চা এবার আশাজাগানিয়া
26 April, 2016.
শাহ ফখরুজ্জামান, হবিগঞ্জ:
চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার চা বাগানগুলোতে এ মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ারও আশা করছেন চা শিল্পে জড়িতরা। মৌসুমের শুরুতেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি আর পোকামাকড়ের উপদ্রব না থাকার পাশাপাশি আমদানি শুল্ক না কমানোয় এ শিল্পে এবার আশার সঞ্চার হয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার লস্করপুর ভ্যালিতে চলতি বছর মৌসুমের শুরুতেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। বলা যায় মৌসুমজুড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। যেখানে বিগত বছরগুলোতে এপ্রিলে চা পাতা চয়ন শুরু হতো, সেখানে চলতি বছর মার্চেই পাতা চয়ন ও উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছর ভ্যালিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন চা সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবছর মার্চের শেষদিকে নিজস্ব সেচের মাধ্যমে বিভিন্ন চা বাগানে উৎপাদন শুরু হলেও এ বছর প্রাকৃতিকভাবে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বেশ বৃষ্টি হওয়ায় ১ মার্চ থেকেই ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগানে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। আর এ আগাম উৎপাদনে একদিকে যেমন এ বছর চা বাগানিরা যেমন আশাবাদী, তেমনি আগাম হাজরী (বেতন) পেয়ে খুশি চা শ্রমিকরাও। ভ্যালি সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল ভ্যালিতে ১৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর আগে ২৭ মার্চ ৩৫ মিলিমিটার, ১৫ মার্চ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ২২ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে ৯ ও ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত সংরক্ষণ করা হয়। এ ছাড়া ২১ জানুয়ারি ১২ মিলিমিটার, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৫ মিলিমিটার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ৫১ মিলিমিটার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। সব মিলিয়ে ভ্যালিতে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাগান এলাকায় গেলেই এখন সবার চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। বৃষ্টিতে নতুন প্রাণ পেয়ে সতেজ হয়েছে চা গাছগুলো। মৃদু-মন্দ বাতাসে দুলছে চায়ের সবুজ পাতা। আর এরই মাঝে চা কন্যারা উৎসবের আমেজে পাতা চয়ন করছেন। পাতা চয়নের সময় হাত ভরে পাতা আসছে। শ্রমিকরা দৈনিক নির্ধারিত ২৪ কেজি পাতা তোলার পর প্রত্যেকে অতিরিক্ত ৮-১০ কেজি পাতা বেশি তুলতে পারছেন। এতে শ্রমিকরাও বেশ খুশি। অন্যদিকে কারখানায়ও পুরোদমে চা তৈরির কাজ চলছে। অবশ্য মার্চের প্রথম সপ্তাহে নানা আনুষ্ঠানিকতায় এসব বাগানে চা পাতা চয়ন ও উৎপাদন শুরু হয়েছিল। সাধারণত এপ্রিলে চা পাতা উৎপাদন শুরু হয়। তবে এবার আগাম বৃষ্টির কারণে মার্চের প্রথমেই পাতা উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ ও চা শ্রমিকরা বেশ খুশি। উৎপাদন ভালো হলে বাড়তি চা পাতা তোলার ওপর শ্রমিকরা বোনাসও পাবেন। লস্করপুর ভ্যালির চেয়ারম্যান ও চাকলাপুঞ্জি চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক এস নাগ বলেন, সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গত মৌসুমে ভ্যালিতে এক কোটি কেজি বেশি চা উৎপাদিত হয়েছে। এ বছরও আগাম উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরও চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। দেউন্দি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক দেবাশীষ বলেন, ‘বছরের শুরুতেই আমরা বৃষ্টি পেয়েছি। চৈত্রের খরাকে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু সময়মতো প্রয়োজনীয় বৃষ্টির কারণে তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়েছে। যে কারণে এবার উৎপাদন বাড়বে।’ চণ্ডিছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর আগাম বৃষ্টির কারণে নতুন পাতার চায়ের গুণগত মান বেশ ভালো হচ্ছে। ধারাবাহিক বৃষ্টি হলে গত বছরের মতো এবারও চায়ের গড় উৎপাদন বাড়বে। চান্দপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক শামীম হুদা জানান, তাঁর বাগানের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১২ লাখ কেজি। আগাম মৌসুম শুরু হওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা সহজেই অর্জন করা সম্ভব হবে। গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর পুরো ভ্যালিতেই ভালো উৎপাদন হবে। তেলিয়াপড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক এমদাদুল হক বলেন, অন্যান্য বছর এ সময়ে তাঁর বাগানে ২০-৩০ হাজার কেজি সবুজ পাতা সংগ্রহ হতো। এ বছর এর পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কেজি। এ মৌসুমে বাম্পার ফলন প্রত্যাশা করে তিনি জানান, তাঁর বাগানে প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ হয় ১৬২ টাকা। তাঁর প্রত্যাশা, অকশনে এবার ১৮০ টাকার বেশি বিক্রি হবে। মৌসুমের প্রথম দিকে চায়ের দাম একটু বেশি পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় চায়ের মানও এবার ভালো হবে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মাঈনউদ্দিন জানান, প্রতিবছর অধিক খড়ার জন্য লাল মাকড়শার আক্রমণের শিকার হয়ে পাতায় এক ধরনের হলুদ রোগ দেখা দিত। এ বছর আগাম বৃষ্টিতে এ ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ কম। ফলে সব বাগানেই ভালো ফলন হবে। লস্করপুর ভ্যালিতে রয়েছে ২২টি চা বাগান। এর বাইরেও কয়েকটি বাগান রয়েছে। গত কয়েক মৌসুমে খড়া, শ্রমিক অসন্তোষ ও পোকামাকড়ের আক্রমণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক বছর আগে আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে দেশীয় চা শিল্প হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু এ বছর অনুকূল পরিবেশের পাশাপাশি আমদানি শুল্ক না কমানোয় এ শিল্পে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
Source: www.kalerkantho.com/print-edition/priyo-desh/2016/04/26/351626
Photo Source: tunza.eco-generation.org