ইলেকট্রিক ডেইজি

Marhatitiga, Photo: Dr. Ahsan Habib

গ্রামের মেঠো পথ বা শহুরে পতিত ভূমির পাশে হাটতে হাটতে হঠাৎ থমকে যেতে হয় মনে হয় যেন বিরহিণী প্রকৃতি হলুদ বসন পরিহিত অবস্থায় সেজে গুজে অপেক্ষা করছে। মাঠের পাশে,রাস্তার ধারে শ্যামলিমা যেন প্রকৃতিকে শাড়ির মতো ঘিরে রেখেছে এবং সবুজ আগাছা গুলি তার শিরে অসংখ্য হলুদ মুকুট পরিয়ে দিয়ে রানীর সাজে সাজিয়েছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করেনি এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম হবে। অঞ্চল ভেদে ছোট ছোট পেরিনিয়াল আগাছা গুলোকে দেখলে অবাক না হওয়ার কোন উপায় নেই কেননা মুকুট সদৃশ সোনালী-হলুদ পুষ্প গুলি এই রকম নিরেট অবহেলিত একটা গাছ থেকে কিভাবে এত রূপসী হয়ে জন্ম নেয়(!) এই ভাবনায় আমার মত অনেকেরই হয়ত ঝিম ধরে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়।

Marhatitiga, Photo: Dr. Ahsan Habib

ভাবনার এখানেই শেষ নয়,অবহেলিত আগাছা গুলো নিজেদের আত্মরক্ষা নিজেরাই করে কখনোই এদের বাঁচানোর জন্য কেউ বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে দেয় না। গরু ছাগল ও অন্যান্য তৃণ ভোজী প্রাণীরা এদের ছায়াও মাড়ে না। কি আশ্চর্য ক্ষমতাধর উদ্ভিদ আর এই ক্ষমতার নেপথ্যে কাজ করে Spilanthol molecule যা তৃণ ভোজী প্রাণীদের মুখে চেতনানাশক হিসেবে কাজ করে। যেমন ক্ষমতাধর ঠিক তেমনি এর বাংলা ও ইংরেজি নামটি আপনাকে অবাক করবে। মারহাটিটিগা বা ইলেকট্রিক ডেইজি (electric daisy), এর বাকি নামগুলো প্রবন্ধের কোন অংশে সুযোগ বুঝে উল্লেখ করব। মারহাটিটিগা নামটির আভিধানিক অর্থ জানা যায়নি তবে ইলেকট্রিক ডেইজি নামকরণের যথার্থতা আছে। এই ফুল খেলে বা চিবালে মুখের ভিতর বিশেষ ধরনের সেনসেশন তৈরি হয় যা বৈদ্যুতিক শকের(electric shock)মত অনুভূত হয় আর এ কারণেই একে ইলেকট্রিক ডেইজি বলা হয়। প্রথম এর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল Spilanthes oleracea L. ও Spilanthes acmella (L.) Murray কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শ্রেণীবিন্যাসে এগুলো সমনাম হিসেবে বিবেচিত। Spilanthes গনের নামকরণ করা হয়েছিল এই উদ্ভিদে প্রাপ্ত কেমিক্যাল Spilanthol molecule এর উপস্থিতির কারণে। পরবর্তীতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ১৮০৭ সালে নতুন করে এর বৈজ্ঞানিক নাম Acmella oleracea (L.) R. K. Jansen নির্বাচন করা হয় ও সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এই নামটিই সর্বজন স্বীকৃত।

Marhatitiga, Photo: Dr. Ahsan Habib

এটি Asteraceae পরিবার ভুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির গাড় সবুজ ও ব্রোঞ্জি সবুজ বর্ণের পত্র বিশিষ্ট উদ্ভিদ কাণ্ড সাধারণত ধুসর বর্ণের।এরা সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়ায় পেরিনিয়াল ও শীত প্রধান অঞ্চলে এন্যুয়াল উদ্ভিদ হিসেবে জন্মে কারণ এরা বেশী ঠাণ্ডা পছন্দ করে না। এই উদ্ভিদের আরও কিছু প্রচলিত নাম আছে যাদের মধ্যে Toothache প্লান্ট,ইলেকট্রিকবাটন, Szechuan Button নামে পরিচিত। ঔষধি গুনে ভরপুর এই উদ্ভিদ আমাদের দেশে প্রচুর জন্মে,এদের গুনের কথা ভাবলেই মনে হয় সেই বিখ্যাত কবিতার চরণ, ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল’ কেননা এই অবহেলিত ও পদদলিত আগাছা তা প্রমাণ করেছে। দাঁতের ব্যথা ও মুখ গহ্বরে আলসারে এই ফুল ও পাতার রস অত্যন্ত চমকপ্রদ ফলাফল প্রদর্শন করে। কচি পাতা ফুল ও কুঁড়ি থেকে প্রাপ্ত ন্যাচারাল এনালজেসিক যা জিহ্বা এবং দাঁতের মাড়ি অসাড় করে দেয়, তাই কখনো দাঁতে ব্যথা অনুভূত হলে এর ব্যবহার খুবই সমাদৃত।
এতে প্রাকৃতিক বিস্তৃত বর্ণালীর অণুজীব ও ছত্রাক বিধ্বংসী উপাদান বিদ্যমান থাকায় ম্যালেরিয়াতে ব্যবহার সুপ্রতিষ্ঠিত। এর মূল রাসায়নিক উপাদান হল Spilanthol যা এন্টি প্যারাসাইটিক হিসেবে কাজ করে। Spilanthes নির্যাস দিয়ে নিয়মিত গার্গল করলে দাঁত ও দাঁতের মাড়ির সুস্থতা নিশ্চিত হয়। In Vitro স্টোডিতে দেখা যায় এই উদ্ভিদের নির্যাস E.coli, Pseudomonas, Salmonella, Klebsiella Pneumonae ও Staphylococcus albus ও Candida albicans ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোহিত করে। এর পত্র নির্যাস ডাইজেশনে সাহায্য করে এছাড়াও এন্টি ফ্লাটুলেন্স(flatulence)হিসেবে কাজ করে ও এপিটাইট(appetite) বৃদ্ধি সহ স্যালাইভারী গ্লান্ডকে স্টিমুলেট করার মাধ্যমে নসিয়া ও ভমিটিং(nausea ও vomiting) প্রবণতা কমিয়ে দেয়। Stomatitis,sore throats নিরাময় ও স্যালাইভা উৎপাদন বৃদ্ধিতে এদের জুড়ি নেই। এর আরক(tincture)জলবৎ তরলে মিশ্রিত করে মাউথওয়াশ হিসেবে গার্গল(gargle) করলে দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

*ফটো- ইন্টারনেট।

মারহাটিটিগা শুধু ঔষধ হিসেবে নয় খাদ্য, মসলা ও প্রসাধনী হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। পাতা কাঁচা অবস্থায় সালাদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এছাড়াও স্যুপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক কালে এদের ফুল খাবারে ফ্লেভার এনহেন্সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মারহাটিটিগার ফুলের নির্যাস হার্বাল এক্সট্রাক্টস হিসেবে মুখমণ্ডলের ত্বকের রুক্ষতা দূর করে সজীবতা আনয়ন সহ বলিরেখা দূরীকরণে কাজ করে। ফুলের নির্যাস সামান্য তুলাতে নিয়ে নেইল পলিশ রিমুভারের মত হাত ও পায়ের নখে প্রতিদিন একবার করে হালকা ভাবে ঘসে লাগালে নখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। তবে এই প্রক্রিয়াটি ৩ বছরের কম বয়সে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ভাবসম্প্রসারণ করা যদিও সহজ কাজ নয় কিন্তু ইলেকট্রিক ডেইজি বা মারহাটিটিগা কে দেখলে ও বিস্ময়কর গুনের বিশ্লেষণ করলে, ছেলেবেলার খুবই বিরক্তিকর প্রশ্নটি মনে পড়ে। নিন্মের লাইনটিকে ভাবসম্প্রসারণ কর। ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল’। তবে মারহাটিটিগা বা ইলেকট্রিক ডেইজির গুনে এই লাইনটি সকলের কাছেই প্রিয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।

সতর্কতা: প্রবন্ধে উল্লেখিত ঔষধি গুনাগুণ ও এর ব্যবহার কারো জন্য ব্যবস্থাপত্র নয়। দয়া করে যে কোন ঔষধ ব্যবহারের পূর্বে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

টীকা:
(১) Toothache: দাঁত ও মাড়ির ব্যথা।
(২) Vitro: ল্যাটিন শব্দ, এটি একটি প্রযুক্তি যা হল লিভিং অর্গানিজমের বাহিরে কোন কন্ট্রোল পরিবেশে যে এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষা করা হয় তাকেই in vitro test বলা হয়।
(৩) Flatulence: পৌষ্টিক তন্ত্রে বা খাদ্য সরবরাহকারী নালিতে গ্যাস জমা যাকে আরও সহজ করে বলা যায় ইন্টেস্টাইনাল গ্যাস যা পায়ু পথ দিয়ে মৃদু থেকে উঁচু শব্দে নির্গত হয়।
(৪) Stomatitis: মুখমণ্ডলের ভিতরে প্রদাহ বা ঘা হলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Stomatitis বলা হয়।
(৫) Szechuan: তীব্র সুগন্ধ যুক্ত পিপার(গোলমরিচ) বা ঝাল মরিচ।