বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ

ভূমিকা

গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ শতকরা ৪ ভাগ বৈশ্বিক রোগের জন্য দায়ী এবং বাংলাদেশে ৪র্থ প্রধান মৃত্যুঝুঁকির কারণ। [1, 2] কঠিন জ্বালানীর ব্যবহার, গতানুগতিক চুলায় রান্না করা, গৃহ অভ্যন্তরে ধূমপান করা, অসচেতনতাসহ বিভিন্ন কারণে ঘরের ভেতরের বায়ু দূষিত হয়। মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা অধিক সময় ঘরে অবস্থান করার কারণে এ দূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের ফলে মারা যায়। বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ নিয়ে তুলনামূলক কম আলোচনা হওয়ায় এর ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কিভাবে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষিত হয়

কঠিন জ্বালানী বা গতানুগতিক চুলা দিয়ে উন্মুক্ত স্থানে রান্না করা বা তাপ দেয়া হলে অধিক মাত্রায় গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষিত হয়। ৯২ ভাগেরও বেশি বাড়িতে রান্নার কাজে কঠিন জৈব জ্বালানী ব্যবহার করা হয় যা থেকে কার্বন মনো-অক্সাইড, ফরমালডিহাইড, এবং অধিক পরিমাণে ক্ষতিকর বস্তুকণা (particulate matter) নির্গত হয়। বেশিরভাগ রান্নাঘরে উপযুক্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা না থাকার কারণে ঘরের ভেতর বস্তুকণার ঘনত্ব বেশি থাকে। কঠিন জ্বালানী ব্যবহার করা হয় এমন রান্নাঘরে বস্তুকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড থেকে ৩০-৩৫ গুণ বেশি থাকে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কারণ তারা শুধুমাত্র কঠিন জ্বালানীই ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। [1]

বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের বর্তমান অবস্থা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

৩৭.৯% নগরবাসী এবং ১% গ্রামবাসী রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার করেন যেখানে ৪৩.৫% নগরবাসী এবং ৪১.৫% গ্রামবাসী কাঠ ব্যবহার করেন। ১২.১% নগরবাসী এবং ৫১.৪% গ্রামবাসী খড়, পাতা, গোবর ইত্যাদি রান্নার কাজে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে প্রায় ৭৫% মানুষ গ্রামে বাস করেন, তাই এদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জৈব জ্বালানীর ব্যবহার ঘটে যা গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। [3]

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে প্রায় ১,০৭,০০০ জন মানুষ মারা যায়। ২০০৯ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪৬ হাজারেরও বেশি মানুষ গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে তীব্র নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করে। হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে ২০১৭ সালে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে যারা মারা যান তাদের বেশিরভাগই পঞ্চাশোর্ধ।

Figure 1: ১৯৯০ – ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের ফলে বয়সভিত্তিক মৃত্যু [4]

নারী ও শিশুরা গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় যেহেতু তারা বেশিরভাগ সময় ঘরে অবস্থান করে। গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭০ ভাগই শিশু। গবেষণায় গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের ফুস্ফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের কারণে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া, অ্যাসমা, কম জন্মকালীন ওজন, হৃদ-সংবহনতান্ত্রীক কার্যবিপত্তি, এবং যক্ষার ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সকল রোগের মধ্যে ৪ ভাগের জন্যই গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ দায়ী। কাঠ, প্রাণীর বিষ্ঠা, এবং অন্যান্য কঠিন জৈব জ্বালানী থেকে যে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ হয় তা তীব্র নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণের প্রধান কারণ।[1, 2, 5, 6]

Figure 2. ২০১৭ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু ও বিকলাঙ্গতার প্রধান ঝুঁকিসমূহ (HAP: Household Air Pollution)[2]

এশিয়া এবং আফ্রিকাতে শিশুদের ৫৯ শতাংশ অপরিণত মৃত্যুর জন্য দায়ী তীব্র নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসনালীর সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ১৬-২০ লাখ মানুষ মারা যায় যার মধ্যে প্রায় ১০ লাখই শিশু।[1]

বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ রোধে গৃহিত পদক্ষেপ ও করণীয়

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এনভাইরনমেন্টাল হেলথ সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান জোসেফ গ্রাজিয়ানো এর মতে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের ঝুঁকি কমানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল উপযুক্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা। [1] অর্থনীতিবিদ বিজর্ন লার্সেন এর মতে দুটি উপায়ে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ কমানো যেতে পারেঃ ১. মানুষ যে কঠিন জ্বালানীগুলো ব্যবহার করছে সেগুলোই ব্যবহার করবে, তবে আরও কার্যকর চুলা ব্যবহার করবে যেগুলো অনেক কম দূষণ ঘটাবে, অথবা ২. মানুষ তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (LPG) ব্যবহার করবে যা অনেক পরিষ্কারভাবে পুড়ে। গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ুর মান উন্নত করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল উন্নত জৈবজ্বালানী চুলাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা। এটি কেবল একটি আবদ্ধ চুলা যেটি বেশিরভাগ সময় একটি চিমনি সহ থাকে যা তাপ হারানো রোধ করে, বাতাস থেকে রক্ষা করে, এবং রান্নার পাত্রে গতানুগতিক চুলা বা উন্মুক্ত আগুন থেকে কার্যকরভাবে তাপ স্থানান্তর করে। দুটি চুল্লি এবং একটি চিমনি সহ বাংলাদেশে এই চুলাটির ব্যয় প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার টাকা।[7]

যদি ৩ কোটি পরিবার উন্নত চুলাতে চলে যায় তাহলে এটি প্রতিবছর প্রায় ৩৩ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। চুলাগুলো কার্যকর হওয়ায় প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন ১৫ মিনিট রান্নার সময় সাশ্রয় করতে পারবে এবং আগের থেকে অর্ধেক সময়ে জ্বালানী সংগ্রহ করতে পারবে। মোটের ওপর, এই চুলাতে ১ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতিটি পরিবার ৫ হাজার টাকা সমমূল্যের স্বাস্থ্য ও সময় সাশ্রয় সুবিধা পাবে।[7]

তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস ব্যবহারে বছরে ৯১ হাজার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব, যদিও এটি কিছুটা ব্যয়বহুল। এই চুলাতে ১২ হাজার টাকা বিনিয়োগে প্রতিটি পরিবার ১২ হাজার টাকা সমমূল্যের স্বাস্থ্য ও সময় সাশ্রয় সুবিধা পাবে। তাই বর্তমানে উন্নত জৈবজ্বালানী চুলা ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হলেও দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পেতে হলে আমাদের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।[7]

ইম্প্রুভড কুকস্টোভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লক্ষ পরিষ্কার ও কার্যকর চুলা স্থাপন করেছে যা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। [5]

উপসংহার

গতানুগতিক চুলা ও কঠিন জ্বালানীর ব্যবহার গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ এবং এর সাথে জরিত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও সময়ের সাথে গতানুগতিক চুলা ও কঠিন জ্বালানীর ব্যবহার কমার কারণে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ কমছে, তারপরও এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ কমাতে কাজ করছে। এসব সংস্থার উপযুক্ত পদক্ষেপ ও কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ এবং এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনা প্রয়োজন।

Reference:

1.      Humanitarian, T., Indoor air pollution kills thousands every year, in The Humanitarian. 18 June 2009.https://www.thenewhumanitarian.org/report/84900/bangladesh-indoor-air-pollution-kills-thousands-every-year#:~:text=Over%2046%2C000%20people%20die%20of,World%20Health%20Organization%20(WHO).&text=Some%204%20percent%20of%20all,can%20be%20attributed%20to%20IAP

2.      Institute, H.E., State of Global Air/2017, Bangladesh. 2019

3.      Dey NC, A.A., Arif T, Ahmed SM, Women’s Knowledge and Perceived Health Effects from Exposure to Indoor Air Pollution: Findings from a Population-based Crosssectional Survey in Rural Bangladesh. Journal of Health Science & Education, 2017. 1(1): p. 1-5.

4.      Ritchie, H. and M. Roser, Indoor Air Pollution. 2013, OurWorldInData.org

5.      Bank, T.W., Bangladesh: Healthier Homes through Improved Cookctoves. 2018

6.      Shyfuddin Ahmed, M.A.H.C., Mohammad Hasan Shahriar, Mahbubul Eunus,, B.A.B. Shirmin Bintay Kader, Golam Sarwar, Tariqul Islam, Rubhana Raqib, Dewan Shamsul Alam,, and H.A. Faruque Parvez, and Mohammad Yunus, Personal Exposure to Household Air Pollution and Lung Function in Rural Bangladesh: A Population Based Cross-Sectional Study. Environmental Health Perspectives, 2018.

7.      Larsen, B., Benefits and costs of household cooking options for air pollution control, Bangladesh Priorities. 2016, Copenhagen Consensus Center