পরাগযোগ ও ফুলের সুবাস
লেখক- আজহারুল ইসলাম খান।
ফুল সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও পবিত্রতার প্রতীক। প্রিয়জনের জন্য সবচেয়ে ভাল উপহার হলো ফুল এটা সর্বজন স্বীকৃত। মন দেয়া-নেয়ার পর মানব মানবীর মধ্যে প্রথম যে বিনিময়টি ঘটে তা হলো ফুল। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের সুগন্ধকে ব্যবহার করে বিশ্বের নামকরা কসমেটিক কোম্পানীগুলো আজকাল পারফিউম, ক্রিম, সাবান ও লোশন উৎপাদন করছে। এখানেই শেষ নয় ফুল ফোটে বলেই আমরা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য কাঁচামাল পেয়ে থাকি এবং এই ফুলের মধ্যে যে সকল পলিনেটর পরাগযোগ ঘটায় তাদের অবদান ও দয়া প্রানিকুলের জন্য অপরিসীম। সুধী পাঠক এই ফুলকে নিয়েই আজ আপনাদের কিছুটা সময় নষ্ট করবো।
যে সকল কেমিকেল ব্যাপক ভাবে সুবাস ছড়ায় তাদের মধ্যে অনেক ভিন্নতা আছে। জেসমিনের স্বাতন্ত্র্যসূচক সুবাসের কারন হলো মিথাইল জেসমোনেট যা সেল মেমব্রেন যৌগের মেটাবলিজমের ফলে উৎপন্ন হয়। সেল মেমব্রেন এর প্রকৃতি প্রত্যয়গত গঠন যেমন short-chain ketones, aldehydes এবং alcohols যা ফুলের স্বাতন্ত্র্যসূচক সুগন্ধি প্রদান করে। এসবকিছুর উদ্দেশ্য আমাকে আপনাকে এর সুভাস উপভোগ করানোর জন্য নয় কিংবা আপনার প্রিয়জনের জন্যও নয়, এ শুধু তাদের পলিনেটরদের মনোরঞ্জনের জন্য।
অন্য উদ্বায়ী যৌগ যেমন methyl salicylate হলো benzoic acids যার গঠন acetylsalycilic acid অথবা asprin এর সাথে সম্পর্ক যুক্ত। phenylpropanoids হলো দারুচিনি ও জায়ফল এর সুবাস যৌগের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। বেশ কিছু সংখ্যক ফুলের সুবাস হলো পাইন গাছের terpene resins এর মত সরল গঠন বিশিষ্ট। নির্দিষ্ট ফুল প্রজাতির তারতম্য অনুপাতের মধ্যে এইসব রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণ ফলে নির্দিষ্ট ফুলের সুবাসের ঝোঁক আছে।
নির্দিষ্ট ফুলের সুবাস নির্দিষ্ট পোকা পরাগ বহনকারীদের আকর্ষণ করে উদাহরণস্বরূপ Titan arum বা পচা মাংস ফুল Beetles পোকাকে আকর্ষণ করে এবং মাছি এর উপর ডিম পাড়ে। হয়ত ধারনা হতে পারে ফুলের মাংসপচা গন্ধ অরুচিকর কিন্তু এই ফুলের ক্ষেত্রে পচা গন্ধের কারনেই পরাগযোগের সম্ভাবনা বেড়ে গেলো।
সুতরাং ফুলের সুবাস পরাগযোগকে সহজ করে দিলো ফলাফল হিসেবে পলিনেটর (পোকা মাকড়) ফুলের সন্ধান পেতে সহজ হলো। একটি পলিনেটর সরাসরি একটি ফুলকে দেখতে পেয়ে যতটা না আকৃষ্ট হয় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী আকৃষ্ট হয় ফুলের সুবাসে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের চারপাশে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ্য করছেন বিজ্ঞানীরা। তারা দাবি করছেন উষ্ণ আবহাওয়ায় জন্মানো ফুল তুলনামূলক বেশি গন্ধ ছড়ায়। যে কারনে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য ফুলের গন্ধ তুলনামূলক মিষ্টি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু ফুল স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় নয়গুণ পর্যন্ত বেশি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। ১-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ফুলের গন্ধ উৎপাদন ক্ষমতা অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কেমিকেলের উপস্থিতিতে ফুলের গন্ধ ছড়ায়, উষ্ণ আবহাওয়ায় গাছের সেই কেমিকেল উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়ে যায়। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ফুলের গন্ধ বাড়ায় মৌমাছি এবং ওই জাতীয় কীট-পতঙ্গ(পলিনেটর) উপকৃত হচ্ছে। একইসঙ্গে পরাগায়ন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মূলত শীত প্রধান দেশগুলোতে ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
যথেষ্ট পরিমান পুষ্টি পাওয়ার জন্য ফুলের সুবাসের দিকে পলিনেটরদের আকর্ষন অনেক বেশী থাকে।এছাড়া উষ্ণ তাপমাত্রায় ও বেশী আলোতে ফুলের সুবাস বৃদ্ধি পায় কিন্তু কিছু উদ্ভিদের ফুলের সুবাস এদের লাইফ স্প্যান কমিয়ে দেয়। যদি কোন ফুল সুবাস তৈরির জন্য শক্তি ব্যবহার করে, কিন্তু নিজের সৌন্দর্য বজায় রাখতে এই শক্তি ব্যবহার করতে পারে না। ফুলদানিতে যখন ফুল রাখা হয় তখন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন অধিকাংশ ফুলের সুবাস circadian cycle প্রদর্শন করে অর্থাৎ এরা নির্দিষ্ট একটা সময়ে খুবই তীব্র সুবাস ছড়ায়, হয় সেটি দিনে না হয় রাতে হতে পারে। এক্ষেত্রে Snapdragons কে উদাহারন হিসেবে দেখানো যায় কারন দিনের বেলা পলিনেটর মৌমাছি যখন একটিভ থাকে তখন এদের সুবাস অনেক বেশী ছড়ায় রাতের তুলনায়। Nicotiana এর সুবাস রাতের বেলায় অনেক বেশি ছড়ায় যখন পলিনেটর হিসেবে নিশাচর মথ সক্রিয় থাকে।
ফুলের সুবাস বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের হয়, কিছু ফুলের পরাগ সুবাসিত হয়। পরাগের তৈলাক্ত আবরন নিজস্ব সুবাসের যৌগ বহন করে যা প্রজাতি ভেদে আলাদা আলাদা হয়।
পাপড়ির বিভিন্ন অংশ বা গর্ভকেশর অনেক সময় বিভিন্ন পরিমানের সুবাস যৌগ উৎপন্ন করে। উদাহরন স্বরুপ গোলাপ পরাগের কথা উল্লেখ করা যায়। এজন্যই আজকাল সৌন্দর্য প্রিয় মানুষ বাথটাব বা গোসলের পানিতে গোলাপের পাপড়ি ও পরাগ ছড়িয়ে রাখে যেন গোসলের সময় সারা শরীর সুবাসিত হয়।
কিছু ফুলের সুবাস খুবই হালকা হয়। এরা সাধারনত ভোর বেলা অথবা বৃস্টি স্নাত হওয়ার পর সুবাস ছড়ায়। যেমন মধুমঞ্জুরি বা রেংগুনক্রিপার।আপনি খেয়াল করে দেখবেন সারাদিন কোন সুবাস নেই কিন্তু ভোরে বা বৃস্টির ছোঁয়া পেলেই মৃদু সুগন্ধে চারিপাশ ভরিয়ে দেয়। এরা সাধারনত পিপড়া অথবা টুনটুনি পাখি কতৃক পরাগযোগ ঘটায়। এখানেও চমৎকার কম্বিনেশন টুনটুনি পাখি খুবই লাজুক স্বভাবের তাই এরা মানুষের কোলাহল পছন্দ করে না। ভোরবেলা যখন মানুষের কোলাহল থাকে না তখন টুনটুনি ও মধুমঞ্জুরি কানে কানে ফিস ফিস করে প্রেমালাপ সেরে নেয়।
বৃষ্টির পর বাগানের আশে পাশে ভ্রমন করলে আদ্র বাতাসের জন্য ফুলের সুবাস তীব্র হয়। কারন সুবাস যৌগ গুলো সহজেই আদ্রতা কে ভর করে আপনার নাকের কাছে হাজির হয়।
ফুল এছাড়াও আর্দ্র অবস্থার অধীনে আরো সুবাসিত যৌগের মুক্তি দেয়।কারন বৃষ্টির পরে কিছু পলিনেটর যেমন ফড়িং গ্রাস হোপার এরা ঘুরা ফেরা করে আর সুযোগ বুঝে ফুল সুন্দরী তার সৌরভ বেশী করে ছড়ায় যেন উল্লেখিত পলিনেটর দ্বারা পরাগযোগ ঘটে।
Circadian cycle– circadian(সার্কাডিয়ান) rhythm বা cycle প্রাণীর পরিবেশে আলো এবং অন্ধকারের প্রাথমিকভাবে সাড়া এটি প্রায় ২৪ ঘন্টা চক্র অনুসরণ করে শারীরিক,মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটায়। circadian cycle বা circadian rhythms নিয়ে যে গবেষণা করা হয় Chronobiology বলে।