ধরিত্রী দিবসে আজ সূচনা হচ্ছে এক নতুন ধরিত্রীর

22 April, 2016

22.04.16 n-1

কাওসার রহমান
আজ শুক্রবার ধরিত্রী দিবস। আর ধরিত্রী দিবসেই ধরিত্রী রক্ষার নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে জাতিসংঘ। শুধু তাই নয়, দিনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় করে রাখতে রেকর্ডসংখ্যক দেশ আজ জাতিসংঘ সদর দফতরে সমবেত হচ্ছে ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর করতে।
একদিনে সর্বাধিক দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের রেকর্ডটি এখন পর্যন্ত মন্টিগো সমুদ্র আইন কনভেনশনের ঝুলিতে। ১৯৮২ সালে ‘মন্টিগো বে কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সি’ শীর্ষক চুক্তিতে একদিনে সর্বোচ্চ ১১৯টি দেশ স্বাক্ষর করেছিল। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সেই রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে। প্রথম দিনে বিশ্বের প্রায় দুই শ’ দেশের মধ্যে ১৬৮টি দেশের এ চুক্তিতে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আর এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আরও স্মরণীয় করতে রাখতে বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দিচ্ছেন এই মাইলফলক অনুষ্ঠানে। জলবায়ু পরিবর্তনে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের দেশগুলোর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে তাগিদ প্রদানের জন্যই জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ধরিত্রী দিবসকে বেছে নিয়েছেন। আর এই দিনটিতেই তিনি নতুন এক ধরিত্রীর সূচনা করতে যাচ্ছেন।
বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তিটি এমন একটি সময় স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে যখন পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১৩৬ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০১৫ সাল ছিল গত ১৩৬ বছরের মধ্যে সবেচেয়ে উষ্ণ বছর। আর ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাস সেই রেকর্ড ভঙ্গ করে পৃথিবীজুড়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এই উষ্ণতায় বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে আইসল্যান্ডের বরফ গলন। বর্তমানে এমনভাবে আইসল্যাল্ডের বরফ গলছে যা অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, এভাবে এ্যান্টার্কটিকার এই বরফ গলার কারণে এই শতাব্দী শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আর এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রবালদ্বীপই নষ্ট হয়ে যাবে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি বৈশ্বিক এই উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে আনা হয়, তাহলেও এই ধরণীতে ব্যাপক পরিবেশগত পরিবর্তন দেখা দেবে।
এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ছোঁয়া দক্ষিণ এশিয়াতেও পড়েছে। এ বছর বসন্ত থেকেই গ্রীষ্মের উত্তাপ ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে। বৈশ্বিক উষ্ণতার দাপটে বাংলাদেশে শীত অতি স্বল্প সময়েই বিদায় নিয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বা প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর খরার কবলে পড়েছে। খরা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ আকার নিয়েছে মহারাষ্ট্রের লাটুর এলাকায়। ফলে দেশের অন্য প্রান্ত থেকে রেলওয়ে ট্যাঙ্কারে করে জল এনে ওই অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। পর পর দু’বছর ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে কম মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং তেলেঙ্গানা বা উড়িষ্যার মতো রাজ্যে প্রবল তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
লাফিয়ে লাফিয়ে এই সিঁড়ি ভাঙ্গা উষ্ণতার মধ্যেই প্যারিস থেকে নিইউয়র্কের পথে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আজ জলবায়ুর এক বড় বাধা অতিক্রম করতে যাচ্ছেন। যাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ১৬৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। প্রথম দিনেই প্রতিবেশী দেশ ভারতও চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ভারতের পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকার বর্তমানে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অপর ছয় সদস্য দেশ আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কাও প্রথম দিনেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যোগ দিচ্ছেন এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে। তাছাড়া চীন, রাশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বিশ্বের সব প্রভাবশালী দেশই প্রথম দিনে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। তবে যে দেশগুলো প্রথম দিনে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারবে না, তারা আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত যে কোন সময় নিউইয়র্কে গিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রেকর্ডসংখ্যক দেশের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দ্রুত এই চুক্তিটি কার্যকরের পথে এগিয়ে যাবে। বাস্তবায়ন বিষয়ে চুক্তিতে বলা হয়েছে, ৫৫ শতাংশ গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী কমপক্ষে ৫৫টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, বিশ্বে মোট ৪০ শতাংশ গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রথম দিনেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। ফলে চুক্তিটি কার্যকর নিয়ে বিশ্ববাসীর মনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের আগেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। জাতিসংঘ আশা করছে, ২০১৮ সালেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর হবে।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসিসির প্রধান ক্রিস্টিনা ফিগুয়ার্স বলেন, ‘২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সামিট ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম আমি আমার জীবদ্দশায় জলবায়ু চুক্তি দেখে যেতে পারব না। এখন আমি আশাবাদী নির্ধারিত সময় ২০২০ সালের আগেই এ চুক্তি কার্যকর হবে।’
তবে এই চুক্তি কার্যকরের সামনে আরও একটি বাধা রয়েছে, সেটি হচ্ছে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোর নিজ নিজ দেশে চুক্তি অনুমোদন বা রেটিফাই করা। এ ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা চুক্তিতে বেঁধে দেয়া হয়নি। তবে এই রেটিফাইয়ের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। অবশ্য আশার কথা হচ্ছে, প্রধান দুই কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে বেশ উদার। এটাই পথ দেখাচ্ছে অপর দেশগুলোকে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। তবে তার পরও কথা থেকে যায়, চুক্তি স্বাক্ষরের পরও কি দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নির্গমন কমাবে?
চুক্তিতে কার্বন নির্গমন কমানোর বিষয়ে কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। তবে প্রত্যেক দেশ নিজেই কার্বন নির্গমন কমানোর ব্যাপারে তার নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে এবং প্রতি পাঁচ বছর পর পর ওই লক্ষ্যমাত্রা আপডেট করতে হবে।
টানা চার বছর ধরে আলোচনার পর বিশ্ব নেতারা গত ডিসেম্বরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে একটি অর্থপূর্ণ সর্বজনীন চুক্তির সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হন। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসিসির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সেই চুক্তি অনুমোদন হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রায় কোথায় দাঁড়ি টানলে বাঁচানো যাবে পৃথিবীকে। ৪০ বছর আগে আমেরিকার ইয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম নর্ডহাউসের কিছু অনুমাননির্ভর এক গণনা থেকে এই যতিবিন্দু ঠিক করা হয়। সেটা হলো ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন পর্যন্ত যতগুলো জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে তার সবগুলোতেই উঠে এসেছে এই ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের যতিবিন্দু। ধরে নেয়া হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন পর্বের তাপমাত্রার তুলনায় কিছুতেই ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে উঠতে দেয়া যাবে না।
অথচ ২১ শতকের গোড়ার ১৫ বছরের মধ্যেই আমরা সেই যতিবিন্দুর সীমানার দিকে প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করে ফেলেছি। কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে কোনভাবেই কি ২ ডিগ্রীর লক্ষ্য ধরে রাখা যাবে? বিভিন্ন গবেষণা গ্রুপ বলছে, ইতোমধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ৩.৫ ডিগ্রীতে পৌঁছেছে। যে কারণে এ্যান্টার্কটিকায় অস্বাভাবিক বরফ গলার দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অবশ্য ২ ডিগ্রী নিয়েও বিতর্ক আছে। বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ দেশগুলো বলছে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কথা। তবে বাংলাদেশের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। জলবায়ুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো বাংলাদেশও মনে করে, ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এতে বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর প্রচুর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
Source: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/186629
Photo Source: transitionnewmills.org