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় ফিরে এসে সেবছরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করি। ১৯৫৪ সালে এখানে প্রাণিবিদ্যার আলাদা ডিপার্টমেন্ট খুলে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৫৬ সালে আমি অক্সফোর্ডে চলে যাই। সেখানে অর্নিথোলজিতে বি.এস.সি.-তে ভর্তি হই। তবে একটা ব্যাপার হল অক্সফোর্ডের বি.এস.সি. কিন্তু ‘পোস্ট গ্রাজুয়েট রিসার্চ ডিগ্রি’।
নেচার স্টাডি : আপনি ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে ‘আমাজন রেইন ফরেস্টে’ গিয়েছিলেন – এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : ১৯৬২ সালে আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এক্সপিডিশন সোসাইটির’ সঙ্গে আড়াই মাসের একটি এক্সপিডিশনে যাই। ‘চার্লস ডারউইনের সেন্টিনারি সেলিব্রেশন’ উপলক্ষ্যে এ এক্সপিডিশনের আয়োজন করা হয়। আমার সুপারভাইজার প্রফেসর ডঃ এ.জে. কেইন ছিলেন এ এক্সপিডিশনের দলনেতা। এক্সপিডিশন কমিটি ফরেনার হিসেবে আমাকে এতে যাবার অনুমতি দেয়। তবে আমাকে ১০০ পাউন্ড জমা দিতে বলে। এরকম একটি টিমের সঙ্গে এমন একটি জায়গায় যাবার সুযোগ পেয়েছি বলে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করলাম। কারণ, এ টিমটিতে ছিলেন ইউনিভার্সিটির বড় বড় সব বিজ্ঞানী। এক্সপিডিশনে যাবার যখন আর মাত্র ১৭ দিন বাকি তখন একদিন প্রফেসর কেইন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন টাকার কোন যোগাড় হল কিনা। আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললাম যে তা যোগাড় হয়নি। ‘আপনি বরং এক্সপিডিশন টিম থেকে আমার নামটা বাতিল করে দেন’। প্রফেসর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইয়াং ম্যান, ডোন্ট ওরি। আই হ্যাভ ম্যানেজড্ ফর ইউ – ইউ আর গোয়িং।’ আমি তখন এতো বেশি খুশি হয়েছিলাম যে আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলাম। তবে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার আমাকে এ এক্সপিডিশনের জন্য অতিরিক্ত ৬০ পাউন্ড দিয়েছিলেন।
নেচার স্টাডি : উক্ত এক্সপিডিশনটি সম্পর্কে কিছু বলুন ?
প্রফেসর হোসেন : এক্সপিডিশনটি ছিল প্রায় ৫ মাসের। তবে আমি আড়াই মাস পর চলে এসেছিলাম। ডারউইন যে পথে বিগল্ জাহাজে করে অভিযানে গিয়েছিলেন আমরাও সে পথেই সমুদ্র পাড়ি দিলাম। ‘বে অব্ বিস্কি’-তে যেখানে ডারউইনের জাহাজ আটকে গিয়েছিল সেখান দিয়ে আমরাও গেলাম। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে ওখানে সামুদ্রিক শৈবাল এতো বেশি ঘন হয়ে জন্মাতো যে তাতেই ডারউইনের জাহাজ আটকে গিয়েছিল। সমুদ্রের ঘূর্ণির মাঝখানের জায়গাটা স্থির থাকে, সমস্ত সামুদ্রিক শৈবাল সেখানে গিয়ে জমা হতে হতে হাজার হাজার বছরে স্তুপে পরিণত হয়। ফলে কোন জাহাজ ওখান দিয়ে যেতে গেলেই তা আটকে পড়ে। এখন অবশ্য ওখানে শৈবালের স্তুপ আর জমে না। আমরা এ জায়গাটা পার হয়ে গেলাম দক্ষিণ আমেরিকায়। ডাচ্-গিনি, ফ্রেঞ্চ-গিনি এসব পেরিয়ে জাহাজ থেমে থেমে এগিয়ে চলল। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম ‘ব্রিটিশ গায়ানার’ রাজধানী জর্জ টাউনে। এখানে পৌঁছে আমরা জাহাজ থেকে নেমে ট্রাকে করে গেলাম প্রায় ৯০ মাইল পথ পার হয়ে আমাজনের গভীর জঙ্গলে। এখান থেকে নৌকায় চড়ে আবার ৪/৫ ঘন্টার জার্নি। তারপরই আমরা আমাজন রেইন ফরেস্টের মেইন ক্যাম্পে উঠলাম। ‘কাইটোয়ার’ নামে একটা জায়গাতে আছে ছোট একটি জলপ্রপাত – এটিই পৃথিবীর হাইয়েস্ট ফলস্। এখানেই ছিল আমাদের মেইন ক্যাম্প। এখান থেকেই আমরা এদিকে সেদিকে এক্সপিডিশনে বের হতাম।
নেচার স্টাডি : আমাজন ফরেস্টে কি দেখলেন ?
প্রফেসর হোসেন : আমাজন রেইন ফরেস্টের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি লিখেছি আমার ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরাফুল’ বইটি। এতেই আমার রেইন ফরেস্টের অভিজ্ঞতার সমস্ত কাহিনী আছে। সেখানে গিয়ে আমাদের প্রত্যেককেই এক একটি বিষয়ের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছিল- যেমন কারো দায়িত্ব ছিল পাখির ডাটা কালেকশনের, আবার কারো বা সাপের, কারো স্তন্যপায়ী প্রাণির, কারো গাছপালার, কারো পোকামাকড় ইত্যাদি। আমি সেখানে কাজ করেছি পাখির ওপর। পাখি নেটিং করেছি, পায়ে ধাতব আংটি পড়িয়ে দিয়ে বার্ড ব্যান্ডিং করেছি। আমার কাছে এর সবকিছুই ছিল অবাক করা সব বিষয়। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে আমাজান রেইন ফরেস্ট হচ্ছে ‘লার্জেস্ট এভারগ্রিণ ফরেস্ট অব দি ওয়ার্ন্ড’। আমরা এর যে অংশে গিয়েছিলাম সেখানে মানুষের যাতায়াত আছে কিন্তু জনবসতি ছিল না।
নেচার স্টাডি : আপনি সুদীর্ঘ নয় বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন – সে অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : ১৯৫৩ সালের নভেম্বর থেকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছি। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধান এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত নতুন ব্যবস্থায় বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি যখন দায়িত্ব গ্রহন করি তখন শিক্ষক ছিলেন সম্ভবত ৬-৭ জন, আর যখন আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হস্তান্তর করি তখন শিক্ষক ছিলেন প্রায় ২০জন। ১৯৬৭ সালে সাইটোলজি, এন্টোমোলজি এবং ফিশারিজ নামক তিনটি শাখা ছিল। পরে অর্নিথোলজি (আরো পরে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজি) এবং প্যারাসাইটোলজি শাখা চালু হয়। ১৯৬৭ সালে কেবল জেনারেল গ্রুপ ছিল; সে বছরই প্রত্যেক শাখায় রিসার্চ গ্রুপ চালু করা হয়। সর্বপ্রথম প্রাণিবিদ্যা বিভাগে সেমিনার রুম চালু করা হয়, যা এখন একটি বিরাট বিভাগীয় লাইব্রেরি। কিছু বিদেশী কালেকশন, কিছু কীটপতঙ্গ এবং মাছ ছাড়া যাদুঘরে আর তেমন কিছু ছিল না। পরবর্তীতে দেশীয় কীটপতঙ্গ, উভচর থেকে স্তন্যপায়ি প্রাণিদের নমুনা সংগ্রহের ফলে বিভাগীয় যাদুঘর পূর্ণতা লাভ করে। এ সংগ্রহে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
নেচার স্টাডি : আপনি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম Wildlife Biology চালু করেন – এ সম্পর্কে বলুন?
প্রফেসর হোসেন : আমাদের দেশ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। ১৯৬৭ সালে বন্যপ্রাণিতত্ত্ব শাখা চালু করার ফলে অন্যান্য গ্রুপের মতো উভচর ও স্তন্যপায়ী প্রাণিগোষ্ঠী সম্বন্ধেও চর্চা ও গবেষণা শুরু হয়। ১৯৬১ সালের দিকে Wildlife শব্দটি আমাদের ঠিক জানা ছিল না। এখন বাংলাদেশে বন্যপ্রাণি শাখায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কয়েকশত এম.এস.সি. এবং বেশ কয়েকজন এম.ফিল. ও পি.এইচ.ডি. ডিগ্রীধারী রয়েছে। আমাদের অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এখন বিভিন্ন দেশে আছে; আজকে আমাদের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে আমরা যাকিছু জানি, তার প্রায় সবই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রহীত তথ্য। এদেশে বর্তমানে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে Wildlife Biology -এর শাখা রয়েছে।
নেচার স্টাডি : আপনি ‘বাংলাদেশ বন্য প্রাণিতত্ত্ব সমিতি’ এবং ‘বাংলাদেশ পাখি সংরক্ষণ সমিতি’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি – এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : আমাদের বন্যপ্রাণিতত্ত্ব শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের একসঙ্গে যুক্ত করে রাখাই ছিল ওই দু’টি সোসাইটির উদ্দেশ্য। এ’দুটো সংগঠনের মাধ্যমে আমরা সেমিনার, সিম্পোজিয়া ও লেখালেখির মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনগনের মধ্যে প্রচুর সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। আজ প্রায় সকলেই বন্যপ্রাণি সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে জানেন। এক্ষেত্রে ওই দু’টো সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আপনাদের ‘নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘নেচার স্টাডি সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন এবং সে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণিতত্ত্ব সমিতির’ জয়েন্ট সেক্রেটারী ও আমাদের প্রত্রিকা ‘পরিবেশ পরিক্রমা’-এর সহ-সম্পাদক ছিল।
নেচার স্টাডি : আপনার গবেষণা-জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : প্রায় ৬০টি গবেষণাপত্র দেশী ও বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর বেশ কিছুতে আমার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা Co-author হিসাবে আছে। বাংলায় এবং ইংরেজিতে প্রায় ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই আমাদের বন্যপ্রাণী এবং এদের পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত। আরো দু’টি বই প্রকাশের পথে রয়েছে। আমি এ পর্যন্ত ৯ জনকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পেতে সাহায্য করেছি।
(বিঃদ্রঃ- পরবর্তীতে আরো অনেকে এ তালিকায় সংযোজিত হয়েছেন – ৫জন পি.এইচ.ডি ও ১০জন এম.ফিল।)
নেচার স্টাডি : একসময় এদেশে প্রচুর অতিথি পাখি আসত, এদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে, এর কারণ কি?
প্রফেসর হোসেন : আমরা জানি অতিথি পাখিদের যাতায়াতের পথ এবং তাদের শীত ও গ্রীষ্মের আবাস লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নির্ধারিত। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অধিকাংশ শীতের পাখিরFlyway. অতিথি পাখির সংখ্যা যদি কম হয়ে থাকে তবে তার কারন অন্য দেশের স্থানীয় গোলমালের জন্য অস্থায়ীভাবে তাদের যাতায়াতের পথ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আমাদের দেশে অতিথি পাখি পর্যবেক্ষণ কেউ কেউ করছেন – ভালো কথা। যে পরিমান তথ্যের ভিত্তিতে ওদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখা যায়, সে পরিমান তথ্য আমাদের হাতে নেই বলেই আমার বিশ্বাস। অনুমানের ভিত্তিতে বক্তব্য দেয়া ঠিক হবে না।
নেচার স্টাডি : অতিথি পাখি কমে গেলে আমাদের পরিবেশের ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে ?
প্রফেসর হোসেন : অধিকাংশ অতিথি পাখি বনাঞ্চলের বাইরে আশ্রয় নেয়। অতিথি পাখি কমে গেলে অবশ্যই আমাদের খালবিল, নদীনালা, চর, হাওড়-বাওড় ও উপকূলীয় অঞ্চলে পাখির সংখ্যা কমে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের মধ্যেও প্রতিকূল প্রভাব পড়বে বইকি।
নেচার স্টাডি : পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় – অতিথি পাখিরা বার্ড-ফ্লু রোগ ছড়াচ্ছে – এ বিষয়ে আপনার মতামত কি ?
প্রফেসর হোসেনঃ অতিথি পাখিরা অর্নিথোসিস (Ornithosis), সিট্টাকোসিস (Psittacosis) ইত্যাদি রোগ ছড়ায় বলে জানা আছে। ‘বার্ড ফ্লু’ ছড়ানোও অসম্ভব নয়। তবে বার্ড ফ্লু কিভাবে শুরু হয়, অতিথি পাখির মধ্যে, নাকি খামারের পাখির মধ্যে – এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।
নেচার স্টাডি : এদেশে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না; এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি ?
প্রফেসর হোসেন : আমাদের বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অত্যন্ত ভালো। কিন্তু ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ দাবী আমরা বহুকাল ধরে করে আসছি। মন্দের ভালো, সম্প্রতি বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিষয়টি রেভিন্যু বোর্ডের আওতায় আনা হয়েছে। এতোদিন ছিল উন্নয়ন বাজেটে, অর্থাৎ টাকা পেলে চলতো, না পেলে বন্ধ হয়ে যেত। তাছাড়া, অনেকদিন পরে এখন ‘বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা’ পৃথক একটি সার্কেলের আওতায় আনা হয়েছে – এটিও মন্দের ভালো। তবে দু’দিন আগে হোক বা পরে হোক ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে ভয় হচ্ছে, তখন হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমেরিকার Passenger Pigion-কে সংরক্ষনের জন্য যখন বিশেষজ্ঞরা গলাবাজি করছিলেন, তখন শিকারীরা বিরোধিতা করছিল; আর সরকার শিকারীদের পক্ষেই ছিল। কিন্তু এর ৫/৭ বছরের মধ্যে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে যায়, যখন লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে সর্বোচ্চ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেয়ার পরও প্যাসেঞ্জার পিজিয়নকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। প্রাণিদের মধ্যে ‘Population instinct’ বলে একটা ব্যবস্থা আছে, Population size সে মাত্রা অতিক্রম করলে, তাকে আর বাঁচানো যায় না। ‘Australian Aborigin’ কিছু উপজাতির মানুষও একই কারনে বিলীন হয়ে গেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা।
নেচার স্টাডি : আপনি নিশ্চয়ই জানেন, নটরডেম কলেজে সর্বপ্রথম নেচার স্টাডি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবেশ সংরক্ষনে এটি কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
প্রফেসর হোসেন : ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণিতত্ত্ব সমিতির’ পক্ষ থেকে আমরা এ সুপারিশ করেছিলাম। জনাব মিজানুর রহমান ভূঁইয়া দেরী না করে নটরডেম কলেজে এটি গঠন করেন। আজও এটি বেশ সফলতার সাথে টিকে আছে – আমরা এতে খুশি। অন্য দু’একটি কলেজে নেচার স্টাডি ক্লাব স্থাপিত হলেও সেখানে সেগুলো বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। আসলে সর্বক্ষেত্রেই দু’একজন মানুষকে নিবেদিত প্রাণ হতে হয়।
নেচার স্টাডি : আপনি জানেন যে নটরডেম নেচার স্টাডি ক্লাবের প্রাক্তন সদস্যরা ‘নেচার স্টাডি সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ গঠন করে; এর উপদেষ্টা হিসেবে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : এ সোসাইটির জন্য আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। আমার বিশ্বাস জনাব মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও তাঁর সহকর্মীরা যতদিন উৎসাহিত থাকবেন, ততদিন এটি নিশ্চয়ই চমৎকার ভাবে চলবে।
নেচার স্টাডি : আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, আমাদের পত্রিকা টি বিগত ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে; এটি সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর হোসেন : সংবাদটি অত্যন্ত উৎসাহ এবং আশাব্যঞ্জক। ইচ্ছে করলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও যে বড় কিছু করতে পারে এটা তারই প্রমাণ। এর সাফল্য কামনা করি।
(বিঃদ্রঃ – বর্তমানে এর সাথে চালু হয়েছে, আমাদের ওয়েব ম্যাগাজিন – www.naturestudysociety.org)
নেচার স্টাডি : আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য নেচার স্টাডি পত্রিকা এবং এর পাঠকদের তরফ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
প্রফেসর হোসেন : নেচার স্টাডি পত্রিকা ও এর পাঠকদের প্রতিও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। আশা করি এ পত্রিকা এবং এ সোসাইটি পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। দেশের সকলে পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠুক – এ কামনা করি।