তরমুজের ইতিহাস

তরমুজ একটি ফারসি শব্দ। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হলো Citrullus lanatus যা Cucurbitaceae পরিবার(কুমড়া পরিবার) ভুক্ত লতানো উদ্ভিদ। এর বাংলা আভিধানিক কোন অর্থ নেই। বিদেশী যত শব্দ আমাদের বাঙলা ভাষায় স্থান দখল করে নিয়েছে তার মধ্যে তরমুজ অন্যতম। কালের পরিক্রমায় আজ এই বিদেশী শব্দটাই আমাদের নিজস্ব শব্দে পরিনত হয়েছে। তরমুজ সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। তবে এর উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। বিজ্ঞানিদের মতে প্রায় এক হাজার প্রজাতির তরমুজ আছে। তরমুজের সব অংশই বেশ জনপ্রিয় খাদ্য তবে এটি রূপচর্চায় যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই দিক থেকে যদি চিন্তা করা যায় তাহলে হয়তো ভেসে উঠবে মুখের ত্বকে তরমুজ ঘষতে থাকা আপনার কোনো বান্ধবীর ছবি, যার সঙ্গে এখন হয়তো আপনার আর যোগাযোগ নেই।

সবকিছু ধূসর স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেও তরমুজ এখনো আপনার চোখ আর রসনার তৃপ্তি মেটাতে রয়েই গেছে।পশ্চিম আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাকি মিসর কোনটি তরমুজের জন্মভূমি, সেটি নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানির মতে সিয়েরালিওন আফ্রিকার যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই পশ্চিম আফ্রিকাই নাকি তরমুজের জন্মভূমি হিসেবে খ্যাত। এটা শুধু বিজ্ঞানি মহলে নয় পশ্চিম আফ্রিকার জনগোষ্ঠী গর্বের সাথে বলে তরমুজ তাদের নিজস্ব ফল। এই কারনেই পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাপ্ত তরমুজ নিয়ে একটি জনশ্রুতি চালু আছে যে, সেই এলাকায় উৎপাদিত তরমুজের গুনমান স্বাদ পৃথিবী বিখ্যাত। তবে নাইজেরিয়া, নাইজার, সেনেগাল, আইভরি কোস্টসহ পশ্চিম আফ্রিকার ১৭টি দেশের কোনটি তরমুজের আদিভূমি, তা বলা খুবই মুশকিল। কিন্তু ইসরায়েলের গবেষক হ্যারি প্যারিস অনুমান করেছেন, প্রাচীন মিসরও তরমুজের আদিভূমি হতে পারে। প্রাচীন মিসরীয়দের তরমুজ চাষের ছবি দেখে তিনি বলতে চেয়েছেন, মিসরীয়দের কৃষির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো এবং এটি পশ্চিম আফ্রিকার কৃষির চেয়েও প্রাচীন। প্রাচীন মিসরের দ্বাদশ রাজবংশের রাজার শাসনামলে তরমুজের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া তুতেনখামেনের সমাধির গায়ে তরমুজের চিত্র দেখা যায়। আবার অনেকের ধারনা উত্তর আফ্রিকার স্থানীয় “গুরুম”(Citrullus lanatus var. citroides) ফলই হলো বর্তমান আধুনিক তরমুজের পূর্বপুরুষ। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় তরমুজের আদি বাসস্থান মিসর। আবার উত্তর আফ্রিকার গুরুম কে বিবেচনা করলে বলতে হয় ভিন্ন কথা। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্যালিওবোটানিস্টদের মতে, তরমুজের সাথে বিভিন্ন জাতীয় সিট্রুলাস প্রজাতির ক্ষুদ্র বুনো প্রতিনিধিদের প্রচলিত অনেক মিল রয়েছে, যা এখনও দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক এবং জাম্বিয়া, নামিবিয়া এবং বোটসওয়ানা প্রান্তরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই দেশগুলিতেই তরমুজের জিনগত বিভিন্ন রূপের সর্বাধিক সংখ্যক প্রকাশ ঘটেছিলো, এতে তিক্ত, তাজা এবং সামান্য মিষ্টি মাংসল তরমুজের মত এক প্রকার ফল পাওয়া যেতো। অনেকের মতে তারপর থেকেই খাদ্যে ব্যবহৃত সংস্কৃতি হিসাবে তরমুজের ইতিহাস শুরু হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্যালিওবোটানিস্টদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে বলা যায় তরমুজের আদি বাসস্থান দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, নামিবিয়া বোটসওয়ানা প্রান্তরের কোন একটা দেশে হবে। তবে বিভিন্ন তত্ত্ব তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করলে একেক বিশ্লেষণ থেকে একেক রকমের ধারণা পাওয়া যায়।প্যালিওবোটানিস্টদের মতে জিনগত যে ধারণাটি পাওয়া যায় তা অনেক যুক্তিযুক্ত ও গ্রহনযোগ্য মনে হয়।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল”। তরমুজের জন্ম যেখানেই হোক আর এর জন্ম নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুকনা কেন! তরমুজ কিন্তু বিশেষ উপকারী বেরী জাতীয় একটি ফল। তরমুজে সিট্রোলিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিডের পরিমাণ এতো বেশি যে, আগে বিজ্ঞানীরা ধারণাও করতে পারেননি। কারণ বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, সিট্রোলিন সাধারণতঃ ফলের অখাদ্য অংশেই বেশি থাকে। সাম্প্রতিক গবেষনায় বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন তরমুজে সিট্রোলিন আছে, এটা আমাদের জানা কথা। কিন্তু এটা জানতাম না যে, সিট্রোলিনের পরিমাণ তাতে এতো বেশি থাকতে পারে! গবেষকরা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, মানবদেহ সিট্রোলিনকে আরজিনিনিন নামের যৌগ পদার্থে রূপান্তরিত করে। আরজিনিনিন হচ্ছে ভিন্ন মাত্রার অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা নাইট্রিক অ্যাসিডের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে। আবার নাইট্রিক এসিড দেহের রক্তবাহী শিরা বা ধমনীর প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর রক্তবাহী শিরা বা ধমনীর প্রসারণের কারণেই মানুষ বেশ উপকৃত হয়। ভায়াগ্রা (সিলডিনিফিল সাইট্রেট) সেবনের ফলে যেমন মানব দেহের রক্তবাহী শিরা বা ধমনীর প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ Erectile dysfunction এ কাজ করে। ঠিক তেমনি তরমুজে নাইট্রিক এসিডের(সিট্রোলিনের)আধিক্যের কারনে একই রকমের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ দেহের নাইট্রিক এসিডকে সক্রিয় করার মাধ্যমে কৃত্রিম পন্থায় দেহে জৈবিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি, জৈবিক তাড়না সৃষ্টি করতে একজন অক্ষম পুরুষকে ঠিক কত পরিমাণ তরমুজ গিলতে হবে।তরমুজ আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। তরমুজে আছে প্রচুর ভিটামিন-এ। আর এটি ত্বকের সুস্থতা রক্ষায় খুবই প্রয়োজনীয়। এ ছাড়া এটি ভিটামিন-সি এর উৎস, যা ত্বকের কোলাজেন কলার (Tissue) নমনীয়তা বজায় রাখে ও ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া (Delay ageing process) রোধ করে। এক কাপ তরমুজ কুচিতে আপনি পেয়ে যাবেন সারা দিনের চাহিদার ২১ শতাংশ ভিটামিন- সি এবং ১৭ শতাংশ ভিটামিন-এ। সবচেয়ে বড় কথা, এই গরমে ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করা খুবই দরকার। যেহেতু তরমুজে ৯২ শতাংশই পানি সুতরাং গরমে তরমুজ খেলে ত্বকের আর্দ্রতা নষ্ট হবে না। সব মিলিয়ে বলা যায়, ত্বকের সুস্থতার জন্য তরমুজ মোটামুটি অপরিহার্য একটি ফল।

আমরা শুধু তরমুজের ভিতরের লাল অংশটিই(Endosperm)খেয়ে থাকি এবং বীজগুলো ফেলে দেই কিন্তু এর বীজ আমাদের দেহের জন্য অনেক উপকারী। শুকিয়ে ভেজে খেতে পারেন। অথবা রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন। প্রচুর ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রনে ভরপুর এই তরমুজের বীজ আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। তরমুজের বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন যা চুলের জন্য অনেক বেশি কার্যকরী। এছাড়াও উপস্থিত অ্যামিনো এসিড চুলকে মজবুত করে তুলে। তরমুজ বীজে মেলানিন নামক পিগমেন্ট আছে যা চুলের রঙ কালো রাখতে সাহায্য করে। তাই তরমুজের বীজ ভাজা প্রতিদিন খাওয়ার অভ্যাস করলে চুল সাদা হওয়ার সমস্যাও দূর হবে।

টীকাঃ

(১)Erectile dysfunction– যৌন সঙ্গমের জন্য পুরুষ যৌনাঙ্গ প্রয়োজনানুসারে খাড়া ও শক্ত না হওয়া ও সঙ্গিনীকে satisfying sexual activity দিতে না পারাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Erectile dysfunction বলে।
(২)কোলাজেন– প্রাণী দেহে অনেক বেশি পরিমানে উপস্থিত এক প্রকার প্রোটিন। একে প্রোটিন ফাইবার বলা হয় যা আমাদের শরীরের কানেকটিভ টিস্যুতে (যেমন কার্টিলেজ,টেন্ডন,হাড় ও লিগামেন্ট) উপস্থিত থাকে।
(৩)প্যালিওবোটানি- এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে অতীত যুগে বিদ্যমান উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ বা অবশেষ নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। এই বিজ্ঞানে বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব বিশ্লেষণ এবং পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক অতীতের জলবায়ুগত বিশ্লেষণ নিয়েও কাজ করা হয়।এই বিজ্ঞানটি ম্যাক্রোস্কোপিক এবং মাইক্রোস্কোপিক স্তরে উদ্ভিদের জীবাশ্ম(ফসিল) নিয়ে অধ্যয়ন করে। ম্যাক্রো স্তরটি পাতা এবং কাণ্ডের দিকে মনোনিবেশ করে, অন্যদিকে মাইক্রো পরাগ এবং স্পোরগুলির মতো উপাদান গুলিরও বিশ্লেষণ করে।