অযৌন প্রজননে উদ্ভিদের বুলবিল
আপনি সারা জীবন জেনে এসেছেন আলু মাটির নিচে জন্মে এখন যদি বলা হয় আলু গাছের মগডালে ঝুলে তাহলে আমাকে পাগল উপাধি দিতে সামান্যতম কৃপণতা করবেননা। তবে একথা সত্য যে কিছু কিছু আলু লতা জাতীয় গাছের কাণ্ডে জন্ম নেয় সেই লতা গুলো সাধারণত অন্য গাছকে অবলম্বন করে উপরের দিকে উঠে যায় অর্থাৎ এরা ক্লাইম্বিং বা আরোহী উদ্ভিদ। আর এ জন্যই একে অঞ্চল ভেদে গৈছালু, গাছালু বলা হয়। এছাড়াও ইংরেজিতে এয়ার পটেটো (Dioscorea bulbifera L) বলা হয়। তবে বাংলায় গৈছালু বা গাছালু বলার কারণ হল, যে আলু গাছে জন্মে অর্থাৎ সন্ধি বিচ্ছেদ করলে বিষয়টি এরকম হয় গৈছা+আলু=গৈছালু বৈজ্ঞানিক নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত উদ্ভিদে প্রাপ্ত কেমিক্যাল,ইকোলজি,বিখ্যাত মনীষী,সর্বাধিক প্রাপ্তি স্থান ইত্যাদি বিষয় গুলোর প্রাধান্য দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে জেনাসের নামকরণ Dioscorea রাখা হয়েছে গ্রীক ফিজিশিয়ান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী Dioscorides এর নামানুসারে এবং এর স্পেসিসের নামকরণ করা হয়েছে bulbifera কারণ এই উদ্ভিদে বুলবিল সৃষ্টি করে বলেই স্পেসিসের এমন নামকরণ।
আসলে গাছে জন্মানো যাকে আমরা আলু বলি তা কি সত্যি আলু নাকি কিছু কিছু উদ্ভিদের বংশ রক্ষা করার কৌশল মাত্র! এই ব্যাপারে অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে তবে এয়ার পটেটো (Dioscorea bulbifera L) বা যে সকল উদ্ভিদ বুলবিল উৎপন্ন করে এরা বংশবৃদ্ধির জন্য কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি যথাযথ ভাবে না করে একটি পিণ্ডের ন্যায় আকার ধারণ করে যাকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বুলবিল বলে থাকি। আর এই বুলবিল গুলো প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য সঞ্চিত করে পরিপক্ব হলে গাছ থেকে প্রাকৃতিক ভাবে খসে পড়ে। অনুকূল পরিবেশে মাটির সংস্পর্শে এসে নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেয়। কখনো কখনো আমরা এই বুলবিল কেই খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করি। কিছু কিছু উদ্ভিদ কেন এই বুলবিল সৃষ্টি করে এইরকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায় যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো এই ব্যাপারে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মাল্টিসেলুলার অর্গানিজমে যখন অযৌন প্রজনন ঘটে তখন কিছু উদ্ভিদ মিয়োটিক বিভাজনের মাধ্যমে এই ধরনের অঙ্গের সৃষ্টি করে যার একটি পরিণতি হল বুলবিল। বিশেষ করে এয়ার পটেটো,লিলি,রসুন,এগাভি প্রভৃতি উদ্ভিদ বুলবিল (Bulbil) সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের অঙ্গজ প্রজনন তথা অযৌন জনন সম্পন্ন করে এক্ষেত্রে অন্য পদ্ধতির অযৌন জননে(কাটিং,গ্রাফটিং,জোড়া কলম)যেমন মাতৃ উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য হুবহু এক থাকে তেমনি বুলবিল থেকে উৎপন্ন অপত্য বা নতুন উদ্ভিদেও মাতৃ উদ্ভিদের সকল গুণাবলী অক্ষুণ্ণ থাকে।
মানুষ থেকে শুরু করে যত নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীই হোক না কেন বংশ বৃদ্ধি করা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে কখনোই ভুল করেনা। কিছু উদ্ভিদের রিপ্রোডাক্টিভ বিফলতা ও জননাঙ্গের(ফুলের) অসম্পূর্ণ বৃদ্ধির জন্য সঠিক ও স্বাভাবিকভাবে বংশ বিস্তার করতে পারে না। এছাড়া পলিনেটরের অনুপস্থিতিতে যখন পরাগায়ন করতে পারে না বা প্রতিকূল পরিবেশের জন্য যখন কোন উদ্ভিদ যৌন প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বা পুং কেশর, গর্ভমুন্ডু ও পরাগ রেণুর ক্ষতি সাধিত হয় তখন এই সকল উদ্ভিদে অক্সিন নামক হরমোনের আধিক্য দেখা যায় ও এই হরমোনের সহায়তায় মেরিস্টেমেটিক(meristematic) কোষ বিভাজনের মাধ্যমে পুষ্পধর-পত্রিকা হতে বুলবিল উৎপন্ন করে ও প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের বংশ বিস্তার করে।যেমন Agave প্রজাতির উদ্ভিদে বুলবিল উৎপাদনে ও উৎপাদিত বুলবিলের বৃদ্ধিতে অক্সিন মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং PIN1 নামক এক প্রকার প্রোটিন বুলবিল উৎপাদনের স্থানে অক্সিন কে পরিবাহিত করে।
আমেরিকান বোটানিক্যাল সোসাইটির একদল উদ্ভিদ বিজ্ঞানী গ্রাফটিং ও কাটিং এর ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য অক্সিন নামক ফাইটোহরমোনের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন যেন বিশেষ কিছু উদ্ভিদের বুলবিল সৃষ্টির মাধ্যমে অযৌন পদ্ধতিতে নতুন বংশধরের জন্ম দেয়া যায়, যার প্রতিটি সন্তান সন্ততিতে মাতৃকুলের শতভাগ গুণাবলী বিদ্যমান থাকবে। হয়ত সেদিন বেশী দূরে নয় আমরা আম,জাম,কাঁঠাল,লিচু প্রভৃতি উদ্ভিদের বুলবিল বাগানে রোপণ করবো।
টীকা:
(১) Meristematic- Meristematic টিস্যু যা নতুন কোষ বিভাজনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই জাতীয় কোষ উদ্ভিদের বিভিন্ন রকমের অর্গান উৎপাদনে সহায়তা করে ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে।
(২) PIN1- peptidyl-prolyl cis/trans isomerase (PPIase) এটি একটি প্রোটিন যা ফসফোরাইলেশন কে কন্ট্রোল করার মাধ্যমে প্রোটিনের ফাংশন কে তরান্বিত করে।
ছবিঃ গুগোলের সৌজন্যে।