মৌসুমি ফলে বিষ!


26 April, 2016.

*আবুল* *খায়ের* *ও* *বারেক* *কায়সার*:

‘মধু কই কই বিষ খাওয়াইলা’ চট্টগ্রামের জনপ্রিয় একটি আঞ্চলিক গান। হালে তরমুজ কেনার ক্ষেত্রে এই গানটি বেশ মিলে যায়। দোকানির কাছ থেকে বেশ ঢাউশ সাইজের তরমুজ কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন ক্রেতা। কিন্তু বাসায় ফিরে তরমুজ কেটে মুখে দিতেই মাথায় বাড়ি। মুখে দিতেই বোঝা গেল রসালো এই ফলটি বিষে ভরা। শুধু তরমুজ নয় মৌসুমি প্রায় সব ফলই এখন বিষে ভরা। বাজারে এখন কেমিক্যাল মিশ্রিত ফলই বেশি। অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাচ্ছে। কাজটি এমন কৌশলে করা হয় যাতে ক্রেতারা বুঝতে না পারে। রাসায়নিক মেশানোর পর একদিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। কোনোটার রঙ হয় গাঢ় হলুদ, কোনোটা আবার টকটকে লাল। বিক্রির জন্য তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয় দোকানে। জিভে জল আসার মত এই ফল দেখেই আকৃষ্ট হন ক্রেতারা। ফল ভেবে বিষ কিনে নিয়ে যান প্রিয়জনের জন্য। আম, কলা, পেঁপে, তরমুজসহ বেশিরভাগ ফলেই কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। সাধারণত উত্পাদন প্রক্রিয়ার শুরু হতে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো অবধি নানা পর্যায়ে জেনে না জেনে পোকা দমন, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি, ফল পাকানো এবং সংরক্ষণের জন্য প্রাণঘাতী রাসায়নিক ব্যবহূত হয়। অপরিপক্ব ফলে মাত্রাতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে তা দ্রুত পাকানো হয়। দ্রুত পচন ঠেকাতেও কেমিক্যাল মেশানো হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন যেসব ফল বাজারজাত করা হয়, তার ৯০ শতাংশই বিষে ভরা। অধিক মুনাফা লাভের আশায় অসাধু ফল ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে এই অপকর্ম চালিয়ে আসছে। অথচ বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যসম্মত উপায়েই ফল সংরক্ষণ করা যায়। এই বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান। চিকিত্সা বিজ্ঞানী, খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকারক রাসায়নিক মেশানো ফল খাইয়ে ক্রমেই মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্সের অধ্যাপক ড. আখতারুল ইসলাম বলেন, বিষাক্ত ফল খেলে প্রাথমিক পর্যায়ে জন্ডিস, পেট ব্যথা, বমি হওয়া, ডায়রিয়া, বুক জ্বালা-পোড়াসহ শরীরে বিভিন্ন প্রদাহ হতে পারে। পরে লিভারে জটিল রোগ, কিডনি সমস্যা, পাকস্থলী ও অন্ত্রে ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি বলেন, বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর কারণে ফলের পুষ্টিগুণ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ভিটামিন নষ্ট হয়। ইতোমধ্যে মৌসুমি তরমুজে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানীর প্রতিটি ফুটপাত, বাজার থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার। পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। শহরে ভ্যানে করে ?অলিতে-গলিতেও তরমুজ বিক্রি করছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তবে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরাই মূলত রাতের আঁধারে আড়তেই তরমুজের বোটায় পুশ করছেন এক ধরনের বিষাক্ত রঙিন কেমিক্যাল। এদিকে গত ১০ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার পৌর এলাকায় তরমুজ খেয়ে ফাহিম (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ফাহিমের পরিবারের আরো পাঁচ সদস্য। ফাহিম পৌর এলাকার চরকাগমারা গ্রামের বাবু মিয়ার ছেলে। জানা গেছে, ঘটনার দিন মোমিন বাজার থেকে একটি তরমুজ কিনে বাড়িতে নিয়ে যান বাবু মিয়া। সেই তরমুজটি পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে খান তারা। এর পরপরই শিশু ফাহিমসহ ছয়জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে ফাহিমের মৃত্যু হয়। শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, অসময়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল খেলে শিশুদের বমি, জন্ডিস, পেটের পীড়া হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদেরও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। শিশুর ক্যান্সার, বিকলাঙ্গ এবং হাবাগোবা হওয়ার মতো জটিল রোগও হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। শিশুরাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এসবের পেছনে বিষযুক্ত খাবারের প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আকরাম হোসাইন বলেন, বিষে ভরা ফল খেলে শিশুদের লিউকোমিয়া, লিমপোমাসহ লিভার, কিডনি ও পাকস্থলিতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এদিকে মৌসুমি ফল বিষমুক্ত করার দাবি জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। সংগঠনের পক্ষ থেকে গত শুক্রবার বলা হয়, কয়েকদিনের মধ্যেই বাজারে আম, লিচু, জাম, আনারস, কাঁঠালসহ নানা সুস্বাদু ও তৃপ্তিদায়ক ফল বাজারে আসতে শুরু করবে। কিন্তু নিরাপদ মৌসুমি ফল পাওয়া নিয়ে জনমনে শঙ্কা কাটছে না। কারণ গত কয়েক বছর মৌসুমি ফল উত্পাদনে ব্যাপকভাবে বিষের ব্যবহার হয়েছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. ফরমুজুল হক বলেন, মৌসুমি ফলের মাসে আমরা সন্তানদের ফল খাওয়াতে শঙ্কিত হচ্ছি। ফল উত্পাদন থেকে শুরু করে বাজারে আসা পর্যন্ত যত পর্যায়ে কীটনাশক মেশানো হয় সবগুলো পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। পবা খাদ্যে ভেজাল বন্ধে ১০টি সুপারিশ করেছে। সেগুলো হলো- কৃষি উত্পাদন থেকে জোগানের প্রতিটি ধাপে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। খাদ্যে ক্ষতিকর সব ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ ও নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫ দ্রুত বাস্তবায়ন। প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন। জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও কৃষি আদালত গঠন। নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন। দেশের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমদানি। খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ। দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ও একে জনপ্রিয় করে তোলা।

Source: www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2016/04/26/116274

Photo Source: www.beextrahealthynow.com