বুয়েটের গবেষণা – সুন্দরবনের ৪২% তলিয়ে যেতে পারে ২০৫০ সাল নাগাদ


01 May, 2016.

মোশতাক আহমদ ও আরিফুর রহমান :

তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে শূন্য দশমিক ৫ মিটার। এতে সুন্দরবনের দুই হাজার ২৬১ বর্গকিলোমিটার বা ৪২ শতাংশ পুরোপুরি ডুবে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উপকূলীয় ১৯ জেলার দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। এতে বাস্তুহারা হবে ২৫ লাখ মানুষ। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বুয়েটের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭—এই ২৬ বছর বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। এরপর থেকে আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি বদলাতে থাকে। ওই বছর থেকেই দেশে ধীরে ধীরে গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টসহ বিশ্বের নামকরা ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২৪টি স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত গত চার বছর ধরে বিশ্লেষণ করে এ তথ্য বের করেছে বুয়েটসহ ১৬টি প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা গেছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ যে হারে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি এবং ২০৮০ সালে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। যদিও প্যারিস চুক্তিতে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বুয়েটের আইডাব্লিউএফএমসহ ১৬টি প্রতিষ্ঠান বলছে, এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল শনিবার বুয়েটের কাউন্সিল ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অবার্টসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন বুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর খালেদা আকরাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইডাব্লিউএফএমের অধ্যাপক ও গবেষণার সমন্বয়ক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আগাম বর্ষায় (মার্চ-মে) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২০ ও ২০৫০ সালে এটি ১২৫ মিলিমিটার থেকে ৬১৫ মিলিমিটার পর্যন্ত বেশি হতে পারে। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিনিয়তই বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে উপকূলীয় এলাকার ১৯ জেলার ২৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে। এক মিটার উচ্চতা বাড়লে তিন হাজার ৯৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হবে উপকূলীয় এলাকায়। তাতে ৬০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর দেড় মিটার উচ্চতা বাড়লে ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হবে। আর তাতে পাঁচ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাবে। সুন্দরবন নিয়ে করা ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, পানির উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হবে বা তলিয়ে যাবে। আর এক মিটার উচ্চতা বাড়লে ৬৯ শতাংশ এবং দেড় মিটার বাড়লে বনের ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিল যুক্তরাজ্যের একসেটার বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাট কার্যালয়, নেদারল্যান্ডসের ফ্রি ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ ১৬টি সংস্থা। অনুষ্ঠানে গবেষকরা জানান, তাঁরা ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে আগামী ২১০০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা কী হতে পারে এর একটা চিত্র খুঁজে পেয়েছেন। এ বিষয়ে তিনটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এ হারে বাড়লে বাংলাদেশে বোরোর উৎপাদন ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং ২০৮০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ কমে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ৪৮৪ জন বসবাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনবসতির ঘনত্ব বেড়ে হবে তিন হাজার ৩৮০ জন, এক মিটার বাড়লে পাঁচ হাজার ৭৭৭ আর দেড় মিটার বাড়লে সাত হাজার ৫৮৮ জন। অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে গত ২২ এপ্রিল প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বের ১৭৫টি দেশ স্বাক্ষর করে। সেখানে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এ চুক্তির কার্যকারিতা বিষয়ে গবেষণায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে তার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ড্রেজিং করে বা পুনঃখনন করে আমাদের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।’ তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ২৩টি বড় নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সে সঙ্গে এসব নদীর সংযোগ খালগুলোকেও খননের আওতায় আনা হবে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সোফি অবার্ট বলেন, প্যারিস সম্মেলনে শর্ত পূরণে সব দেশ আন্তরিকভাবে কাজ করবে বলে তিনি আশাবাদী। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত, আইডাব্লিউএফএমের পরিচালক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামসহ ভারত ও বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা।

Source: www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2016/05/01/353501

Photo Source: www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2016/05/01/353501