ধ্বংসের মুখে নারিকেল জিঞ্জিরা
অপূর্ব সুন্দর বাংলাদেশ, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই বাংলাদেশকে সৃষ্টিকর্তা সাজিয়েছেন অকৃত্রিমভাবে, দিয়েছেন বিপুল প্রাকৃতিক আর খনিজ সম্পদ কিন্তু তা সত্তেও জ্ঞান আর রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে আমরা আজ সবকিছু হারাতে বসেছি। আর এমনই একটি অমূল্য রত্ন নারিকেল জিঞ্জিরা বা সেন্ট মার্টিন। আমরা অনেকেই মনে করি যে সেন্ট মার্টিন একটি প্রবাল দ্বীপ, আসলে ধারনাটা ঠিক নয়, সেন্ট মার্টিন দ্বীপটির গঠনগত দিক থেকে চট্টগামের পাহাড়গুলোর সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। দীর্ঘদিন পানিতে দাড়িয়ে থাকা এই পাহড়ের উপর প্রবালের প্রলেপ জমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আজকের সেন্ট মার্টিন।
সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, হয়ে উঠতে পারে জগদ্বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, এখান থেকে চিত্তাকর্ষক বিভিন্ন প্রজাতির রঙ্গীন মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানী হতে পারে, লবস্টার কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করে রপ্তানীর মাধ্যমে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আমরা আয় করতে পারি, সেন্ট মার্টিনের উপর ভিত্তি করে টেকনাফে গড়ে উঠতে পারে সী সেন্টার বা ওশেনিয়াম (বৃহদাকার সামুদ্রিক র্এাকোয়ারিয়াম) আর এসব কিছুর জন্য দরকার সরকারী পৃষ্টপোষকতা।
প্রবাল দ্বীপের আসল সৌন্দর্য় পানির নীচে লুকায়িত, আর তা হলো রঙ্গীন জীবন্ত প্রবাল আর রঙ্গীন মাছের এক ভিন্ন জগৎ, হয়তো আমরা অনেকেই সেন্ট মার্টিন ঘুরে এসেছি কিন্তু সেন্ট মার্টিনের সেই অজানা জগৎ আমাদের দেখা হয়নি। আমাদের দেশে ব্যত্তিগত পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব (www.scubabd.com) সেন্ট মার্টিন দ্বীপে স্কুবা (SCUBA – Self Contained Underwater Breathing Apparatus) ডাইভিং শুরু করলেও আজও তা অনেকের কাছেই অজানা। সরকারী পষ্টপোষকতা থাকলে এই খাতটিতে প্রভূত অগ্রগতি সাধণ সম্ভব হতো। দ্বীপটির অলংকার প্রবাল পাথর (live rock) আর প্রবাল ( hard and soft coral) উভয়ই আজ ঝুকির সম্মুখীন। জেলেদের জাল ও নেীকা, পর্যটকবাহী জাহাজের আঘাতে নষ্ট হচ্ছে জীবন্ত প্রবাল(living coral) আর প্রবাল পাথর (live rock), এই অবস্থার প্রতিকার স্বরূপ সেন্ট মার্টিনকে No fishing zone ঘোষনা করা যেতে পারে, জেলে সম্প্রদায়কে টেকনাফে পূর্নবাসিত করে কৃত্রিম সামুদ্রিক মৎস্য প্রজনন সম্পর্কিত জ্ঞান দানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করা যেতে পারে; জেটি ব্যতীত অন্য কোথাও পর্য়টকবাহী জাহাজগুলোকে নোঙর করতে না দিলে কিছুটা হলেও জীবন্ত প্রবাল(living coral) আর প্রবাল পাথর (live rock) রক্ষা হতে পারে। দ্বীপটির ভূতাত্তিক গঠন রক্ষার্থে দ্বীপটিতে আর কোনো ইমারত তৈরীর অনুমতি প্রদান করা যাবে না। রাতের আধারে জাহাজে বোঝাই করে পাথর পাচার হওয়া বন্ধ করতে হবে, পাচার বা নষ্ট হয়ে যাওয়া পাথর গুলোকে কৃত্রিমভাবে তৈরী করে দ্বীপটির সৌন্দর্য আবার ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে। আমরা এতক্ষন যা আলোচনা বা পর্যলোচনা করলাম তা হলো প্রবাল ধব্বংসের স্হানীয় কারন যার প্রতিকার আমরা নিজেরাই করতে পারি।
আর যে সকল, বিশ্বজনীন কারনে প্রবাল ধব্বংস হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারনটি হল পানি দুষন। জাহাজ ভাঙ্গা, জাহাজ চলাচল, বিভিন রাসায়নিক বর্জ্য সাগরে নিক্ষেপ, Green House Effect এর কারনে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানি দুষনের কারনে ময়লা হয়ে যাওয়া, জীবন্ত প্রবাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারন।
প্রবাল জন্মানোর আদর্শ তাপমাত্রা হচ্ছে ২৫-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক। উষ্ণ, ময়লা পানি প্রবালের জন্য কেন ক্ষতিকর এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা যায়, গরম এবং অতিরিক্ত সার (বর্জের কারনে) সম্বলিত পানিতে ক্ষতিকারক শৈবাল প্রবালের উপর জন্মায়, যার কারনে প্রবাল সূর্যালোক পায় না। সূর্যালোকের অভাবে প্রবালের রং বৈচিত্র্যের কারন রঙ্গীন শৈবাল zooxanthellae সালোক সংশ্লেষন ঘটাতে পারে না তাই মৃত্যু বরন করে, আর এর ফলে প্রবাল পলিপগুলোও নষ্ট হয়ে যায় (প্রবাল হল কোটি কোটি মাংসাশী, অমেরুদন্ডী, নিশাচর প্রানির সমন্বয়ে গঠিত এক একটি কলোনী, প্রতিটি প্রানিই এক একটি পলিপ, পলিপগুলো দেখতে হাইড্রার মতো, শারিরীক গঠনেও রয়েছে অনেক মিল, শিকার ধরার জন্য এরা নেমাটোসিস্ট সম্বলিত কর্ষিকা ব্যবহার করে থাকে, বংশবৃদ্ধির জন্য যৌন-অযৌন প্রজনন সম্পন্ন করে, পূর্নবয়স্ক পলিপ চলনক্ষম নয়, ক্যালিক্স দ্বারা প্রবাল পাথর অথবা মৃত প্রবালের সাথে আর সেনোসার্ক বাহু দ্বারা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। zooxanthellae শৈবালের সাথে প্রতিটি পলিপের শ্বসন-সালোক সংশ্লেষনে রয়েছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা) ।
প্রবালের জন্য ক্ষতিকর এই শৈবালগুলোকে মাছ খেয়ে ফেলে তাই প্রবাল রক্ষা পায় কিন্তু অতিরিক্ত মৎস্য নিধনের কারনে ক্ষতিকারক শৈবালের পরিমান দিন দিন বেড়ে চলায় সব প্রবাল দ্বীপই আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই আমাদের সকলের এবং সর্বোপরি সরকারের উচিত সময় থাকতে সেন্ট মার্টিনের রক্ষনে জরুরী পদক্ষেপ নেয়া।
লেখক –
ডাঃ শিবলী আল ফাত্তাহ বিডিএস
পেশায় ডেন্টাল সার্জন
১৯৯০ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচ. এস.সি
জলজ ভূ-প্রকৃতি নিয়ে শখের বশে পড়াশোনা, আর লেখালেখি।
email: shibleealam73@gmail.com এবং shibleealam@yahoo.com
সেন্ট মার্টিনে পানির তলদেশে জেটির কাছাকাছি পরিত্যক্ত আর্বজনার ছবি তুলেছেন:
কে. এম. মুজিবুর রহমান
সাধারন সম্পাদক
ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব
সূত্র:
www.wayfaring.info
www.richard-eaman.com
www.commons.wikimedia.org
www.coralreefecosystems.org
www.urbansage.com
www.golanta.info
www.enchantedlearning.com
www.livestockusa.org/BRAINS.html
http://oceanworld.tamu.edu/students/coral/coral5.htm