সামুদ্রিক আগাছা Sargassum
পরিপক্ক সারগাসাম
সমুদ্র তার বক্ষে শুধু প্রানীদের আশ্রয় দেয়নি দিয়েছে অনেক উদ্ভিদের আশ্রয়। তাইতো আমরা উপমা দিয়ে থাকি “সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয়”। এমনি এক উদ্ভিদ সারগাসাম এই বিশাল সমুদ্রে আশ্রিত যাকে মেক্রো শৈবাল বলা হয়। এটি মুলত বাদামি শৈবাল যা Phaeophyceae শ্রেনী ভুক্ত ও Fucales বর্গের সামুদ্রিক উদ্ভিদ। এদের অসংখ্য প্রজাতি আছে যারা ক্রান্তিয় ও উপক্রান্তিয় সমুদ্রে বসবাস করে। আমাদের সেন্টমার্টিন কোরাল দ্বীপে এদের দেখা যায়।পর্তুগীজ নাবিক এই শৈবালকে প্রথম Sargasso নামক সমুদ্রে দেখতে পেয়ে এর নামকরন করেন Sargassum.তখন এই সব শৈবাল নাবিকদের সমুদ্র পথে চলাচলে খুবই বিঘ্ন ঘটাতো। Sargassum বর্তমানে চাষ করা হয় যা ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য।চায়নাতে সারগাসাম(S pallidum)পাউডার চা হিসেবে heat phlegm এর চিকিৎসায় পান করা হয়।
পুরু কান্ড যুক্ত সারগাসাম সমুদ্রের তীরের কাছাকাছি জন্মে। কিছু কিছু সামুদ্রিক প্রানীদের প্রধান খাদ্য হলো সারগাসাম। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকাতে মানব স্বাস্থের জন্য উপকারি হিসেবে সারগাসাম কে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যক্ষা উপশমে, আথ্রাইটিস, ঠান্ডা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ও অনেকের মতে সারগাসাম খেলে অপজিট সেক্সের প্রতি আকর্ষন বৃদ্বি পায়। বহু বছর ধরে চায়নাতে ক্যান্সার ও টিউমারের চিকিৎসায় Sargassum ব্যবহার করা হচ্ছে। বাচ্চা প্রসব কালীন সময়ে cervix কে dilate করতেও সারগাসাম ব্যবহার করা হয়।
শৈবাল বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। বাংলাদেশে যদিও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ একটি নতুন ধারনা। কিন্তু এ দেশেই রয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের অপার সম্ভাবনা। আমাদের দেশের প্রায় ৭১০ কি.মি.ব্যাপী রয়েছে সমুদ্রসৈকত। যেখানে পরিকল্পিত বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ অর্থনৈতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১৩৩ প্রজাতির অধিক শৈবাল পাওয়া যায়। (Dr Nurul Islam et el) যার মধ্যে ৮ প্রজাতির শৈবাল বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যা সাধারনত সবুজ(Cholorophyta),লাল(Rhodophyta) ও বাদামী(Phaeophyta) রঙের হয়ে থাকে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সামুদ্রিক শৈবালের গুরুত্ব অপরিসীম। এর রয়েছে অনেক ঔষধি গুন। লাল ও বাদামি বর্ণের শৈবালে ক্যারোটিন নামে এক ধরনের উপাদান আছে যা মানবদেহে খাদ্যাভাসে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটা কমায়। ডায়রিয়া এবং টিউমার বৃদ্ধি রোধ ও প্রতিরোধ করে। এতে বিদ্যমান ক্যরাজিনান মানবদেহের উচ্চরক্ত চাপ (BP)কমাতে সহায়তা করে। ইনসুলিন উৎপাদনকারী প্যানক্রিয়াসের নিস্ক্রিয়কোষ গুলোকে ধীরে ধীরে পুনরায় উজীবিত করে তোলে যা ইনসুলিন নিঃসরনে সাহায্য করার কারনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে। হৃদরোগ, ব্রেণস্ট্রোক-এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
সামুদ্রিক শৈবালের রয়েছে নানাবিদ ব্যবহার। পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান-প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন ডি রয়েছে শৈবালে। দেশীয় প্যাকেটজাত ও কোমল পানীয়, জেল, জেলি, সংরক্ষিত খাদ্যে, আইস ক্রিম, সেম্পু, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন প্রকার নিত্য ব্যবহার্য জিনিস উৎপাদনে ব্যবহার হয় শৈবাল। তথা মানবদেহে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়াও জুতার পলিশ তৈরীতে সামুদ্রিক শৈবাল প্রচুর পরিমানে ব্যবহার হয়।শৈবাল সার উৎপাদন, সমুদ্রের দূষন রোধেও ভূমিকা রাখে।
সামুদ্রিক শৈবালের বিভিন্ন প্রকার পিগমেন্ট রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।বিভিন্ন রকমের প্রশাধনী তৈরিতে যেমন লিপস্টিক তৈরী করতে শৈবালের pigment ব্যবহার করা হয় ও এই পিগমেন্ট খুবই উন্নতমানের। সামুদ্রিক শৈবালের পিগমেন্ট ব্যবহার করে কিস প্রুফ (kiss proof) লিপস্টিক তৈরি করা হয় যা হালের ফ্যাশনে আজকাল খুবই জনপ্রিয়।বাংলাদেশের বিশাল এই সমুদ্রকে যদি কাজে লাগানো যায় তবে খাদ্যের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যজীবি চাষিদের বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে শৈবাল চাষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। তাছাড়া এ চাষের মাধ্যমে ওইসব অঞ্চলের নারী-পুরুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।
বাংলাদেশ কোস্ট ট্রাস্টের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বছরে প্রায় দুই হাজার টন শৈবাল পাচার হয়। অথচ বৈধ পথে এ শৈবাল বিদেশে রফতানি করা হলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হতো।পরিকল্পিতভাবে শৈবাল চাষ করা হলে সামুদ্রিক এলাকাজুড়ে বিশাল মৎস্যভান্ডার গড়ে তোলা সম্ভব। কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সামুদ্রিক শৈবাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য,ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, হংকং, মিয়ানমারসহ পৃথিবীর অনেকদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সম্ভাবনা রয়েছে। যা দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করতে পারে।গবেষকদের উচিত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনা করে লাভজনক শৈবাল চাষের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা। যেন তা মৎস্য সেক্টরে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
★সতর্ক বার্তাঃ হার্বাল ঔষধ সহ যে কোন ঔষধ একমাত্র qualified practioner এর পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিৎ। সব ঔষধের নির্দিস্ট সেবন মাত্রা ও চিকিৎসার সময়কাল আছে যা সঠিকভাবে মেনে চলা উচিৎ। সুতরাং অনুগ্রহ করে আমার প্রদত্ব তথ্যের ভিত্তিতে কেউ নিজ দায়িত্বে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা করা থেকে বিরত থাকুন।
ছবি: গুগলের সৌজন্যে।