অরক্ষিত সুন্দরবন

অরক্ষিত সুন্দরবন
এক মাসে চারবার আর গত ১৪ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হওয়ায় ভেঙে পড়ছে বনের খাদ্যশৃঙ্খল জাহাজডুবি, আগুন নিয়ে পরিবেশবাদীরা সরব নন
আরিফুর রহমান
ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সবচেয়ে বিপদে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচ জেলার ১৭ উপজেলার তিন লাখ মানুষের রুটি-রুজির উৎস এ বন এখন অনেকটাই অরক্ষিত ও অনিরাপদ। ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই অখণ্ড বনভূমিতে গত দেড় বছরে বেশ কয়েকবার তেল, কয়লা, পটাশ সারবাহী জাহাজ ডুবেছে। এতে বনের পরিবেশ দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়েছে। ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হওয়ায় ভেঙে পড়ছে বনের খাদ্যশৃঙ্খল। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমছে দ্রুত। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে জনপদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ এ বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়েও চলছে বিতর্ক। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনা, অবস্থাদৃষ্টে যা নাশকতা বলেই জানা গেছে। এর মূলে দখলবাজি আর আধিপত্য বিস্তার। আগুন বড় আকার ধারণ করলে তা নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা বা কোনো ব্যবস্থাই নেই বন বিভাগের। এখনো বনকর্মীরা আসার আগেই স্থানীয় জনগণ আগুন নেভানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের হাতেও দুর্গম বনাঞ্চলে আগুন নেভানোর উপকরণ সীমিত।
গত এক মাসের ব্যবধানে সুন্দরবনে চারবার আগুন লেগেছে। আর গত ১৪ বছরে এমন ঘটনা ঘটেছে ২৪ বার। অথচ এ ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে কোনো সরকারই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কোনোমতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় সারা হয়েছে। আর সুন্দরবন রক্ষায় পরিবেশবিদরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যতটা সরব, তেলবাহী জাহাজডুবি কিংবা আগুন লাগার ঘটনায় তাঁরা ততটাই নীরব। স্থানীয় সূত্র এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রভাবশালী কয়েকটি চক্র অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগাচ্ছে। এরা বেপরোয়া এবং ক্ষমতাধর। আগুনের ঘটনায় বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর সরকারের নির্লিপ্ততা দৃষ্টিকটু। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সরকার সুন্দরবনকে শুধু বন ও জমি মনে করছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষায় তাদের কোনো তাগিদ নেই। এ কারণে অপরাধী চক্রটি এভাবে ঘন ঘন আগুন লাগানোর সাহস পাচ্ছে; যদিও বন বিভাগ বলছে, বনে যারা আগুন দিচ্ছে, তাদের ধরার জন্য উচ্চ মহল থেকে নির্দেশ এসেছে। তবে জ্ঞাত-অজ্ঞাত কিছু ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের ছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
বারবার আগুন লাগার কারণে বনের ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের আঘাত আসছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যেখানে আগুন লাগে, সেখানকার মাটি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। কয়েক একর জায়গার নানা প্রজাতির প্রাণী মারা যায়। জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আগুন লাগার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ছোট ছোট জীব মারা যায়। অনেক প্রাণী আছে, যারা তাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে সেগুলো ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এ কারণে সেখানকার ইকোসিস্টেমে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। আবদুল্লাহ হারুন আরো জানান, আগুনে মাটি পুরোপুরি পুড়ে যায়। যত দূর পর্যন্ত আগুন, ধোঁয়া ও তাপ বিস্তৃত হয় তত দূর পর্যন্ত প্রাণীশূন্য হয়ে যায়। এর ফলে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১৮ এপ্রিল ছনের মধ্যে আগুন লাগানো হয়। এই ছনের মধ্যে মূলত বাঘ, বানর, শূকর, বিড়াল, ভোঁদড়সহ অন্যান্য প্রাণী থাকে। খুব স্বাভাবিক কারণে সেখান থেকে প্রাণীগুলো সরে গেছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল সুন্দরবনের নাংলি ক্যাম্প এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল এবং ২৭ মার্চ নাংলি, আব্দুলার ছিলা, পচাকুড়ালিয়ে ও নাপিতখালী এলাকার প্রায় ১০ একর বনভূমি পুড়ে যায়। শুধু বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা এসব আগুনে প্রায় ৭০ একর বন পুড়ে ছাই হয়েছে। সুন্দরবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের কোনো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় ফায়ার সার্ভিসের দিকে। ২০০২ সালের ২২ মার্চ কটকা অভয়ারণ্যে ১৫ দিন আগুন জ্বলে। পুড়ে যায় হাজার হাজার গাছ। সেই থেকে শুরু হয় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। প্রতিনিয়তই সেটি বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনার পর বন বিভাগ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোনো প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। এসব আগুন লাগার পেছনে যারা জড়িত, তদন্তে তাদের নাম আসে না। দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) ইউনূস আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগেও সুন্দরবনে আগুন লেগেছে। তবে তা এত ঘন ঘন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশি বেশি আগুন লাগছে। এটা ঠিক যে সুন্দরবনে আগুন লাগলে সেটি নেভাতে আমাদের নিজস্ব কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। আমরা ফায়ার ব্রিগেডের সহযোগিতা নিই। তবে সাম্প্রতিক এসব ঘটনা আমাদের নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। আগুন নেভানোর পাশাপাশি নদীতে ছড়িয়ে যাওয়া তেল তুলতে বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আগুন যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে বেশি লাগে, সে জন্য আমরা ফায়ার ব্রিগেডকে অনুরোধ করেছি, ওই সময় যাতে বন বিভাগকে সার্বক্ষণিক একটি টিম দেওয়া হয়। কারণ সুন্দরবনের পাশে চারটি উপজেলায় ফায়ার ব্রিগেডের কার্যালয় রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ১৩ এপ্রিলের আগুন লাগার ঘটনায় এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এদিকে সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে পরিবেশবাদীরা যতটা তৎপর, নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়া কিংবা আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ততটা তৎপরতা দেখা যায় না। এ নিয়ে কোনো আন্দোলন হয় না, বিবৃতিও আসে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন কালের কণ্ঠকে বলেন, সুন্দরবনের চারপাশে সরকারের প্রভাবশালীরা জমি কিনছে। সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। সে তুলনায় সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়টি খুবই নগণ্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন শুধু রামপালকে নিয়ে নয়। আমাদের আন্দোলন সুন্দরবনকে বাঁচাতে। ব্যক্তি অত্যাচারী, নাশকতাকারী ও সরকার যারা সুন্দরবনের ক্ষতি করতে চাচ্ছে, আমরা তাদের সবার বিরুদ্ধে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, সুন্দরবনে একটি শক্তিশালী চক্র আগুন লাগাচ্ছে। নাশকতাকারীরা বনের ভেতর গিয়ে আগুন দিচ্ছে, অথচ বন বিভাগ কিছুই করতে পারছে না। এতেই প্রমাণিত হয়, এসব ঘটনায় বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও জড়িত। তিনি বলেন, ‘একদিকে সেখানে আমরা ক্রসফায়ারের ঘটনা দেখি, কিন্তু এসব আগুন যারা লাগায়, তাদের ক্রসফায়ারে দিতে দেখি না। বিষয়টি আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে।’ আনু মুহাম্মদ বলেন, সেখানে দেশি ও বিদেশি আন্তর্জাতিক চক্র কাজ করছে। তারাই এসব নাশকতা চালাচ্ছে। পরিবেশবাদীরা রামপালকে ঘিরে যতটা সরব, সুন্দরবনে বাঘের চামড়া পাচার কিংবা ঘন ঘন আগুন লাগার বিষয়ে ততটা সরব নয় কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘হ্যাঁ, বিষয়টি আমি নিজেও উপলব্ধি করছি। এ বিষয়ে কথা বলা উচিত। আমরা এখন থেকে বিষয়টি আলোচনায় আনব। কারণ আগুন লাগার ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে আমরা রামপাল নিয়ে আন্দোলন করছি এ কারণে যে সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে আরো অনেকে অনেক কিছু করার উদ্যোগ নিচ্ছে। সেগুলোকে বাধা দিতেই আমাদের এ আন্দোলন।’ সুন্দরবনে লাগানো আগুন নেভাতে বন বিভাগের সক্ষমতা যথেষ্ট কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন বিভাগের সক্ষমতা নির্ভর করে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার ওপর। সুন্দরবন নিয়ে তো সরকারের কোনো নীতি ও পরিকল্পনাই নেই। তাহলে তারা কেন বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়াবে?
বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) জহির উদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল লাগা আগুনের কারণ আমরা বের করেছি। এর আগে ১৩ এপ্রিল আগুন লাগার পর আমরা ছয়জনের নামে মামলা করি। তাতে একটি গ্রুপ ক্ষুব্ধ হয়ে আগুন লাগিয়েছে। তারা ক্ষমতা দেখাতে এ কাজ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গত মঙ্গলবার পাঁচজনের নামে শরণখোলা থানায় এফআইআর করেছি। পুলিশ এখন অনুসন্ধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’ আগুন নেভাতে বন বিভাগের সক্ষমতা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কোনো উপকরণ ও যন্ত্রপাতি নেই। আমরা ফায়ার স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের নিজস্ব উপকরণ ও যন্ত্রপাতি থাকা জরুরি। বারবার বলেছি, কিন্তু পাইনি। গত মঙ্গলবার ফায়ারের সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি, আমাদের শীতকালের জন্য স্থায়ীভাবে একটি টিম দেওয়ার জন্য। যাতে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেখানে যেতে পারে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে ৬৬ প্রজাতির গাছ রয়েছে। মাছ আছে ২০০ প্রজাতির বেশি। আর ৪২ প্রজাতির বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৩৪ প্রজাতির পাখি, ৫১ প্রজাতির সরীসৃপ ও আট প্রজাতির উভয়চর প্রাণী পাওয়া যায় এ বনে।
বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়ে বন বিভাগ এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল কয়েকটি কারণ। মৌয়ালিরা বনে মধু সংগ্রহে ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য আগুন লাগায়। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে। আবার চোরাকারবারীরা সুন্দরীগাছ চুরি করে তা নেওয়ার পথ তৈরির জন্য আগুন লাগিয়ে দেয়। যাতে সবার মনোযোগ ওই দিকে থাকে। জেলেদের ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকেও আগুন লাগে। তবে এসব আগুন লাগানোর সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা অনেকে জানিয়েছেন।
Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/04/21/349738
Photo Source: dailyasianage.com