আবাসস্থল হারিয়ে হুমকিতে বন্য প্রাণী
বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তী, বাগেরহাট:
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের তুলাতলা এলাকার প্রায় ১০ একর বনভূমির ১০০টি স্থানে খণ্ড খণ্ডভাবে জ্বলতে থাকা আগুন অবশেষে সম্পূর্ণভাবে নেভানো হয়েছে। একটানা ৬৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে আগুন নেভাতে সক্ষম হন ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগের কর্মীরা। আগুন দেওয়ার অভিযোগে বন বিভাগের পক্ষ থেকে ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বনের ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বাদী হয়ে বুধবার রাতেই বন আইনে ওই মামলা দায়ের করেন। এদিকে সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার কারণে আবাসস্থল হারিয়ে বন্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাস হারানোর মতো বড় হুমকি আর হতে পারে না। আগুন নিভেছে : সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা এলাকায় প্রায় চার দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে সাড়ে তিন একর বনভূমি পুড়ে গেছে বলে বন বিভাগ জানিয়েছে। গতকাল বিকেলে প্রধান বনসংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী আগুনে পুড়ে যাওয়া বনের ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আজ রবিবার পরিদর্শনে আসছেন বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক মো. মানিকুজ্জামান জানান, বুধবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত তাঁরা একটানা কাজ করে সম্পূর্ণভাবে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন। বনের ওই অংশে আগুন বা কোনো ধোঁয়া নেই বলে তিনি নিশ্চিত করেন। ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা আরো জানান, বনের তুলাতলা এলাকায় প্রায় ১০ একর বনভূমির অন্তত ১০০টি স্থানে খণ্ড খণ্ডভাবে আগুন জ্বলছিল। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় এবং প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে আগুন নেভাতে তাঁদের বেগ পেতে হয়। প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে আড়ুয়ার খালে যন্ত্র বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে পানি আনতে হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাহিদুল ইসলাম জানান, তুলাতলা এলকায় ধোঁয়া বা আগুনের কোনো অস্তিত্ব নেই। আগুনে সাড়ে তিন একর বনভূমি পুড়ে জ্বলানি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ডিএফও জানান। ডিএফও জানান, তুলাতলা এলাকায় আগুন লাগানোর ঘটনায় ছয়জনকে আসামি করে বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বন আইনে দায়েরকৃত ওই মামলা বন বিভাগ নিজেরাই তদন্ত করে বাগেরহাট মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালতে অভিযোগ দাখিল করবে। উল্লেখ্য, গত বুধবার তুলতলা এলাকায় আগুন লাগে। এই নিয়ে এ মাসেই চারবার আগুনের ঘটনা ঘটল। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের আওতাধীন সুন্দরবনের পচাকোড়ালিয়া এলাকায় আগুনের ঘটনায় ছয়জনকে আসামি করে এবং ১৮ এপ্রিল প্রায় একই এলাকার আব্দুল্লার ছিলা নামক স্থানে আগুনের ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করে বন বিভাগ মামলা দায়ের করে। আব্দুল্লার ছিলা এলাকায় আগুন দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত উত্তর রাজাপুর গ্রামের খলিলুর রহমান (৩৫) ও পূর্ব রাজাপুর গ্রামের সাইফুল হাওলাদার নামের (২২) সন্দেহভাজন দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। বন বিভাগের দাবি, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আগুন দিয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনার পর বন বিভাগ সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে বনজ সম্পদ আহরণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। আবাসস্থল হারিয়ে হুমকিতে বন্য প্রাণী : ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ বছরে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় ২১ বার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক আগুনে প্রায় ৭০ একর বনভূমির গাছপালা ও লতাপাতা পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ওই বনভূমিতে নতুন করে ম্যানগ্রোভ জন্ম নিচ্ছে না। আগুনে বনের গাছপালা যেমন পুড়ছে, তেমনি গাছ ও লতাপাতার গোড়ার অংশ এবং মাটিও পুড়ছে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন উত্তর রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাকির হোসেন খান জানান, এক সময় ভোলা নদীর পশ্চিম পাড় থেকে সুন্দরবনের এ অংশ গাছপালায় ভরপুর ছিল। দেখা মিলত বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণীর। বাঘের আনাগোনা ওই অংশে এত বেশি ছিল যে, মাঝেমধ্যে বাঘ ভোলা নদী পার হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ত। ১৫-২০ বছর আগে থেকে বনের গাছপালা কমতে থাকে। আগের মতো আর বন্য প্রাণী দেখা যায় না। বনবিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে একের পর এক আগুনে আবাসস্থল হারানোয় বন্য প্রাণীদের জন্য এর চেয়ে আর বড় হুমকি হতে পারে না। আগুনে মানুষের বাসস্থান পুড়ে গেলে যেমন ক্ষতি হয়, বন্য প্রাণীদেরও ঠিক একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আবাস হারানোর কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫-২০ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে এবং সংখ্যায়ও অনেক প্রাণী কমে গেছে। এমনকি সুন্দরবন থেকে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে আবাসস্থল হারানো অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম আরো বলেন, দেশের অনেক স্থানেই এক সময় বাঘের দেখা মিলত। এখন সুন্দরবনই বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানেও বাঘ নিরাপদ নয়। আগুন বাঘের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি হুমকি বলে তিনি মনে করেন। ওয়াইল্ড টিমের প্রধান বলেন, সুন্দরবনে থাকা প্রতি বন্য প্রাণী নিজস্ব হোমরেঞ্জ তৈরি করে সেখানে বসবাস করে। বাঘেরও নিজস্ব হোমরেঞ্জ রয়েছে। আগুনে বনের গাছপালা পুড়ে গেলে বাঘসহ সব ধরনের বন্য প্রাণী তাদের হোমরেঞ্জ হারায়। পরে তাদের নতুন করে হোমরেঞ্জ তৈরি করতে অনেক বেগ পেতে হয়। এমনকি ওই সময় যেসব বন্য প্রাণী প্রজননমুখী থাকে তাদের প্রজননের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। খুলনা বিভাগীয় বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ( ডিএফও) মো. জাহিদুল কবির বলেন, বনে আগুন লাগলে মাটির নিচে বসবাসকারী সাপ, ব্যাঙ, কেঁচোসহ বিভিন্ন ধরনের পোকা মারা যায়। এমনকি কোনো গাছে পাখির বাসায় বাচ্চা থাকলে পাখি উড়ে গেলেও তার বাচ্চা আগুনে পুড়ে মারা যায়। সব মিলে বনের উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, একের পর এক আগুনে বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্য। জোয়ার-ভাটা প্রবাহমান না থাকায় পুড়ে যাওয়া ওই বনভূমিতে নতুন করে ম্যানগ্রোভ জন্ম নিচ্ছে না। জানা গেছে, ১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলেমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এর আবাসস্থল এ বন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। ২০০৪ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি, হরিণ এক থেকে দেড় লাখ, বানর ৪০ থেকে ৫০ হাজার, বন্য শূকর ২০ থেকে ২৫ হাজার, কুমির ১৫০ থেকে ২০০টি ও উদবিড়াল রয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার।
Source: www.kalerkantho.com/print-edition/news/2016/05/01/353515
Photo Source: www.kalerkantho.com/print-edition/news/2016/05/01/353515