কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন
ফুলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবে হয়েছিলো মনে নেই। তবে ছোট বেলায় ঝুমকো ফুলের (Passiflora foetida) সাথে আমার প্রনয় ছিলো গোপনে অভিসার হতো, এই ফুলের বেগুনী রঙ ও মিস্টি গন্ধ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো, তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে চুমু খেতে যেয়ে কত পিপড়া যে আমার নাসারন্ধ্র দিয়ে ঢুকেছে তা ঝুমকা ফুল জানে।
আমার শৈশবের সাথে আস্টে পিস্টে জড়িয়ে ছিলো গন্ধরাজ (Gardenia florida)। এর শ্বেত শুভ্র পাপড়ী ও সুগন্ধ আমাকে মাতাল করে দিত। এর গন্ধে চারিপাশ মৌ মৌ করত আর মৌমাছির গুনগুন শব্দ বিখ্যাত সেতার বাদক উস্তাদ রবিশংকরকেও হার মানিয়ে দিতো। এর পরিপক্ক পাপড়ি দিয়ে মা প্রায় দিনই বড়া ভেজে দিতেন যা দুপুরের মেন্যুতে থাকতো আহা…(!) সেই স্বাদ ও রসনা বিলাসের কথা আজও ভুলতে পারিনি। আমাদের সময় বল পয়েন্ট তখনও আবিস্কার হয়নি হলেও গ্রামে পৌঁছায়নি তখনও, আমরা লিখতাম ঝরনা কলম দিয়ে, কালি শেষ হলে দোয়াত টি ভাল করে ধুয়ে পানি ভর্তি করে এতে গন্ধরাজ ফুল রেখে দিতাম তাও আবার পড়ার টেবিলে।
আমার বাবা ছিলেন ফুলের ভক্ত তাঁর একটা বাগান ছিলো তাতে ছিলো নানান জাতের বাহারী ফুল। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দুরেই ছিলো রক্ত কাঞ্চন (Bauhinia variegata) ফুলের গাছ বসন্তে ফুল ফোটার সময় কত যে একা একা দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্যে স্নান করেছি ও বসন্ত বাতাসে পাতাঝরা নূপুরের তালে নৃত্য দেখে মন ব্যাকুল হয়েছে, আর ভেবেছি কেন আমাদের বাগানে এই অপরূপ ফুলটি নেই।
রাস্নার (Vanda tesselata var unicolor, V roxburghii) প্রেমে পড়ে পুরা গাছ এনে ঘর ভরে রাখতাম আর অপলক নয়নে এর সৌন্দর্য সুধা পান করতাম। তখন তো উইলিয়াম রক্সবার্গ কে চিনতাম না কিন্তু আজ এই প্রকৃতি প্রেমী উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কে অবনত চিত্তে শ্রদ্বা,ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি।
দিনগুলো ভালই কাটছিলো এমন সময় আমার মামার সাথে আশুলিয়া যাওয়ার সু্যোগ ঘটলো আর সেখানেই একটা ফুল ক্ষেতে পরিচয় ঘটলো গ্লোডিওলাস (Gladiolus communis L) এর সাথে, এর সৌন্দর্য আমাকে খুবই আকৃস্ট করলো মনে মনে স্থির করলাম পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে আমি গ্লোডিওলাস ফুটিয়ে যাবো। যথারিতি বাবাকে প্রস্তাব দিলাম কিছুক্ষন তিনি অপলক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন……..! তারপর কি ঘটেছিলো এ ব্যাপারে আমি আর কিছু না বলি আপনারা বুঝে নিবেন। আমার ইচ্ছে পূরন হলো না।
এইচ এস সি পরীক্ষা শেষে সব বন্ধুরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে আমি তখন বাবার তৈরী গোলাপ (Rosa sp) বাগানে বন্ধুদের নিয়ে প্রতিরাতে আড্ডা বসাতাম, জোৎস্না রাতে আড্ডা জমতো দখিনা হাওয়ায় ফুলেল সুবাসে। বন্ধুদের সাথে আবার মনস্থির করলাম আমি ফুল ফোটানোর কাজটাই করব। আবছা আলোয় ক্রমে ক্রমে চারিপাশ রহস্যময় হয়ে উঠতো যখন রূপার থালার মত চাঁদকে মেঘে ঢেকে দিত।
তারপর ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম ভর্তি হতে (ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য) দেখলাম পুরো পরিবেশটাই নীল করে দিয়ে দীর্ঘ দেহি এক ষোড়শী বালিকা নীল শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি ফুলতো নয় যেন নীলের ঝরনা। একটি রুক্ষ কঠিন কাস্টল লতার হ্নদয়ে এমন অপরূপ রঙের বৈভব লুকিয়ে থাকতে পারে তা কখনই ভাবিনি। নীলাভ ফুলের সৌন্দর্যে বিস্মিয় হয়ে জানতে পারলাম এই হলো কবি গুরুর নীলমণিলতা (Petrea volubilis)। তাইতো কবি দু চরন লিখেছিলেন।
নীলিমাবন্যায় শূন্যে উচ্ছলে অনন্ত ব্যাকুলতা,
তারিধারা পূস্পপাত্রে ভরি দিলো নীলমণিলতা।
নিবিড় নির্মল নীলে আনন্দের সেই নীলদ্যুতি,
নীলমণি মঞ্জরির পুঞ্জে পুঞ্জে প্রকাশে আকুতি।
কবিগুরুর নামকরন স্বার্থক আর এদিকে নীলমণির সৌন্দর্যে বাকৃবি তে ভর্তি হতে না পারায় কোন দুঃখই পাইনি।যদিও সে সময় আমার বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছেন কিন্তু আমার ধারনা নীলমণির জন্য পাগল হতে না পারাটা ছিল দুঃখের কস্টের ও অপমানের। নীলমণি আমার নীলমণি যে যাই বলুক তোমার সাথে যে আমার আজন্ম প্রেম সে আমার বন্ধুরা কি বুঝবে।
বনমালী হওয়ার ভূতটা বাবা মা মিলে আমার মাথা থেকে নামিয়ে দিলেন। একদিন প্রত্যুসে চলে আসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে কঠিন জীবন শুরু হলো। শুধু পড়া আর পড়া মন কি মানে(!) ঠিকই একদিন আবিস্কার করলাম লাল সাদা মিশ্রিত বাগান বিলাস (Bongainvillea glabra) সারা বিকাল মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আর শুধু ভাবতে লাগলাম বাগান বিলাসের নামকরনের স্বার্থকতা নিয়ে। কবিগুরু তোমায় প্রনাম।
রমনা উদ্যানের পাশেই দেখলাম চিরসবুজ আকাশমনি (Acacia monoliformis L) ফুল এত সুন্দর ও এমনভাবেই ফুটে আছে যে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্বাবোধ বেড়ে গেলো। সত্যিই তিনি অনিন্দ সুন্দর নাম দিয়েছেন সোনাঝুড়ি। (Acacia monoliformis L)
Taxonomy র ক্লাস করতে যেয়ে পরিচিত হলাম বনফুল বাসন্তির (Lindenbergia indica) সাথে সেটির নামটাও রবিন্দ্রনাথের দেওয়া। ফুল দেখতে হলুদ।
তারাঝরা একটি বিদেশী ফুল স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের ফুল, কবিগুরু তার নামও রেখেছেন “তারাঝরা”। প্রিয় পাঠক নিচে প্রদত্ব ছবি দেখলেই নামকরনের স্বার্থকতা খুঁজে পাবেন।
ছাত্রজীবনে আমার বন্ধুর বাড়ী গেলাম গাজিপুরে সেখানে উলট চন্ডালের রূপে আমি মুগ্ধ। আমার বন্ধুর মা জানিয়েছিলেন উলট চন্ডাল কে অগ্নিশিখা(Gloriosa superba) বলা হয়। প্রদত্ব ছবি আপনাকে স্পস্ট করবে কেন একে কবিগুরু অগ্নিশিখা নামে ডাকতেন।
সুধী পাঠক কবিগুরু তাঁর গান কবিতা ও সাহিত্যে অসংখ্য ফুলের নাম ব্যবহার করেছেন এমনকি অনেক ফুলের বাংলা নামকরন করেছেন। আমি এখানে সামান্য কিছু বর্ননা করার চেষ্টা করেছি আপনাদের ভালো লাগলে আমি স্বার্থক।
বনজুঁই (Clerodendrum inerme) কে দেখে কবিগুরু মুগ্ধ হয়ে পলক ফিরাতে না পেরে নাম দিয়েছিলেন পলক জুঁই। সত্যিই অপরূপ….(!)
রেংগুনক্রিপারকে (Q indica) রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন মধুমঞ্জরি সত্যিই নয়নাভিরাম এক ফুল মিস্টি গন্ধ, ভোর বেলার স্নিগ্ধ পরিবেশে এর সুবাসে পুলকিত হয়নি এমন কাউকে খোঁজে পাওয়া দায়।
আকাশনিম (M hortensis) কে কবিগুরু হিমঝুরি নামকরন করে গেছেন।
সুপ্রিয় পাঠক কানে কানে বলে রাখি (কেউ যেন না জানে) এখনও আমার বনমালী হওয়ার ইচ্ছেটা শেষ হয়ে যায়নি।
ছবি সংগ্রহঃ ইন্টারনেট।