হিজলের খোঁজে বোটানিক্যাল গার্ডেনে একদিন
ছাত্র জীবনে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা না দিতে পারলে মনে হতো কি যেন অপূর্ণ রয়ে গেলো।এমনি এক আড্ডায় আমার বন্ধু একদিন কানে কানে বললো আমি যেন আগামী কাল সকাল ১০ টায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেইটে থাকি। তার কথামত গিয়ে দেখি সে একজন মেয়ে বন্ধু কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা মাত্র তিনজন বাগানে প্রবেশ করেই ডান দিকে লেকের পাশে হিজল গাছের তলায় বসে গল্প করছি এমন সময় ৭-৮ বছর বয়সের এক বালক (বাদাম ওয়ালা) এসে আমার বন্ধুকে ও তার বান্ধবীকে কিছু বাদাম ক্রয় করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করতে লাগলো কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে বাদামওয়ালা বললো স্যার গতকাল যে আপাকে নিয়ে এসেছিলেন সে অনেক ভাল ছিলো, অনেক বাদাম কিনেছিলো আমাকে বকশিশ দিয়েছিলো কিন্তু আজকের আপা কোন কথাই শুনলেন না। সুধী পাঠক তারপর ঘটনা কি ঘটেছিলো অনুমান করে নিবেন আশা করি আমাকে কেউ প্রশ্ন করবেন না ও ভগ্নিরা আমায় ক্ষমা করবেন….!
আমি যতবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাই ততবারই সেই ঘটনা ও সেই দিনের দৃশ্যাবলী চোখে ভাসে আর একা একা হাসি আজও হিজল ফুল দেখতে গিয়েছিলাম বেশ কিছু সময় হিজলের তলায় ঝিলের পাশে একা একা বিভিন্ন পাখির সুরেলা কন্ঠে গানের সাথে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করছিলাম যদিও ঢুকেই মন খারাপ হয়েছে কারন হিজলের ফুল দেখার সময় আরো ১৫-১৬ দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আমার বন্ধু,তার বান্ধবী ও বাদামওয়ালার স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় হিজল দেখতে না পারার কস্ট কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম।
তারপর সেখান থেকে পবন ঝাউ বনের রাস্তা ধরে চলে গেলাম আন্তর্জাতিক বাগানে সেখানে বেশ কিছু দুর্লভ গাছ দেখতে দেখতে সারাদিন আর একবারের জন্যও হিজলের কথা মনে পড়েনি। এই উদ্যানটি একটি জীবন্ত উদ্ভিদ সংগ্রহশালা। সেমিপ্যারাসাইটক শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, কর্পুর,বাজনা,বুদ্ধ নারিকেল,উদয়পদ্ম,
নাগলিঙ্গম প্রভৃতি বৃক্ষরাজী ও পদ্ম পুকুরে পদ্মের হাসি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
তারপর উদ্যানের পরিচালক মহোদয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম আমার পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে বাগান সম্পর্কে জানতে চাইলাম তিনি আমাকে যে সব তত্ব ও তথ্য দিলেন তার সামান্য আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। বাগানটি মোট আয়তন ২০৮ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত, যার সীমানা দেয়াল প্রায় ৫কিমি,অভ্যন্তরীন ফুটপাত ৭.৬৭৪ কিমি। যেখানে ১১৫টি পরিবার,৪৫১টি গন,৯০৮টি প্রজাতি ও ৩০২ রকমের গোলাপ আছে। এই বলে তিনি চা এর অর্ডার দিয়ে চায়ের কাপে ঠোট ভিজিয়ে বলতে লাগলেন এই বাগানে বৃক্ষ জাতীয় ২৯৬ টি প্রজাতি আছে যার মোট উদ্ভিদের সংখ্যা ২৮১০০টি, ঝোপ জাতীয় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা ৮৩৫২টি, লতা জাতীয় ৫৫টি প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা ৪৬৫৬টি, তৃণ জাতীয় ২৫৭টি প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা ১৫১৭টি, অর্কিড জাতীয় ৮০টি প্রজাতির উদ্ভিদের সংখ্যা ২০০০টি, ক্যাকটাসের সংখ্যা ৪০০০টি এবং গোলাপের সংখ্যা ৭৫০০টি। মোট উদ্ভিদের সংখ্যা ৫৬১২৫টি। এছাড়াও এখানে বিশেষ কিছু বাগান আছে যেমন পাইন বাগান, পাম বাগান, শাল বাগান, বাঁশ বাগান, বেত বাগান, চা বাগান, জবা বাগান, ঔষধি উদ্ভিদ বাগান, বিদেশী উদ্ভিদ বাগান ও জারুল বাগান। এখানে বিদেশী উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৬৬৫টি।
বাস্তুতান্তিক ভাবে এই উদ্ভিদ উদ্যান একটি উন্নত বৈচিত্র সমৃদ্ধ ভূমিরুপ বা বাসস্থান, যেখানে উঁচু- নিচু ভূমিরুপ, গভীর-অগভীর জলাশয়, ছোট-বড় জলাভূমি এবং প্রাকৃতিক বনভূমি গড়ে উঠার উপযোগী বাস্তুতন্তু বিদ্যমান। উদ্যানের জলাভূমির মধ্যে কোনটা প্রাকৃতিক ভাবে আবার কোনটা কৃত্রিম ভাবে গড়ে উঠেছে। জলাভূমিগুলিতে ভাসমান নিমজ্জিত অর্ধনিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ প্রচুর দেখা যায়। এ ছাড়া শক্তি সাগর ও অচিন বৃক্ষ এই উদ্যানের ঐতিহ্যবাহী অংশ। মিরপুর আব্দুল্লাহপুর বেড়ীবাঁধের কারনে এই বিশেষ অংশটি উদ্যান থেকে বিচ্ছিন্ন। তুরাগ নদীর পাড়ে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের কোণে একটি সার্ধশতবর্ষী বট বৃক্ষকে ঘিরে গড়ে উঠা এ স্থানটি একটি অপরুপ সৌন্দর্যের আধার। শত শত বটের ঝুরি শক্তি সাগর নামক কিংবদন্তী সম পুকুরটির পাড়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছায়া বিস্তার করে আছে যুগ যুগান্তর ধরে।
বিকালের হালকা আলোতে আবারো পদ্মপুকুরে যাবার ইচ্ছে হলো যেতে যতে রাস্তার দু’ধারে ক’টি বাজনা গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম এর পাতা ও ফল পিষলে এত সুন্দর সুগন্ধি ছড়ায় যে নিমিষেই আপনার ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। এই গাছের কান্ডে বেশ বড় বড় কাটা থাকে কাটা ভেঙ্গে নিলে নিচের দিকে সোলার মত হালকা অংশ পাওয়া যায় আগেকার দিনে এই কাটার নিচের অংশ সমান করে সেখানে খোদাই করে স্ট্যাম প্যাড তৈরি করা হতো। এছাড়াও এর বীজ থেকে সুগন্ধি ভোজ্য তেল পাওয়া যায়।
পদ্ম পুকুরের আগেই “এরো পয়জন ট্রির” খোঁজে গেলাম কারন এর ফুলের রস এতটাই বিষাক্ত যে এর রস বন্য প্রাণী শিকারের সময় তীরের মাথায় লাগিয়ে তীর ছোড়া হয় যাতে প্রানীটি সহজেই ঢলে পড়ে। তাই এই গাছটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু পাইনি, পেয়ে গেলাম রঙ গাছ যাকে বনমালী, দারুহরিদ্রা নামেও ডাকা হয়(Morinda angustifolia Roxb) খুবই সুগন্ধী যুক্ত সাদা ফুলে পিঁপড়ার নাচন দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এতে প্রচুর নেকটার আছে। এর পরেই দেখা পেলাম তেল কাকড়া নামক হলুদ ফল বিশিস্ট এক উদ্ভিদের সাথে অজস্র ফলে ছেয়ে আছে বৃক্ষের প্রতিটি ডালপালা। পদ্মপুকুরের পাশেই দেখা পেলাম বাংলাদেশের একমাত্র বাঁশ পাতা গাছ যাকে Pencil wood tree বলা হয়। অবশেষে আবারো পদ্মপুকুরে নেমে গেলাম সন্ধার আগে পড়ন্ত আলোতে প্রতিটি পদ্মফুলকে এতটাই অপূর্ব লাগছিলো যে মন চাইছিলোনা এদের ছেড়ে আসি। শুধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিক্ষাত ক’টি চরণ বার বার মনে পড়ছিলো।
মামাবাড়ির মাঝি নাদের
আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল
দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর
ভ্রমর খেলা করে !
তার পরও কি আর হিজল ফুল দেখতে না পারার কস্ট থাকতে পারে?
ছবিঃ লেখক নিজের।