অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার সাক্ষাৎকার

  • D Sarma
  • Dwijen Sarma

Nature Study ‍Society-র পক্ষ থেকে সম্প্রতি আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম স্বনামধন্য নিসর্গী ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার। দ্বিজেন শর্মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার এম.এসসি (১৯৫৮)। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ ও ঢাকার নটরডেম কলেজে অধ্যাপনা করেছেন অনেকদিন (১৯৫৮-১৯৭৪), অতঃপর মস্কোর প্রসিদ্ধ অনুবাদসংস্থা ‘প্রগতি প্রকাশনে’ অনুবাদক হিসাবে কর্মরত ছিলেন (১৯৭৪-১৯৯১)। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘জীবনের শেষ নেই’ (১৯৭৮, ২০০০), ‘শ্যামলী নিসর্গ’ (১৯৮০, ১৯৯৬), ‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাসতত্ত্ব’ (১৯৮১), ‘সতীর্থবলয়ে ডারউইন’ (১৯৮৪), ‘ফুলগুলি যেন কথা (১৯৮৮), ‘বিগলযাত্রীর ভ্রমণকথা’ (১৯৯১), ‘গহন কোন বনের ধারে’ (১৯৯৪)‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’ (১৯৯৭), ‘গাছের কথা ফুলের কথা’ (১৯৯৯,২০০৩), ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’ (১৯৯৯), নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’ (২০০০), ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’ (২০০৫) ইত্যাদি। তিনি বহু গ্রন্থ অনুবাদও করেছেন। প্রাপ্ত পুরষ্কার : কুদরত-এ-খুদা স্মৃতি স্বর্ণপুরষ্কার (১৯৮৬), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৮৭), এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরষ্কার (২০০০)। 

পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক নানান সমস্যা সম্পর্কে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার মূল্যবান অভিমত ও পরামর্শগুলো আজ এখানে তুলে ধরা হোল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহন করেছেন শেখর রায়।

আপনার ছেলেবেলাকার সময়ের আশেপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে কিছু বলুন।

দ্বিজেন শর্মা: আমার ছেলেবেলা কেটেছে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখাতে পাথারিয়া পাহাড় এলাকার গ্রামে। তখনকার সময়ে আশেপাশে প্রচুর গাছপালা ছিল – যেমন বনজ গাছ তেমনি ফুলের গাছও ছিল অঢেল। গ্রামের সবার বাড়িতেই এমনকি জেলে কিংবা মাঝি সম্প্রদায়ের বাড়িতেও প্রচুর ফুলের গাছ ছিল। আমার বাবা ছিলেন কবিরাজ। বাড়িতে প্রচুর ভেষজ গাছপালা লাগিয়েছিলেন তিনি। আমরা ব্রাক্ষ্মণ বলে বাড়িতে নিত্যপূজার জন্য প্রতিদিনই ফুলের দরকার হোত। তাই সারাটা বাড়িই ছিল ফুলে ফুলে ভরা। আমরা এ পরিবেশেই বড় হয়েছি। দেশবিভাগের পর আমাদের গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় বেশিভাগই চলে গেছে। পাথারিয়ার পরিবেশও এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পাহাড়ের গাছপালা সব কাটা পড়েছে। আগে সেখানে কত রকমের যে গাছপালা ছিল – নাগেশ্বর, মাকড়িশাল, কুর্চি আরো নানান প্রজাতির ভেষজ ছিল – আমার বাবা সেখান থেকে কতো ভেষজ গাছপালা সংগ্রহ করতেন। কিন্তুএখন এখানে কিছু ইটভাঁটা আর স’মিল হয়েছে। এখানে গাছের যোগান দিতে গিয়েই এলাকার গাছপালা সব উজাড় হয়ে গেছে। আমি কিছুদিন আগেও বাড়িতে একটি কুর্চি আর একটি কনকচাঁপা গাছের চারা লাগানোর জন্য পাহাড়ে অনেক খুঁজেও কোন চারা পাইনি। কেবল আমাদের বাড়িতেই এখনো কিছু গাছপালা রয়েছে, আমরাও নতুন করে কিছু লাগিয়েছি।

নটরডেম কলেজের গাছপালা সমৃদ্ধ এই সুন্দর নৈসর্গিক ক্যাম্পাস নির্মানে আপনার অবদান অপরিসীম। কখন ও কিভাবে একাজ শুরু করলেন সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

দ্বিজেন শর্মা:  নটরডেম কলেজে আমি যোগ দেই ১৯৬২ সালে। সম্ভবত ১৯৬৫ সালে কলেজ বাউন্ডারিতে ছোট্ট একটা জায়গাতে ছাত্রদের ব্যবহারিক ক্লাশের জন্য কিছু স্পেসিমেনের গাছ লাগাই। সে সময় সারা কলেজ ক্যাম্পাসেই বাগান করার প্রস্তাব দিই ফাদার টিমকে। উনি আমার প্রস্তাবটা সমর্থন করেন। ফাদার বেনাস সেদিনই কলেজ ছুটির পর আমাকে বায়োলজি ল্যাবে আসতে বলেন। আমি গিয়ে দেখি যে তিনি পুরো কলেজের মডেল সামনে নিয়ে বসে আছেন। কাঠির ওপরে তুলো জড়িয়ে কিছু গাছের মডেলও বানিয়েছেন। ফাদার বললেন – এই লন এই মাঠ সব আছে – কোথায় কোন গাছ লাগাবে দেখ। সেই গাছ লাগানোর শুরু হল। আমারও ল্যান্ডস্ক্যাপিং এ এই প্রথম হাতেখড়ি। কোন গাছের উচ্চতা, মাথার আকার-আকৃতি, পাতার রঙ এসব নিয়ে কোন ভিন্ন মত হলেই ফাদার তার ভেসপার পেছনে চড়িয়ে চলে যেতেন সেই গাছের কাছে। আমি তখন ঢাকার প্রায় সব গাছপালাই চিনি। শ্যামলী নিসর্গ লিখছি তখন। কাজেই কোথায় কোন গাছ পাওয়া যাবে তা ভালই জানতাম। এভাবেই আমরা কলেজের ল্যান্ডস্ক্যাপিং এর প্ল্যানটা করি। পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির মালি মোক্তারকে আমাদের কলেজে নিয়ে আসি। সে খুবই হেল্পফুল ছিল। এভাবেই ক্যাম্পাসটা গড়ে ওঠে। অসাধারণ সুন্দর একটা ক্যাম্পাস। আমি তো ৩/৪ বছর পরে প্রায় সন্ধ্যায়ই কলেজে গিয়ে মাঠে একা একা বসে থাকতাম বা ঘুরে বেড়াতাম। একেবারে অসম্ভব নীরবতা চারদিকে। পাখি আসত কতো। একেবারে আলাদা এক সৌন্দর্য ছিল যা আমি দারূণ উপভোগ করেছি। আমি আশা করি যে এই প্রজন্মের ছেলেরাও এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হবে, এনজয় করবে এবং শিখবে কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করতে হয়, প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজানো যায় এবং একটা ছোট্ট বাড়িকেও কিভাবে গাছপালা দিয়ে চমৎকার করে সাজানো যায়। এটা একটা বড় শিক্ষা।

আপনাদের সময়কার ঢাকা শহর আর এখনকার ঢাকা – এ দু’য়ের পরিবেশগত মিল অমিল কতোটুকু ?

দ্বিজেন শর্মা: এখনকার ঢাকা শহর তো সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমি ১৯৫৬ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসি। তখন মতিঝিলে আমরা প্ল্যান্ট কালেকশনে যেতাম। মতিঝিল তখন ছিল একটা প্রশস্ত জায়গা, একটা বোধহয় দালান ছিল, নওয়াব বাড়ির ভাঙ্গা ধ্বংসাবশেষ ছিল একটা। আর কিছুই ছিল না। আমি থাকতাম তখন তেজগাঁয়ে। এর পর শহর বলতে কিছু ছিল না। সবচাইতে আকর্ষনীয় ছিল রমনা গ্রীন আর ইউনিভার্সিটির এলাকা। ১৯৬৫তে আমি সিদ্ধেশ্বরীতে চলে আসি। প্রায় রোজই আমি আর আমার বন্ধু আলী আনোয়ার দু’জনে মিলে এই অঞ্চলে দিনরাত কতো যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কি যে সুন্দর ! সেই হেয়ার রোড এর রাত্র, মিন্টো রোডের রাত্র, বেইলি রোডের রাত্র, রাস্তার নিয়ন আলো এবং এই সবুজ, এই ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তন, কতো ফুল, কতো গাছ – এগুলি নিয়েই আমার বইয়ের নাম আমি “শ্যামলী নিসর্গ” রেখেছি। তাতে ওই জায়গার ছবি অনেকটাই ধরা পড়েছে। যেটা এখন ইতিহাস মাত্র। এখন এতোসব মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হয়েছে, গাছপালা কাটা পড়েছে, প্রাউডলক যে প্ল্যান করেছিলেন যার কিছু কিছু এখনো রমনা গ্রীনে আছে। আমরা সেটাকে ফলো করিনি। রাস্তার দু’পাশ বাদ দিয়ে আমরা এখন মিড আইল্যান্ডে গাছ লাগানোর চেষ্টা করি। তাতে গাছের কিছুই হয়না আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা তখন ছিল ১৫ লক্ষ, এখন তো ১ কোটির মতো হয়ে গেছে। তাদের বাড়িঘর, তাদের আবাসন, তাদের সমস্যা, যানজট এগুলো সেকালে একেবারে কিছুই ছিল না। আমরা তখন বেইলি রোডে হেঁটে বেড়িয়েছি, একটা গাড়িও হয়তো তখন দেখিনি ঘন্টার পর ঘন্টা। এখন সিদ্ধেশ্বরীতে আমার বাড়ির সামনের রাস্তাই আমি পার হতে পারি না। এই সবকিছুই একেবারে বদলে গেছে।

বর্তমানে ঢাকা শহরে যে বিউটিফিকেশন প্রোগ্রাম চলছে এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলুন।

দ্বিজেন শর্মা: ঢাকায় প্রথম যখন বিউটিফিকেশন প্রোগ্রাম শুরু হয় আমার বেশ ভালোই লেগেছিল। বহুদিন ধরেই এ ধরনের কিছুই করা হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শহরের সৌন্দর্যায়ন শহুরে স্থাপত্যেরই একটা প্রধান অংশ। সেখানে শহরের বাড়িঘর যখন বানানো হয় তখন শহরের আশেপাশের পরিবেশও তারা একইসঙ্গে প্ল্যান করে থাকে এবং সেভাবেই তার বাস্তবায়ন হয়। আমাদের শহরের বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গে মিলিয়ে ল্যান্ডস্ক্যাপিং কিছুই করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে শহরে সৌন্দর্যায়নে সময়ে দেখলাম যে বেশ বড় বড় বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সৌন্দর্যায়নের যে কর্মসূচী সেটাও দ্বি-মাত্রিক ( Two Dimentional), দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মিলিয়ে অনেকটা মৌসুমি ফুলের বাগানের মতো। এটা সৌন্দর্য বাড়ায় তবে এই মূহুর্তে আমাদের শহরে সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন তা হল শহরে প্রচুর পরিমাণে বড় বড় গাছ লাগানো। আমাদের প্রয়োজন আবহাওয়ার দূষণ কমানো, অক্সিজেনের উৎপাদন বাড়ানো এবং যেহেতু আমাদের দেশ গ্রীষ্মপ্রধান সেজন্য রাস্তায় দরকার ছায়া। গাছপালা লাগানোরও একটা বিজ্ঞান আছে, সেই বিজ্ঞান আমরা অনুসরন না করলে এবং সেভাবে শহরের বড় বড় গাছের ছায়া বিস্তার করতে না পারলে এই সৌন্দর্যায়ন অনেকটা হবে কসমেটিক ট্রিটমেন্টের মতো। এটা রক্ষণাবেক্ষন করা বেশ কষ্টকর হবে। কারণ যত্ন না করলেই এটা লোপ পাবে। সারা শহর ধরে বছরের পর বছর জুড়ে এদের এতো সতর্ক যত্ন করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। এটা কিন্ত সৌন্দর্যানের একটা অংশ মাত্র, মূল অংশটাই বাদ পড়ে গেছে। এ মূল অংশটা হচ্ছে আমাদের শহরে নানা জাতের সুন্দর সুন্দর বড় বড়, টেকসই গাছ লাগানো এবং শহরটাকে রমনা গ্রীনের মতো সবুজ অঞ্চলে রূপান্তরিত করা দরকার। এর পরই এখনকার মতো এমন কসমেটিক সৌন্দর্যায়ন হতে পারে।

বর্তমানে ঢাকা শহরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে যে পরিমাণ গাছপালা থাকা দরকার সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

দ্বিজেন শর্মা: আমি পড়েছিলাম যে প্রত্যেক শহরে মাথাপিছু কমপক্ষে ৩টি করে বড় গাছ থাকা প্রয়োজন। আমাদের ঢাকার জনসংখ্যা যদি ১ কোটি হয় তবে ঢাকায় ৩ কোটি গাছ থাকা প্রয়োজন। এই হিসাবে আমাদের ঢাকায় কতোটা গাছ আছে ? প্রায় কিছুই নেই। এটা পরিবর্তন একান্ত প্রয়োজন। সেই সাথে আরেকটি দিকও আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি – সেটা হল – যেহেতু আমাদের জনসংখ্যা এতো বেশি, জায়গা এতো কম – আমরা বড় বড় পার্ক তৈরি করতে পারি – লন্ডনে যেমন চেইনের মতো পার্ক আছে যার একটা থেকে আরেকটায় যাওয়া যায় – এতো বড় বড় পার্ক আমরা করতে পারবো না। আমাদের প্রয়োজন ছিল রাস্তাগুলোকে বড় করা এবং রাস্তার দু’পাশে দুই সারি করে বড় বড় গাছ লাগানো। আমাদের সমস্ত শরীরে ধমনীগুলো যেমন রক্ত সরবরাহ করে তেমনি রাস্তাগুলো হল শহরের ধমনী। রাস্তাগুলোর দু’পাশে গাছ লাগানো গেলে সবুজে সবুজে শহরটা ভরে যেত। আর আমরা শহরের সমস্ত জলাভূমি বাড়ি বানানোর জন্য ভরাট করে ফেলছি। এটা আরেকটা বড় ক্ষতি। এতে শহরের আবহাওয়া বদলে যাবে, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে আরো নানান সমস্যার সৃষ্টি হবে। এখন আন্তর্জাতিকভাবে সারাবিশ্বে যখন জলাভূমি সংরক্ষণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে তখন আমরা মুখে বলি জলাভূমির সংরক্ষণের কথা অথচ বাস্তবে তার উল্টোটা করি। আমাদের নদীগুলো পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে ! এধরনের অরাজকতাও এক ধরনের সন্ত্রাস – প্রকৃতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমাদের জলাভূমি গুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে, ওগুলো যত্ন করে খুঁড়ে ওখানে নানান ধরনের জলজ গাছপালা লাগিয়ে এগুলোকে জলজ পার্কে রূপান্তর করতে হবে। এগুলো শুধু আমাদেরই নয় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একান্ত প্রয়োজন – তা নাহলে তারা আমাদের অভিশাপ দেবে।

বর্তমানে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে যে বৃক্ষরোপন কর্মসূচী চলছে এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি ?

দ্বিজেন শর্মা: খুবই যান্ত্রিকভাবে বর্তমানে বৃক্ষরোপনের এ কাজটা করা হয়। আমি বহু চেষ্টা করেছি, এ নিয়ে বহু লেখালেখি করেছি। এক এক সময়ে বৃক্ষায়ণের এক এক রকম ঝোঁক উঠে – ফলজ বৃক্ষ, বনজ বৃক্ষ, ভেষজ বৃক্ষ – কিন্তু কার্যত লাগানো হয় দেখেছি মেহগনির গাছ আর বিদেশি একাশিয়া বা এ জাতীয় গাছ। সব জায়গায় ফলের গাছ লাগানোর প্রয়োজন নেই। যদি কেউ কাঠের গাছ লাগাতে চান তাহলে সেটা তিনি তার ব্যক্তিগত আয বৃদ্ধির জন্য করতে পারেন। কিন্তু জনসাধারণের জন্য যেসব গাছপালা লাগাতে হবে সেগুলো সঠিকভাবে নির্বাচন করা দরকার – কোথায় লাগানো হবে, কেন লাগানো হবে ইত্যাদি। রমনা পার্কে অনেকগুলি মেহগনি গাছ লাগানো হয়েছে যার কোন প্রয়োজন নেই। হেয়ার রোডে, মিন্টো রোডে যেখানে প্রাউডলক সাহেব যেসব গাছ লাগিয়েছিলেন তার ফাঁকে ফাঁকেও মেহগনি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বত্র মেহগনি লাগানো হয়েছে – স্কুলে, কলেজে, সরকারি অফিসে, আদালতে যেখানে খালি জায়গা সেখানেই মেহগনি। এটা একটা অদ্ভুত মানসিকতা এবং বড়ই অদূরদর্শী এসব পরিকল্পনা। কখনো যদি মেহগনি গাছের কোন অসুখ হয়, মেহগনি গাছ যদি মারা যায় তাহলে বাংলাদেশ বৃক্ষশূন্য হবে। সুতরাং বৃক্ষরোপনও একটা বিজ্ঞান, এতে যেমন বিজ্ঞান আছে, তেমনি নন্দনতত্ত্ব আছে, তেমনি পরিবেশ চেতনা আছে। অনেক কিছু মিলিতভাবে আছে। সেজন্য বৃক্ষরোপনের জন্য একটা নির্দিষ্ট কমিটি থাকা দরকার, তাদের আলোচনা করা দরকার, প্রজাতি নির্ধারণ করা দরকার, সেগুলি যাতে লাগানো ও রক্ষা করা যায় তার তদারকি দরকার এবং সর্বাপরি দরকার যারা একাজে নিয়োজিত আছেন প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা। যান্ত্রিক ভাবে এসমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়না।

জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপন অভিযানে জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে কি ধরনের গাছপালা লাগানো দরকার বলে মনে করেন ?

দ্বিজেন শর্মা: জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে প্রথমত পরিবেশ বান্ধব গাছপালাই লাগানো দরকার। যেমন আমাদের শহরে পাখির খাবারের উপযোগি গাছপালা নেই এবং এ ধরনের গাছপালার কোন সঠিক তালিকাও পাওয়া যাবে না। যারা দীর্ঘদিন পাখি নিয়ে কাজ করেন, যারা পাখি চিনেন – তারাই বলতে পারেন পাখি কি ফল খায়, কোন্ ধরনের গাছের ফল খায় ইত্যাদি। এটা নিয়ে আরো কাজ করা উচিত, গাছের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা উচিত এবং বৃক্ষরোপণের সময় এ গাছগুলোকে যাতে প্রাধান্য দেয়া হয় সেদিকে নজর দেয়া উচিত। যেমন – একটা গাছ আছে জীবন বৃক্ষ – আমার এক বন্ধুর কাছেই এ সম্পর্কে প্রথম শুনি। তার বাড়িতে এ গাছ ছিল – সেখানে নাকি নানান জাতের পাখি আসত। আমি একদিন সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখি ঠিকই। অথচ এ গাছটা যত্রতত্রই হয়। আমি একবার রমনা পার্কে পাকুড় গাছে লটকন বা ইন্ডিয়ান লরিকিট Loriculus vernalis) পাখি দেখেছিলাম। সেই পাকুড় গাছটা এখন নেই। বটগাছে প্রচুর পাখি আসে। কিন্তু বট অনেক জায়গা নিয়ে বড় হয় বলে বটগাছ লাগানোর সমস্যা আছে। দ্বিতীয় কথা হল – আমাদের দেশ যেহেতু নিুাঞ্চলে এবং জলাভূমিও আমাদের দেশে প্রচুর তাই জলাভূমির বনায়ন আমাদের দেশে খুবই জরুরী। আমরা যদি হাওড় এলাকায়, বিল এলাকায় প্রচুর হিজল, জারুল, বরুণ – এ জাতীয় গাছ লাগাতে পারি তাহলে আমাদের পুরো ল্যান্ডস্ক্যাপই বদলে যাবে। সেখানে নানা জাতের পাখি ও অন্যান্য ছোটখাট জীবজন্তুও আশ্রয় পাবে। এবং এমন গাছও আমরা খুঁজতে পারি যে গাছের ফল পানিতে পড়লে মাছে খাবে। আমাজনে এরকম গাছ আছে। আমাদের বরুণ গাছের গোটা মাছ খায় কিনা আমি জানিনা। পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছ সাদা শাপলা এবং শালুক খেয়ে ফেলে কিন্তু লাল শাপলা খায় না। তাই তেলাপিয়া মাছ যদি আমরা আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছাড়ি তবে আমাদের জাতীয় ফুল ভবিষ্যতে থাকবে না। আমি একবার বলধা গার্ডেনের পুকুরে দেখেছিলাম যে সেখানে একটাও সাদা শাপলা নেই – আমাজন পদ্ম (ঠরপঃড়ৎরধ ৎবমরধ) আছে আর লাল শাপলা আছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের সাদা শাপলা কি হল ? ওরা বলল, ছিল কিন্তু এখন তো দেখছি না। বললাল, তেলাপিয়া আছে ? – আছে। তারপর পুকুর শুকিয়ে জল ফেলে দিয়ে তেলাপিয়া নিঃশেষ করে ওখানে আবার শাপলা লাগানো হল। কিন্তু অনেক সময় যারা বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ করে তারা নিজেরা খাওয়ার জন্য আবার পুকুরে তেলাপিয়া ছেড়ে দেয়। রমনা পার্কে যে এতোবড় লেক আছে এটাকে কি একটা ওয়াটার গার্ডেন করা যায় না ? তা না করে সেখানে মাছের চাষ করে। মাছের চাষ কেন হবে পার্কে ? এটা তো ব্যবসার জায়গা নয়। যেজন্য পার্কে কোন মেহগনি গাছ লাগানোর প্রয়োজন নেই সেই একই কারণে পার্কের লেকে মাছ চাষেরও কোন প্রয়োজন নেই।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফ্যামিলি গার্ডেনিং এর তাৎপর্য কি ?

দ্বিজেন শর্মা: ফ্যামিলি গার্ডেন খুবই দরকার। প্রথমত গাছপালা দেখলে নিজের মন ভাল থাকে। এটা একটা চমৎকার শখ, এজন্য গাছপালা সংগ্রহ, গাছপালার বই কেনা, বই পড়া, বই দেখা, গাছপালার মাধ্যমে বৃহৎ প্রকৃতির সঙ্গে এমনকি একটা নতুন জীবনদর্শণের সাথেও আমরা পরিচিত হতে পারি। দ্বিতীয়ত ছেলেমেয়েরা গাছপালা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারে। এগুলো তাদের পাঠ্য বিষয়ে যেমন সহায়ক হবে তেমনি মানষিক বিকাশে, সৌন্দর্যবোধ বৃদ্ধিতে, প্রকৃতিপ্রেম বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের দেশে এখন নিজেদের বাগান করার মতো জায়গা নেই। খুবই কম জায়গা। সেজন্য আমাদের মানুষের গাছপালার প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তারা নিজেদের নিজেদের ছোট্ট ব্যালকনিতে প্রচুর গাছপালা লাগায়। ঢাকায় এখন এতোগুলো ফুলের দোকান হয়েছে যে এতে বোঝা যায় ফুলের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এর একটা বাণিজ্যিক দিকও রয়েছে যা যথেষ্ট লাভজনক। কিন্তু যারা গাছপালা কিনেন বা লাগান বা আনেন তাদের অনেকেই আমার ধারণা এগুলির সঠিক নামধাম, গোত্র ইত্যাদি জানেন না। এজন্য তাদের উচিত এগুলি সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা, এগুলি সম্পর্কে ভালভাবে জানা এবং তাদের ছেলেমেয়েদেরকে এগুলি সম্পর্কে বলা। তাতে একদিকে যেমন তারাও লাভবান হবেন, তেমনি ছেলেমেয়েরাও লাভবান হবে, সমাজও লাভবান হবে। গাছপালা সম্পর্কে এ আগ্রহটা খুবই আশাব্যঞ্জক, খুবই পজেটিভ। কারণ আমাদের তো আর এই শহরে নিজের বাগান করার মতো জায়গা নেই, যেটুকু ব্যালকনি কিংবা ছাদ আছে তারই সদ্বব্যবহার করা উচিত।

আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

দ্বিজেন শর্মা: আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমরা ইকোলজি পড়েছি। আমি বলছি পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের কথা। তখন কিন্তু ইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস বলতে কিছুই ছিল না, এনভায়রনমেন্ট সাইন্স বলতে কিছুই ছিল না। এগুলি সব নতুন কারণ পৃথিবী এই পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরিবেশগত সমস্যা এতোই জটিল হয়েছে যে এটা তার অস্তিত্বকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের যে কোন উদ্দ্যোগই এখন একাধারে প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্যও বটে। ফলে Nature Study ‍Society পত্রিকা যদি কিছুমাত্রও প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি ভালবাসা লালনে কোন ভূমিকা রাখে সেটা আমাদের সকলের জন্যই অত্যন্ত মঙ্গলজনক হবে। আমি আশাকরি তারা যেহেতু এ দায়িত্ব নিয়েছেন তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে তারা প্রকৃতির এই সমস্যা সম্পর্কে, মানুষের সমস্যা সম্পর্কে খুবই সচেতন এবং তারা এটা চালিয়ে যাবেন।

পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

দ্বিজেন শর্মা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার গ্রহন: শেখর রায়, ১১/০৩/২০০৫