‘অপয়া’ চেরনোবিল এখন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য- চেরনোবিল বিপর্যয়ের ৩০ বছর আজ


26 April, 2016:

চেরনোবিল-

সোভিয়েত যুগের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক কেন্দ্র। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর শৌর্য বীর্যের প্রাণ কেন্দ্র- রুশবিরোধীদের ভয় বাড়ানোর পরীক্ষা ভূমি। কত হাঁকডাক ছিল সেসময় এ চেরনোবিলের। উচ্চাকাক্সক্ষী শিক্ষিতদের চারণভূমি হয়ে উঠেছিল চেরনোবিল। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল রাত ১টা ২৪ মিনিটের সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ সব পাল্টে দিল। ‘সভ্যনগরী’ চেরনোবিল হয়ে উঠল ‘পোড়াভূমি’। ভয়াল সেই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে প্রথম ছয় মাসেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ছয় লাখ শিশু। বাধ্য হয়ে বসতি গুটিয়ে নিয়েছেন সেসব উচ্চাকাক্সক্ষী বসতিরা। সেই ঘটনার পর থেকেই চেরনোবিলকে ‘অপয়া ভূমি’ নামে অভিসম্পাত করে স্থানীয় রুশরা। ‘অপয়া ভূমি’ এখন সম্পূর্ণই জনমানবশূন্য একটি এলাকা। বাতাসে মিশে যাওয়া বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরেই সেখানে কোনো মানুষ বসবাস করার সাহস করেননি। মানুষ না থাকায়, এক সময়ের লোকালয় এখন পশুপাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। বড় প্রাণীর মধ্যে নেকড়ে, ভালুক ও ঘোড়া তাদের বসতবাড়ি বানিয়েছে চেরনোবিলে। তবে সেখানে থাকা প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা কি ধরনের তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত বা ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রাণীর সংখ্যাও জানা যায়নি। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকির চেয়ে মানুষের উপস্থিতিই প্রাণীর জন্য হুমকির কারণ। লেন্সেস্টারের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নিক বেরেসফোর্ড ব্রিটেনের পত্রিকা টেলিগ্রাফকে বলেন, সার্বিকভাবে আমরা বলতে পারি এই বিপর্যয়টির ভালো দিকই বেশি। রেডিয়েশনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। কিন্তু মানুষ থাকলে অযথাই চারদিকের পশুপাখিকে গুলি করে এবং প্রাণীরা তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হারায়। এলাকার নতুন করে ফেরত আসা মারিয়া লজবিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, এখানে কোনো রেডিয়েশন নেই। আমি কোনো কিছুতেই ভীত নই। যখন আমার মৃত্যুর বয়স হবে, এটা রেডিয়েশনে হবে না। কর্তৃপক্ষ ফেরত আসা কিছু নাগরিককে থাকার অনুমতি দিলেও ইউ ল্যাবরেটরির প্রধান লিওনিড বগদান বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বগদান চেরনোবিলে পর্যবেক্ষক দলের প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের বলতে পারি ৩ স্কয়ার জমির রেডিওএক্টিভ কতটা ভয়াবহ। এর চেয়ে বড় জায়গার পরিবর্তন নানা ধরনের হবে। আজকে যে খাদ্য তেজস্ক্রিয় মুক্ত কালকে একই জমিতে তা তেজস্ক্রিয় যুক্ত থাকবে।’ *চেরনোবিল* *বসবাসের* *উপযোগী* *হতে* *২০* *হাজার* *বছর* *লাগবে** :* পারমাণবিক দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত চেরনোবিলের পরিবেশ স্বাভাবিক হতে অন্তত ২০ হাজার বছর সময় লেগে যাবে। ৩০ বছর আগের ওই বিপর্যয়ের পর সেখানে আর মানুষ বসবাস করতে পারে না। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ শোধন হয়ে বিশুদ্ধ আবহাওয়া পেতে ৩ থেকে ২০ হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। পরিবেশবাদী সংস্থা তাদের এক গবেষণায় এসব কথা জানিয়েছে। সোমবার এ খবর দিয়েছে দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল চেরনোবিলের পারমাণবিক কেন্দ্রের বিস্ফোরণে বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক রাজ্যের থেকেও বড় এলাকা দূষিত হয়ে যায় এবং প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পারমাণবিক দুর্ঘটনার সবচেয়ে ভয়াবহ এই ঘটনার পর ২ লাখ ২০ হাজার মানুষকে ওই এলাকা থেকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া হয়। ৪ হাজার ৪৪০ বর্গকিলোমিটার কৃষিভূমি এবং ৬ হাজার ৮২০ বর্গকিলোমিটার বনভূমি বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। বেলারুশ ও ইউক্রেনের ৫০ লাখ মানুষ এখনও তেজস্ক্রিয়তার মধ্যেই বসবাস করছেন বলে জানা যায়। তেজস্ক্রিয় গবেষক ইবনে হ্যারেল ও জেমস মারসন টাইমস ম্যাগাজিনে লেখা বিশ্লেষণে জানান, ওই পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া আইসোটোপগুলো দশ হাজার বছরের অধিক সময় ধরে সক্রিয় থাকবে। কয়েক প্রজন্ম ধরে ‘ক্লিনআপ’ অভিযান চালানোর পরেও এটি সম্পূর্ণ তেজস্ক্রিয়তামুক্ত করা সম্ভব হবে না। তবে কবে নাগাদ চেরনোবিলের ওই জায়গাগুলোতে আবারও জনবসতি স্থাপন করা যাবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক ইহোর গ্রামোতকিন বলেন, ‘অন্তত ২০ হাজার বছর পর জনবসতির অনুমতি দেয়া সম্ভব।’ কিন্তু পরমাণু বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি জায়গাটি দূষণমুক্ত করতে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং ৩ হাজার বছরের মধ্যেই পুনরায় জায়গাটি দূষণমুক্ত হবে বলে তাদের আশা। এদিকে দূর্ঘটনার স্থলের ১০০০ বর্গ মাইল এলাকায় উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের পরেও পশুপাখিরা ভালোভাবেই বেঁচে আছে এখন এবং জনবসতি তুলে দেয়ার ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। পরিবেশ বিজ্ঞানী জিম স্মিথ বলেন, ‘দুর্ঘটনার আগের তুলনায় এখন ক্রমেই জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বেড়েই চলেছে চেরনোবিলে।’

Source: www.jugantor.com/ten-horizon/2016/04/26/27772

Photo Source: www.dw.com