ফুলের বংশ পরিচয়
বিয়ে-শাদি বলে কথা! আর যাই হোক এটা নিয়ে তো অবহেলা করা যায় না! তাইতো গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য দেয়া হয় বংশ পরিচয় উপাধি পদবী ইত্যাকার বিষয় গুলোকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পদবীর সাথে জড়িয়ে আছে জমি ও হিসাব সংক্রান্ত ব্যাপার অথবা কোন আঞ্চলিক ব্যাপার। আসলে এই সব পদবী যেমন মানুষের পরিচয় ও মর্যাদাকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক তেমনি উদ্ভিদের বংশ পরিচয় এদের চাহিদা ও মর্যাদাকেও নিয়ন্ত্রণ করে । যেমন গোলাপ-ধুতরা এ দু’এর মর্যাদা ও চাহিদা কখনোই এক হবার নয়। যদিও উদ্ভিদের পাতা ফুল ফলে ভিন্নতা দেখা যায় তবে কিছু উদ্ভিদের গঠন ও ফুলের রঙ কাছাকাছি হওয়ায় আমরা এদের আসল বংশ পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ি।
গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে প্রকৃতিতে আগুন লাগিয়ে আবার কখনো গোলাপী হলুদ বসনায় সড়ক দ্বীপে বা বড় বড় উদ্যানে উচ্ছলতা নিয়ে যে রূপসীরা আপনার আমার প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে আমি তাদের কথাই বলছি। প্রতিদিন যাত্রা পথে এরা আপনাকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে প্রেম নিবেদন করে আর প্রকৃতি প্রেমীরা সাদরে সেই নিবেদন গ্রহন করে।সৌন্দর্য কে কখনোই ছোঁয়া যায় না শুধুই উপভোগ করা যায়, কিছু সৌন্দর্য আছে বর্ণনা যায় না। তেমনি কয়েকটি রূপসী তরু কৃঞ্চচূঁড়া,রাধাচূঁড়া,কনকচূঁড়া ও লাল সোনাইল যাদের সাথে দেখা হয় প্রতি গ্রীষ্মের তাপদাহে যা সকলের মন প্রানকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলতে এ ধরায় নেমে আসে।
কৃঞ্চচূঁড়া Fabaceae পরিবার ভুক্ত পেরিনিয়াল সপুষ্পক বড় আকারের উদ্ভিদ যার পাতা দেখতে অনেকটা ফার্নের মত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Delonix regia Boj. ex Hook
এদের আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও বর্তমানে আমাদের দেশে উপস্থিতিতে প্রমানিত হয় এরা আমাদের নিজস্ব উদ্ভিদ। অনেকের মনে এর নামকরন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কৃষ্ণ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো কালো তাহলে কেন এই লাল রঙের ফুলটির নাম কৃষ্ণ হলো। এর সঠিক উত্তর জানা না থাকলেও হিন্দু ধর্ম মতে, কৃষ্ণচুঁড়া গাছ শ্রীকৃষ্ণ লাগিয়েছিলেন। হিন্দু দেবতা কৃষ্ণ এই ফুল তার খোঁপায় পড়তেন বলেই তরুপ্রেমীরা এই ফুলের নামকরন করেছেন কৃষ্ণচূঁড়া। এ ছাড়াও এটি কোন কোন অঞ্চলে গুলমোহর নামে পরিচিত।
রাধাচূঁড়া মাঝারি আকারের গুল্ম জাতিয় পেরিনিয়াল সপুষ্পক উদ্ভিদ সাধারনত সারা বছরই কখনো হলুদ কখনো লাল কখনোবা লাল হলুদের মিশ্রনে এদের পুষ্পায়ন ঘটে। এর আদি নিবাস ক্রিস গেইলের দেশ ওয়েস্ট-ইন্ডিস তবে এখন আমাদের দেশের সর্বত্র বিরাজমান। এর নাম নিয়েও অনেকের মতে ভিন্নতা আছে তবে সাধারনত সবচেয়ে প্রচলিত হলো হিন্দু দেবতা রাধা এই হলুদ ফুলটি খোঁপায় পড়তেন বলেই এর নাম রাধাচুঁড়া হয়েছে। এটি Febaceae পরিবার ভুক্ত উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Caesalpinia pulcherrima.
কনকচূঁড়া অনেক বড় আকারের সপুষ্পক পেরিনিয়াল উদ্ভিদ শোভাবর্ধক হিসেবে রাস্তার পাশে ও উদ্যানে রোপন করা হয়। এই উদ্ভিদের আদিনিবাস শ্রীলংকায় হলেও আমাদের দেশে শোভাবর্ধনের দায়িত্বে আছে বহু বছর ধরে। এদের পাতা যৌগিক,গাছ ও পাতার আকৃতি কৃষ্ণচূঁড়ার মতোই। তবে কনকচূঁড়ার শীতের শেষভাগে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন কচি পাতা আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলে পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি ও পাপড়িগুলো কুঞ্চিত। হলুদ ফুল ফোটে শাখার ডগার লম্বা মঞ্জরিতে। এটিও Febaceae পরিবার ভুক্ত উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Peltophorum pterocarpum (DC.) K. Heyne. এই ফুলের রঙ সোনালী হলুদ বর্ণের তাই প্রফেসর দ্বিজেন শর্মা এর নামকরন করেছেন কনকচূঁড়া (কনক মানে সোনা)। এছাড়া অনেকের কাছে এটি স্বর্নচূঁড়া বা হলুদচূঁড়া নামেও পরিচিত।
লাল সোনাইল একে বর্ণনা করে শেষ করা দুরুহ ব্যাপার।বসন্তে সব পাতা ঝড়িয়ে কংকালের মত নিস্প্রভ দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃক্ষে গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফুটে যা বিশালাকার ক্যানপি নিয়ে ফুলে ফুলে যখন প্রকৃতিকে সাজিয়ে দেয় তখন একটি কথাই মনে পড়ে এই রুক্ষ কাস্টল বৃক্ষের হৃদয়ে এত বৈভব কিভাবে লুকায়িত ছিলো!! যখন সম্পুর্ন পুষ্পায়ন ঘটে তখন গাছের ডাল ও পাতা দেখা যায় না শুধুই ফুল আর ফুল মনে হয় যেন প্রকৃতি গোলাপী লিপস্টিক মেখে সেজেগুজে প্রিয়জনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
লাল সোনাইল Fabaceae পরিবার ভুক্ত উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Cassia javanica L.এর আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্বএশিয়া।কিন্তু বাংলাদেশেসহ আজকাল সারা
পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে বাগানের শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে রোপন করা হয়। এদের গোলাপি এবং গাঢ় লাল রঙের ফুলের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে প্রফেসর দ্বিজেন শর্মা নামকরন করেন লাল সোনাইল।
বর্ণিত ৪টি ফুলই Febaceae পরিবারের। সুতরাং এরা একই বংশের চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাইবোন। এখানে যদি কৃঞ্চচূঁড়াকে ভাই ধরা হয় তাহলে রাধাচূঁড়া তার বোন আর কনকচূঁড়া ও লাল সোনাইল যথাক্রমে তার মামাতো চাচাতো ভাই অথবা বোন। যদিও কাজিন রা একই বংশের তথাপি তাদের আচার আচরণ, চুলের ধরন, চোখের রঙ, গায়ের রঙে ভিন্নতা থাকবেই। সুতরাং একজনের সাথে আরেক জনের(উদ্ভিদ বা প্রানী) কিছু না কিছু হলেও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।