সাক্ষাৎকার: জনাব শাহজাহান মিয়া
বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান প্রখ্যাত সাংবাদিক এম শাহজাহান মিয়া তৎকালীন পাকিস্তান আমলে কম্পিউটারের লোভনীয় চাকুরি ছেড়ে মনের গভীর লালিত ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। মেধা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখে তিনি সাংবাদিকতায় তার অবস্থান সুদৃঢ় করেন। সততা, সাহসিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাংবাদিকদের দাবী-দাওয়া আদায়ে ও পেশার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে আপসহীন, অবিচল ও নির্ভীক এই ত্যাগী সাংবাদিক এক সময় নিজেকে সাংবাদিক সমাজের একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। জনহিতকর কাজে বাবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ শাহজাহান মিয়া বাবার মত তার এলাকায়ও কাজ করেন। নিজ এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া চিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধ হয়ে আরাম আয়েশে জীবন কাটানোর হাতছানি উপেক্ষা করে সম্মান অর্জনে একাগ্র ও একনিষ্ঠ থেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন। অত্যন্ত বর্নাঢ্য জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তিটির ছোটবেলা থেকেই ছিল খেলাধুলা, গান-বাজনা ও নাটকের প্রতি দারুন ঝোঁক।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখর রায়
নেচার স্টাডি: আপনার ছেলেবেলা ও লেখাপড়া সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া: ১৯৪৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার লৌহজং উপজেলার খিদিরপাড়া ইউনিয়নের কাজিরগাঁও গ্রামে আমি জন্মগ্রহন করি। আমাদের গ্রামের শতাধিক বছর পূর্বে নির্মিত ও পরে ১৯৬১ সালে আমার পিতা সুজাতুল ইসলাম কর্তৃক তার নিজের জায়গায় পুনঃনির্মিত স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে পাশের টংগিবাড়ি থানার আড়িয়াল স্বর্ণময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৫৫ সালে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হই। অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা পরিচালিত স্কুলটি তৎকালীন মুন্সীগঞ্জ সাব ডিভিশনে খুব নামকরা ছিল। তৎকালে আমার মরহুম বাবাও এলাকার একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। বিভিন্ন সমাজ হিতকর কাজ ছাড়াও তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অংশগ্রহন করতেন। তারই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বাল্যকালেই আমি সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারি। ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। ঢাকা কলেজে ছাত্রাবস্থায় আমি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে (বাফা) বছর-খানেক সংগীতে শিক্ষাগ্রহন করি। ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ও ১৯৬৭ সালে মাস্টার্স করি। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় চাকুরীকালীন অবস্থায় ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা ও ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স করি। ১৯৮০ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানী সরকারের বৃত্তি নিয়ে ঐ দেশ থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করি। জার্মানীতে তিনমাস অবস্থানকালে আমি জার্মান ভাষাও শিখি।
নেচার স্টাডি: আপনার পেশাগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া : ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করে আমি তৎকালীন ইউবিএল (বর্তমানে জনতা) ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ই.ডব্লিউ.পি এসোসিয়েটস্-এর কম্পিউটার ডিভিশনে চাকুরী নিই। অত্যন্ত দক্ষদার সঙ্গে কম্পিউটার সার্ভিসে মাসিক পাঁচশত টাকা বেতনে ডকুমেন্টস অফিসার হিসেবে কাজ করতে থাকলেও সাংবাদিকতা পেশার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষন আমাকে ১৯৭০ সালে অধুনালুপ্ত ইংরেজী দৈনিক ‘দি পিপল’পত্রিকায় মাত্র তিনশত পঞ্চাশ টাকা বেতনে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। উল্লেখ্য, ঐ সময়ে ১৫০ টাকায় পাঁচ মণ চাল কেনা যেত। অচিরেই আমি পত্রিকাটিতে শিফট্-ইন-চার্জ হিসেবে পদোন্নতি পাই এবং ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঐ পত্রিকায় যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি। আসলে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছাটি আমার হৃদয়ের গভীরে লালন করতাম। ১৯৭৩ সালে বা.স.স.-এ চাকুরীরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত বি.সি.এস. পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েও ফরেন সার্ভিস না দেয়ায় আমি আমার প্রিয় পেশা সাংবাদিকতায়ই গভীরভাবে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে আমি সহ-সম্পাদক/রিপোর্টার হিসেবে বা.স.স.-এ যোগ দিই। এডিটিং-এ সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করলেও একজন রিপোর্টার হিসেবেও আমার রয়েছে দু’টি অনন্য কৃতিত্ব। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ থেকে প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো তার বিরুদ্ধে সেদেশের পার্লামেন্টে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব ১২৪ থেকে ১২৬ ভোটে পরাজিত করে ক্ষমতায় টিঁকে থাকবেন বলে আমার সাহসী মন্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, এ.এফ.পি. এবং এ.পি. এ বিষয়ে তেমন কোন সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দিতে পারেনি। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে দিল্লী থেকে পাঠানো আমার আরেকটি রিপোর্টে ভারতের পরবর্তী বাজেট সেশনের পূর্বেই তৎকালীন চন্দ্রশেখর সরকারের পতনের কথাও সঠিক হয়েছিল।
একজন রিপোর্টার হিসেবে আমি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানী, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ইরাক ও কুয়েতসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমন করেছি। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের গভীর রাজনৈতিক সংকট, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও এশিয়ান গেমস্সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করেছি। বেনজীর ভুট্টো, বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ম্যারী ম্যাকগ্ররী, ইমরান খান ও বিশিষ্ট ক্রিকেট ভাষ্যকার ওমর কোরেশীসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির ইন্টারভিউ করেছি। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইংরেজী ও বাংলায় নিয়মিত লিখছি। একজন রিসোর্স পারসন হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে আমাকে সাংবাদিকতার ওপর বক্তব্য রাখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে আমি আমেরিকাসহ আরো কয়েকটি দেশে নিয়মিত অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের ভূমিকা’ – এ ধরনের অনেক কনফারেন্স ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি।
নেচার স্টাডি: আমরা জানি যে আপনি পাঁচবার ডিউজে (ঢাকা সাংবাদিক ই্উনিয়ন)-এর প্রেসিডেন্ট পদটি অলংকৃত করেছেন। দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সাংবাদিকদের কি ভূমিকা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন।
নেচার স্টাডি: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে পাঁচ বার (বছরে ১ টার্ম) ঐক্যবদ্ধ ‘ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন’ (ডি.ইউ.জে)-এর নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। এর আগে ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে আমি দু’বার ডিইউজের সাধারন সম্পাদক ছিলাম। দুঃখের বিষয় আমাদের প্রাণপ্রিয় ইউনিয়ন ১৯৯৩ সালে ভেঙ্গে যায়। ইউনিয়ন দুই টুকরো হওয়ার ব্যাপারে আমি দায়ী না হলেও ঐ সময়ে ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম বলে দায়টা আমার ওপরই বেশি পড়ে। কারো ওপর দোষ না চাপিয়ে আমি নিজেই সে দায়ভার নিতে রাজি হই। পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে ‘বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন’ (বি.এফ.ইউ.জে) এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলো, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ভিত্তিক ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিল খুবই শক্তিশালী একটি সংগঠন। রাজধানী ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়ন, তাদের রুটি-রুজির সংগ্রাম চালিত করে বিভিন্ন ন্যায্য দাবী-দাওয়া আদায়ে এই ইউনিয়নটির ভূমিকা ছিল অনন্য।
আমরা সবাই জানি যে, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এই পেশায় নিয়োজিত লোকদের প্রধান এবং প্রথম কাজ হলো মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে তাদের অবহিত রাখা এবং আলোকিত করা। সাধারনত দেশের মানুষকে সেবা করার মিশন নিয়েই সাংবাদিকরা শক্ত হাতে কলম ধরতে প্রয়াসী হয়। অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, নিপীড়ন-নির্যাতন-শোষণসহ নানা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি তাদেরকে সমাজ-হিতকর কাজে উৎসাহিত করাও সাংবাদিকদের মহান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ একটি ব্যাপক ও বিশাল বিষয়। পরিবেশ বলতে সর্বপ্রথমে এবং প্রাথমিকভাবে আমি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন বনজ সম্পদ, গাছপালা এবং পাহাড়গুলো রক্ষাই বড় কাজ বলে বলতে চাই। একটি দেশের বনজ সম্পদ তার মোট ভূখন্ডের এক চতুর্থাংশ থাকা উচিত – কিন্তু আমাদের কত আছে? আমাদের যা আছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সংস্থা এর পরিমান ৬/৭ শতাংশ বলে উল্লেখ করলেও এর মোট পরিমান ৫ শতাংশ হবে বলেও অনেকেই মনে করেন না। ইদানিং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেশের লোকজন দেখেছেন, বনরক্ষকরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় কিভাবে বনজ সম্পদ উজাড় করে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ ও বিত্তবৈভব বৃদ্ধি করেছেন। সাংবাদিকদের উচিত এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরা। আমি বিশ্বাস করি তারা এই কাজটি যথাযথভাবেই করছেন। তারা শুধু গাছপালা কেটে বন উজাড় করার কুফল সম্পর্কেই লিখছেন না, বনায়নে দেশের এবং জনগনের মঙ্গলের কথাও লিখছেন। শহর-নগর-বন্দরে জলাবদ্ধতা, পয়ঃ ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে পরিবেশ দূষণের কবল থেকে জনগনকে মুক্ত রাখতেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের সমুদ্র-সীমার ভেতরে বিদেশীদের আনবিক বর্জ্য ফেলার বিষয়েও সরকারকে সতর্ক করে এদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে তাদের যথার্থ ভূমিকা রাখছেন।
নেচার স্টাডি: আমরা জানি যে আপনি দীর্ঘ সোয়া তিন বছর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস-মিনিষ্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া: আমি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০০০ সালের ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস-মিনিষ্টার পদে দায়িত্ব পালন করি। বিগত সরকারের তরফ থেকে আমাকে এই অফারটি দেয়া হলে আমি যথারীতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমার অপারগতার কথা জানাই এবং তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত একজন যোগ্য সাংবাদিকের নামও প্রস্তাব করি। দ্বিধা-দ্বন্দ সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের অনমনীয়তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে আমি শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করি।
আমেরিকার মতো দেশে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আরাম আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াশিংটন টাইমস ও ইউ.এস.এ. টুডের মত পত্রিকায় কিভাবে বাংলাদেশকে সার্থকভাবে তুলে ধরা যায় সেকাজে নিজেকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করি এবং মহান আল্লাহতা’লা আমাকে অনেক সাফল্য দেন।
গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় ২৩টি প্রতিবেদন ছাপাতে সমর্থ হই। দূতাবাসে প্রেস-মিনিস্টার পদে দায়িত্ব পালনকালে আমি ‘পুলিৎজার পুরষ্কার’ বিজয়ী ওয়াশিংটন পোস্টের প্রখ্যাত কলামিষ্ট ম্যারি ম্যাকগ্ররি, ওয়াশিংটন টাইমসের ডেভিড জোনস, মাইকেল মার্শাল, বেন বারবার এবং এবিসি নিউজ-এর কনি চংসহ আরো অনেক নামী-দামী আমেরিকান সাংবাদিকদের গভীর সান্নিধ্যে আসি।
নেচার স্টাডি: আমাদের নেচার স্টাডি ক্লাব ও নেচার স্টাডি সোসাইটির কার্যক্রম সম্পর্কে বলুন – এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি ?
শাহজাহান মিয়া: নটরডেম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, আমার বড় ছেলে সাদিক হাসান স্বরাজ, নেচার স্টাডি ক্লাব ও নেচার স্টাডি সোসাইটির সাথে জড়িত ছিল বলে এর কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারনা আমার আগে থেকেই ছিল। নেচার স্টাডি সোসাইটির চেয়ারম্যান আমার ছেলের শিক্ষক অনুজ প্রতিম অধ্যাপক মিজানুর রহমান ভূঁইয়াকে আমি অনেক আগে থেকেই জানি। বয়সে আমার বেশ ছোট হলেও বিভিন্ন গুণের অধিকারী ও নানা কাজে উদ্যোগ-উৎসাহ ও স্পৃহার জন্য তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর একদল উদ্যমী তরুন ও যুবক নিয়ে তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘নেচার স্টাডি ক্লাব’ ও সোসাইটি তার প্রশংসনীয় কার্যক্রমসমূহ চালিয়ে যাচ্ছে। পরম দয়ালু আল্লাহ্-সৃষ্ট মানুষ প্রকৃতির পরম পরশেই জীবন ধারন করছে। প্রকৃতির অন্যতম প্রধান উপকরণ ও উপাদান মাটি, বায়ু, পানি, গাছপালা ও জীবজন্তু সংরক্ষণসহ সার্বিক পরিবেশ বাঁচিয়ে রেখে মানবকল্যাণে ব্রতী এই সোসাইটির সেবাধর্মী ও মানবহিতকর কাজ সবারই ভাল লাগার কথা। আমি এই ক্লাব ও সোসাইটির সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে সাধুবাদ জানাই। তথ্য-সমৃদ্ধ একটি সুন্দর ম্যাগাজিন প্রকাশ সবার মিলিত প্রচেষ্টারই ফসল।
নেচার স্টাডি: অতীতে দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে বর্তমানের কি কি পার্থক্য আপনার চোখে ধরা পড়েছে ?
শাহজাহান মিয়া: অতীত মানে তো ৫০/৬০ বছর আগে দেখা এই ভূখন্ডের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের পার্থক্য অনেক। আগে দেশে বন-জঙ্গল, গাছপালা অনেক বেশি ছিল। এখন গাছপালা কেটে সাফ করে বসতবাড়ি, কলকারখানা বা চাষের জমি বানানো হচ্ছে। শহর-নগর-বন্দরের মধ্যে অবস্থিত খাল বন্ধ করে রাস্তা বা বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে দালন-কোঠা নির্মান করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিপর্যয়ে জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেশের বড় বড় নদ-নদীগুলো পলি পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য প্রতিবেশী ভারত কর্তৃক উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান এর মূল কারন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
নেচার স্টাডি: বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের কি করা উচিত ?
শাহজাহান মিয়া: পরিবেশ সংরক্ষণ একটি অত্যন্ত বড় ও কঠিন কাজ। দেশের জনগনকে বিশেষ করে নিভৃত পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বুঝিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। তবেই কাঙ্খিত ফল-লাভ কিছুটা হলেও সম্ভব হতে পারে।
নেচার স্টাডি: আপনার তরফ থেকে জনগণকে কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া: পরিবেশ রক্ষা করা মানে নিজেদেরই রক্ষা করা। প্রকৃতি-পরিবেশ এবং মানুষের জীবনধারন একই সূত্রে গাঁথা। তাই সুন্দর জীবন গড়া ও বাঁচার তাগিদ থেকেই পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করা জরুরী। প্রকৃতির পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ও নৈসর্গিক স্নিগ্ধতা রক্ষা ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা স্বর্গীয় কাজেরই দায়িত্ব। তাই দেশের প্রতিটি মানুষকেই প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সজাগ ও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। জীবনধারণে অনাবিল সুখলাভের জন্যই তা প্রয়োজন। পবিত্র কোরআন শরীফে বেহেশত্ সম্পর্কে বর্ননাকালে বলা হয়েছে সুন্দর সজীব বাগানের পাশ দিয়ে প্রবাহমান নদীর কথা।
নেচার স্টাডি: আপনার জীবনের স্মরনীয় কোন ঘটনা বলবেন কি ?
শাহজাহান মিয়া: ১৯৯৩ সালের মে মাসে বিশ্ব অলিম্পিক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জোহান এ্যান্টোনিও সামারাঞ্চ একদিনের সফরে বাংলাদেশে এলে আমি তাকে বিমানবন্দরে ২০০০ সালের অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠানের সম্মান বেইজিং বা সিডনী নগরীকে দেয়া হবে এ সংক্রান্ত কিছু তীক্ষ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নবানে জর্জরিত করলে বিশ্ব অলিম্পিক প্রধান এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, তিনি আমাকে ঐ বছর জুন মাসেই বিশ্ব অলিম্পিকের সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের লুজান শহর সফর করার আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ গ্রহন করে আমি অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ সুইজারল্যান্ড ঘুরে আসি। অথচ, আগের বছর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ থেকে অলিম্পিক অর্গানাইজিং কমিটি কর্তৃক একজন এ্যাক্রিডিটেড সাংবাদিক ও বাসস-এর মনোনিত প্রার্থী হিসেবে সরকারের মধ্যে অবস্থিত একটি স্বার্থানেষী মহলের কারসাজিতে আমি স্পেনের বার্সিলোনায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস কভার করতে ব্যর্থ হই। অলিম্পিক গেমস কভার করতে না পারলেও মহান আল্লাহতা’লার ইচ্ছায় আমি বিশ্ব অলিম্পিক প্রধানের আমন্ত্রণে বিশ্ব অলিম্পিক কাউন্সিলের সদর দপ্তর সফর করি।
বাসস-এর মনোনিত প্রার্থী হয়েও আমি ১৯৯৪ সালে জাপানের হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস কভার করতে পারিনি। তথ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত তৎকালীন মন্ত্রী ব্যরিষ্টার নাজমুল হুদা নিতান্ত ক্ষোভের বশেই ঐ সফরে যেতে আমাকে বাধা দেন। ১৯৯৩ সালের ৬ বা ৭ এপ্রিল পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকুরি নিয়ে যাওয়ার ঐ মন্ত্রী সাহেবের প্রস্তাব গ্রহন না করার ফলশ্রুতিতেই এই ঘটনা ঘটে বলে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি। মন্ত্রী মহোদয় আমাকে এই প্রস্তাব দেয়ার সময় তাদের আদর্শে বিশ্বাসী এক সাংবাদিক নেতা ঐ সময় তার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
নেচার স্টাডি: আপনার বিশেষ কোন স্বীকৃতি, সম্মাননা বা পুরষ্কার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া: পুরষ্কার প্রাপ্তি কোন কাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। তাছাড়া পুরষ্কার পাওয়ার মত কোন যোগ্যতা হয়তো এখনো আমি অর্জন করিনি বা যারা কাজের মূল্যায়ন করে পুরষ্কার প্রদান করেন, আমার নগন্য অর্জন হয়তো তাদের চোখে ধরা পড়েনি। তবে আমি মনে করি ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সনে বিপোর্টার হিসেবে আমার দু’টি বিরাট অর্জন অন্য কোন দেশে হলে তা আরো অনেক বেশি প্রশংসিত হতো। হয়তো ভাগ্যে পুরষ্কারও জুটতো।
নেচার স্টাডি: আপনার প্রকাশনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহজাহান মিয়া: ‘জ্বলছে দজলা ফোরাতের দেশ’ নামে আমার লেখা একটি বই বেরিয়েছে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা’র ওপর দু’টি বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। ইংরেজী ভাষায় একনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের জন্য এই মূহুর্তে আমি ‘ইংলিশ টু ইংলিশ’ একটি ছোট্ট অভিধান সংকলনের কাজে নিয়োজিত আছি।
নেচার স্টাডি: আজ আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারলাম। এজন্য ‘নিসর্গ’-এর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শাহজাহান মিয়া: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
(এ সাক্ষাৎকারটি প্রয়াত শেখর রায়ের নেয়া; সে এটি আমাদের ক্লাবের ২৫ বর্ষপূর্তি (রৌপ্য জয়ন্তি) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘নিসর্গে’র ২৫তম সংখ্যার জন্য ২০১০ সনে নিয়েছিল। জনাব শাহজাহান মিয়া দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিকদের অন্যতম; তিনি ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র ডঃ সাদিক হাসান স্বরাজ আমাদের সোসাইটির আজীবন সদস্য)