মধু মিলছে না সুন্দরবনে
22 April, 2016
মিজানুর রাকিব, শরণখোলা
মধুভান্ডারখ্যাত সুন্দরবন এবার মধুশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর বনের যেসব এলাকা থেকে মধু আহরণ করা হতো, এবার সেসব জায়গায় মৌচাক-মৌমাছি নেই বললেই চলে। মাইলকে মাইল বন ঘেটে একফোঁটা মধুও সংগ্রহ করতে পারছেন না মৌয়ালরা। মধু না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের। মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া দাদনের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন এই ভেবে দিশাহারা তারা। হতাশ ব্যবসায়ীরাও। একেবারেই মধুশূন্য বনের এমন চিত্র আর কোনো দিন দেখেননি এ অঞ্চলের মৌয়াল ও সাধারণ মানুষ। গোটা পূর্ব সুন্দরবনেরই (শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ) এ অবস্থা বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। ফলে এ বছর দেশে মধুর বাজার খুব চড়া হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে সুন্দরবনে মৌমাছি বা মৌচাকের দেখা না মিললেও বন সন্নিহিত গ্রামগুলোতে মৌমাছির বেশ সমাগম ঘটেছে এবার। মৌচাকও হয়েছে অসংখ্য। এমন চিত্র অন্য কোনো বছর দেখা যায়নি। বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও বাড়ির গাছগাছালিতে বাসা বেঁধেছে মৌমাছি। উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের খাদা গ্রামের মকবুল তালুকদারের বাড়ির মসজিদের গেটে বিশাল দুটি চাক দেখা গেছে। খোন্তাকাটা ইউনিয়নের আল-জামিয়া কাসিমুল উলুম কওমি মাদ্রাসা ভবন ও মসজিদের বিভিন্ন স্থানে বিশাল ৬টি এবং একই ইউনিয়নের পূর্ব খোন্তাকাটা গ্রামের মোখলেছের বাড়ির গাছে রয়েছে দুটি মৌচাক। এ ছাড়া বনসংলগ্ন খুড়িয়াখালী গ্রামের হেমায়েত মোল্লার বাড়িতে একটি, শাহ আলম গাজীর বাড়িতে দুটি, সলেমান হাওলাদারের বাড়িতে দুটি, জাফর মুন্সীর বাড়িতে একটিসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য মৌচাকের খবর জানিয়েছে এলাকাবাসী। বিভিন্ন ফসল ও দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন গাছে ফোটা বৈশাখী ফুলের মধুর আশায় মৌমাছি দল লোকালয়ে ছুটে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বন বিভাগ ও মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধু না পাওয়ার প্রাথমিক কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন, এ বছর একেবারেই বৃষ্টি না হওয়াকে। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে একদিকে যেমন বনের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি সময়মতো গাছে ফুলও আসছে না। ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় মৌমাছিরা সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ চলাচল করছে। ওই সব জাহাজের হাইড্রোলিক হর্নের বিকট শব্দে বনের প্রাণিকুল সব সময় আতঙ্কে থাকে। এসব কারণেও ধীরে ধীরে মৌমাছি বন ছাড়ছে বলে বন বিভাগ দাবি করছে।
মধু না পেয়ে ইতোমধ্যে শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার শতাধিক মৌয়াল ফিরে এসে তাদের পাস পারমিট বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছেন। ফিরে আসা এমন বেশ কয়েক জন মৌয়ালের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন চরম হতাশার কথা। তাদের মধ্যে দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের ইউনুছ মোল্লা, মজিদ মোল্লা, বকুলতল গ্রামের আ. গনি, তাফালবাড়ি গ্রামের মনিরুজ্জামান, চালিতাবুনিয়া গ্রামের আবুল কালাম, কবির বয়াতী, বগী কাঞ্চন মোল্লা ও উত্তর সাউথখালী গ্রামের ইসমাইল হোসেন জানান, তারা প্রতিবছর পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন টিয়ারচর, দুধমুখী, কোকিল মনি, ভেদাখালী, মেহের আলীর চর, আলোর কোল ও খাজরা এলাকার বনে মধু সংগ্রহ করতে যান। ওই সব এলাকা থেকে তারা প্রতি গোনে (একেক ট্রিপে) একেক জন মৌয়াল আড়াই থেকে তিন মণ মধু পেতেন। কিন্তু এবার দুই কেজিও পাননি। মাইলের পর মাইল বন পায়ে হেঁটেও কোনো মৌচাক কিংবা মৌমাছির দেখা মিলছে না। এসব মৌয়াল ১৫-২০ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু আহরণ করে আসছেন। কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি তাদের।
উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের মধু ব্যবসায়ী ইব্রাহীম বনি আ. রশিদ জানান, তিনি মৌয়ালদের কাছ থেকে প্রতিবছর নগদ টাকায় কিনে মধুর ব্যবসা করেন। কিন্তু এ বছর এক কেজি মধুও কিনতে পারেননি। বনসংলগ্ন খুড়িয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী জালাল মোল্লা জানান, তিনি এবার পাঁচটি নৌকার পাস করেছেন মধু আহরণের জন্য। তাতে এ পর্যন্ত মধু পেয়েছেন মাত্র তিন মণ। গত বছর এই সময়ের মধ্যে ওই পাঁচ নৌকায় পেয়েছিলেন ১৫০ মণ মধু। গতবার যে মধুর মণ ছিল ১০ হাজার টাকা, এবার সেই মধুর মণ ১৮ হাজার টাকা বলে জানান তিনি।
লোকালয়ে অসংখ্য মৌচাক থাকলেও তাতে মধুর পরিমাণ খুবই কম এবং মানও ভালো নয়। লোকালয় থেকে যে মধু পাওয়া যাবে, তাতে চাহিদার এক ভাগও পূরণ হবে না। ফলে মধু সংকটের কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও ভেজাল মধুর ছড়াছড়ি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এসব ব্যবসায়ী।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, এ বছর শরণখোলা রেঞ্জের আওয়াতাধীন শরণখোলা, বগী ও সুপতি স্টেশনে প্রথম ধাপে মধু সংগ্রহের জন্য ৪০টি নৌকার পাস (অনুমতি) হয়েছে। বনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের তিন শতাধিক মৌয়াল বনে যান। কিন্তু মধু না পেয়ে তাদের মধ্য থেকে শতাধিক মৌয়াল ফিরে এসে পাস জমা দিয়েছেন।
চাঁদপাই রেঞ্জের ফরেস্ট রেঞ্জার (চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা) গাজী মতিয়ার রহমান জানান, তাদের রেঞ্জে বরাবরই মধুর পরিমাণ কম। সে কারণে পাসপারমিটও কম হয়। যারা মধু সংগ্রহে গিয়েছিল, তারা খালি হাতেই ফিরছে বলে জানান তিনি।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (ওয়াইল্ড লাইফ) খুলনা অঞ্চলের ডিএফও মো. জাহিদুল কবির বলেন, মধু আহরণের সময় চাকের কিছু অংশ রেখে দিতে হয়। পরে ওই অংশে আশ্রয় নেওয়া রানি মৌমাছিকে ঘিরেই পুরুষ মৌমাছি সেখানে চাক তৈরি করে। মৌয়ালদের ভুলের কারণেও এমনটি হতে পারে। এ ছাড়া এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে বনে ফুলের সংখ্যা কম। তাই খাদ্য সংকটেও মৌমাছিরা অন্যত্র চলে যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধ্যান না করে সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না।
Source: http://www.dainikamadershomoy.com/todays-paper/more-news/10715
Photo Source: www.cometosundarbans.blogspot.com