সৌন্দর্য যখন মৃত্যুর হাতছানি

আজহারুল ইসলাম

নগর সভ্যতার কারনে ক্রমশঃ আমাদের বন জঙ্গল হারিয়ে যাচ্ছে। আর এই পথ ধরেই লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ছে অনেক ফুল অনেক উদ্ভিদ। শুধু তাই নয় আমাদের অজ্ঞানতাও অনেক ফুলের জীবনে আঁধার নেমে এসেছে। তেমনি একটি ফুল ওলটচণ্ডাল। বিজ্ঞানসম্মত নাম Gloriosa superba এটি Colchicaceae পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ যা জিম্বাবুয়ের জাতীয় ফুল হিসেবে সম্মানিত। ১৯৪৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর একুশ তম জন্মদিনে রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) ভ্রমনকালে এই ফুলের আকারে একটি হিরে উপহার দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজ্য ফুলের সম্মান দেয়া হয়েছে এই ফুলকে। তামিলনাড়ুর ঝোপঝাড়ে একটু সদয় দৃষ্টি দিয়ে তাকালে এর দেখা পাওয়া যায়। তবে আমি তামিলনাড়ুর এক বাগানে অগ্নিশিখা গাছের নামফলকে লেখা দেখেছি “Don’t touch, its a poisonous plant”. একে ইংরেজিতে Flame Lily(শিখা লিলি), Climbing Lily(পর্বতারোহন লিলি),Tiger Claw(বাঘের নখর), Fire Lily(অগ্নি লিলি), Glory Lily(মহিমা লিলি), এবং Creeping Lily(প্রলম্বন লিলি) ও Gloriosa Lily(গৌরবময় লিলি) বলে।

বিশ্বে ৭৭ টি পরিবারের ফুল রয়েছে যারা নিয়মিত রঙ বদলায়। তাঁদের মধ্যে একটি এই ওলটচণ্ডাল। মূলতঃ অ্যান্থোসায়ানিন পিগমেন্টের কারনে এরকম ঘটনাটি ঘটে। এই ফুল প্রথমে ক্রিম সাদা রঙের হয়। পরের দিন ফুলের পাঁচটি পাঁপড়ির মুক্ত প্রান্তের দিকে অর্ধেক অংশ হলুদাভ হয়ে ওঠে। এবং গোড়ার দিকে মলিন সাদা বা ক্রিম রঙের থাকে। তৃতীয় দিন পাঁপড়িগুলির একপ্রান্তের এক তৃতীয়াংশ উগ্র লাল, মাঝে হলুদাভ এবং গোড়ার দিকে ক্রিম রঙের দেখায়। চতুর্থ দিন প্রায় পুরোটাই লাল হয়ে যায়। কিন্তু মুক্ত প্রান্তের রঙ আরো গাঢ় লাল রঙের হয়। বাংলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন উদ্ভিদের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক নাম ব্যবহার করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সমতুল্য। বিভিন্ন সময়ে তিনি যে শুধু দেশীয় গাছপালা নিয়ে কথা বলেছেন তা নয়, বিদেশি অনেক উদ্ভিদেরও নাম দিয়ে আপন করে নিয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছে গ্লোরিওসা সুপার্বা বা অগ্নিশিখা। আসলে কবিগুরু এই ফুলের রঙ রূপ দেখেই এর নামকরণ করেছিলেন অগ্নিশিখা।

কর্নাটকের মধুমালাই ফরেস্ট থেকে ধারণকৃত
কর্নাটকের মধুমালাই ফরেস্ট থেকে ধারনকৃত

জঙ্গলে জন্ম হলেও এই লতানো বনফুলের সৌন্দর্য অনন্য। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ফুল ধরে লতাজুড়ে। লাল আর হলুদে মিশ্রিত ফুল মন কেড়ে নিতে পারদর্শী যে কোনো ফুলপ্রেমীর। তবে এর সৌন্দর্য মানুষের প্রাণও কেড়ে নিতে পারদর্শী। উল্টো চন্ডাল, উলটচন্ডাল বা অগ্নিশিখা নামক এই ফুল খুবই মারাত্মক রকম বিষাক্ত।এর সৌন্দর্য শুধু কি মানুষ কে আকৃষ্ট করে! নিজের সৌন্দর্যে প্রজাপতি আর ভ্রমরকে আকর্ষণ করে এবং বাড়িয়ে তোলে প্রকৃতির সৌন্দর্য। তাইতো প্রকৃতিও তার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাঙিয়ে তুলেছে আগুনের সাবলীলতায়। সব সবুজের ভেতর লাল আর হলুদের আগুন রঙ যেন হার মানায় এ শহরের কৃষ্ণচূড়ার আবেদনকেও।

উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় এর পুষ্পবিন্যাসকে বলে Lax Corymbose Inflorescence এটি একটি অত্যন্ত বিরল ধরনের পুষ্পবিন্যাস। এদের প্রতিটি পাঁপড়ি ঢেউখেলানো। পাঁপড়িগুলির দৈর্ঘ্য ৭-৮ সেমি এবং প্রস্থ ১ সেমি হয়। কুঁড়ি অবস্থায় নিচের দিকে মুখ থাকলেও ফোটার সময় গর্ভাশয় ও গর্ভদণ্ডের থেকে অন্যান্য ফুলের পাঁপড়ি যেমন সাধারনভাবে ৯০ ডিগ্রি কোনে ঘুরে যায়, এদের ক্ষেত্রে কিন্তু পাঁপড়িগুলি পুনরায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ঝিমিয়ে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় এভাবেই। তখন মনে হয় যেন তার রূপ যৌবন হারিয়ে লজ্জা পেয়েছে! তাই অনেক এলাকার লোকজন একে লজ্জাবতী ফুল হিসেবে জানে।

পিন্টারেস্টের সৌজন্যে

গ্রামাঞ্চলে এটি ভেষজ গাছ হিসেবেই পরিচিত। ভারতের কর্নাটক এলাকায় প্রাকৃতিক ভাবে এদের জন্মিতে দেখেছি। এলাকার লোকজনের কাছে এটি লাঙ্গুলিয়া গাছ নামেই পরিচিত। আসলে বায়বীয় কাণ্ডের প্রতিটি নোড থেকে এর পাতা জন্মায়। সেই পাতাগুলো যেমন চওড়া তেমন লম্বা। পাতার অগ্রভাগ সরু হতে হতে আকর্ষে পরিনত হয়। যা অনেকটা হনুমানের লেজ বা লাঙ্গুলের (লেজ বা পুচ্ছ) মত জড়িয়ে ঝোপঝাড়ের শীর্ষে পৌঁছে যায়।Gloriosa superba ছাড়াও পৃথিবীতে দেখা মেলে G. Simplex, G. lutea, G. carsonii, G. Rothschild Jana, R. virescens, R. abyssinica এবং Methonica superba প্রজাতির ওলটচণ্ডাল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গাছ এটি। এর টিউবারাস রাইজোম থেকে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড কলচিসিন এবং গ্লোরিওসিন পাওয়া যায়। গ্লোরিওসিন উপক্ষারের উপস্থিতির কারনেই এই গনের নামকরণ করা হয়েছে Gloriosa.

শুরুতেই উল্লেখ করেছি অগ্নিশিখা একটি মারাত্মক বিষাক্ত উদ্ভিদ, এর রূপে মুগ্ধ হয়ে বেশি মেলামেশা করলে মহাবিপদ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে শতভাগ।

এই গাছে কোন অংশ খেয়ে ফেললে মারাত্মক হতে পারে। এমনকি গাছের ছোঁয়াতেও ত্বকে জ্বালা-পোড়া ভাব হতে পারে। বহু দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণ হিসেবে পরিচিত এই অগ্নিশিখা উদ্ভিদ। কাউকে বিষ প্রয়োগে হত্যাসহ এবং শত্রুতা বশতঃ কারো গর্ভপাত ঘটানো বা গর্ভপাত ঘটিয়ে বিপদ মুক্ত হবার জন্য এই উদ্ভিদটি ব্যবহৃত হয়।

সাপের বিষ খুবই বিষাক্ত হলেও যেমন অনেক মুল্যবান ঔষধের কাচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তেমনি অগ্নিশিখা বিষাক্ত হলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ। তবে বিশেষজ্ঞের অনুমতি ছাড়া এর ব্যবহার ও সেবন সম্পুর্ন নিষেধ। এর রাইজোম ব্যবহৃত হয় সন্তান জন্মানোর সময় প্রসববেদনা লাঘবের জন্য। এছাড়া সাপে কামড়ানো,গাউট,বন্ধ্যাত্ব,কলেরা,কিডনিসমস্যা,আলসার,কাটাছেঁড়া,স্মলপক্স,ক্যানসার,যৌনরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয় বহুলভাবে।

আমাদের দেশে এক সময় প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নিত এই উদ্ভিদ কিন্তু সরকারি বনসৃজনের নামে অজান্তেই কেটে ফেলা হয় এই গাছগুলোকে। এই কারনেই এখন গ্রামাঞ্চলে প্রায় দেখাই যায়না আগের মতো। অষ্ট্রেলিয়ার উপকূল এলাকায় ভ্রমনকালে দেখেছি এই উদ্ভিদ বিশেষ যত্নে লালিত হচ্ছে। আসলে এখন এক শ্রেনীর লোভী ব্যবসায়ীর লোভের শিকার এই গাছটি। অথচ বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাঁচানোর এবং বংশবৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই কারোর। ফলে ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়ার পথে ঔষধি গাছ ওলটচণ্ডাল তথা অগ্নিশিখা।

সতর্কতাঃ প্রবন্ধে বর্নিত ঔষধি গুনাগুন কাহারো জন্যে ব্যবস্থা পত্র নহে। যে কোন ঔষধ সেবনের পূর্বে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎকের পরামর্শ নেয়া বাঞ্চনিয়। এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে কোন সমস্যা নেই তবে হাতে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

টীকাঃ

(১)অ্যান্থোসায়ানিনঃ এটি জলে-দ্রবণীয় vacuolar পিগমেন্ট

(২)vacuole: It is a membrane-bound organelle which is present in plant and fungal cells.