কোভিড ১৯ ও আমাদের হাতিয়ারঃ কতটা প্রস্তুত পৃথিবী?

রুবাইয়াত-ই-তাবাসসুম

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন রোগ কতটা ভয়ানক, তার ভয়াবহতা যাচাই করার অন্যতম জনপ্রিয় একটি উপায় হল রোগবাহী জীবাণুর বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার নির্ণয় করা। একজন রোগাক্রান্ত রোগী তার মাধ্যমে আরো কতজনকে আক্রান্ত করতে পারে, সেই সংখ্যাই হল বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার, অথবা R0 (আর-নট)। জিকা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৬.৬ পর্যন্ত হতে পারে, হামের ক্ষেত্রে ১২-১৮, মৌসুমী জ্বরের ক্ষেত্রে ১ এর কিছুটা বেশি, আর কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে ২ থেকে ২.৫। সাধারণ জ্বর আর কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে আর-নট এর তফাৎটা খুব বেশি না, আর এ দুয়ের লক্ষণগুলোও কম বেশি এক ই হওয়ায় মনে হতে পারে, দুয়ের মধ্যে ভয়াবহতায় পার্থক্য নেই।

যদি আর-নট নাম্বারের দিক তাকাই, ১০রাউন্ড যাবার পর একজন সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত রোগী সর্বোচ্চ ৫৬ জনকে আক্রান্ত করতে পারে। আর-নট কে ২ ধরে এক ই মডেল কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে দাঁড় করালে, ১০ রাউন্ড পরে একজনমাত্র রোগী থেকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ২০৪৭!

কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হবার পর ৫- ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে লক্ষণ প্রকাশ হতে। লক্ষন প্রকাশ না হবার আগ পর্যন্ত এই যে সুপ্তাবস্থা, রোগাক্রান্ত মানুষ তখন কাজ করে নীরব বাহক হিসেবে। অর্থাৎ, তার অজান্তেই সে রোগ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে!

মৌসুমি জ্বরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ এর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছে শরীরে, কারণ ভাইরাসটা তাদেরকে এর আগেও আক্রান্ত করেছে। তখন জ্বর তাদেরই হয়, যারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেনি শরীরে ঐ নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যেহেতু করোনা ভাইরাস একদম ই নতুন, কারও শরীরেই স্বাভাবিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, তাই বলা যায়, পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের ই এর দ্বারা আক্রান্ত হবার আশংকা আছে।

কোভিড ১৯ এ পৃথিবীজুড়ে এ পর্যন্ত মাত্র ৩ মাসে আক্রান্ত হয়েছে ২১,৭২,০৩১। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৫,৫৪,২৩২ জন, মৃত্যু হয়েছে ১,৪৬,২০১ জনের ! আমেরিকাতে আক্রান্তের সংখ্যা এ পর্যন্ত সর্বাধিক, এবং সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সংখ্যার ভিত্তিতে জার্মানি সবচেয়ে এগিয়ে। জার্মানির মত এরকম আরো কটা দেশের সাফল্যের পিছনে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, তা হল, যত বেশি টেস্ট, তত কম ভয়াবহতা।

এখানে বিশেষত উল্লেখ করতে হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার কথা। অন্য দেশের মত শুরুতে তাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশ বাড়তে থাকলেও ক্রমশই তারা তা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় ২০১৫ সালে অর্জিত তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে। সে বছর এক প্রকার করোনাভাইরাস মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটোরি সিন্ড্রোম)  নামে এক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছিল। ১০৮৬ জন দক্ষিণ কোরীয় মার্স ইনফেকশনের স্বীকার হয়েছিলেন তখন। ২০১৫ সালেই এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হলেও সরকারিভাবে পরিকল্পনা তারা চালিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে এরকম ভাইরাস আবার ফিরে এলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। হয়েছেও তাই, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা হাজার হাজার টেস্টকিট বানিয়ে ফেললেন। তারা ডায়াগনোস্টিক টেস্টের প্রয়োজনীয়তা আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, প্রস্তুত ছিলেন ক্ষয়ক্ষতির জন্যে, তাই ক্ষতির মাশুল ও তাদের দেওয়ার কথা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু ঝামেলা বাধাল কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ার ৩১ নং রোগী, যাকে মিডিয়ায় Patient 31 বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি একাই লোকসমাগমে এসে বহু সুস্থ লোককে আক্রান্ত করার বাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন (পূর্বে উল্লেখিত আর-নট এর ব্যাখ্যাতেই বলা হয়েছে)।  এরপরে কর্তৃপক্ষ Contact Tracing এর মাধ্যমে খুঁজে বের করেন কারা পেশেন্ট ৩১ এর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। দেখা গেল প্রায় ৯০০০ লোক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এর শিকার হয়েছেন। তাদের সবাইকে টেস্ট করে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। এরপর সমগ্র দক্ষিণ কোরিয়াজুড়ে প্রায় বিনামূল্যে এর জনগণকে টেস্ট করতে সরকারি ও বেসরকারি টেস্টিং সেন্টার ঝাঁপিয়ে পড়ে । প্রায় ৬০০র ও বেশি জায়গায় দিনে ২০,০০০ পর্যন্ত মানুষকে টেস্ট করা হয়েছে।যাকেই তারা কোভিড ১৯ পজিটিভ পেয়েছে, সাথে সাথে তার সান্নিধ্যে যারা এসেছে (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং), তাদের সবাইকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে।

সবচেয়ে কার্যকরী যে পদক্ষেপটা তারা নিয়েছে, তা হল, আক্রান্ত ব্যক্তি কে কোথায় যাচ্ছে, সব তথ্যই তারা ডেটাবেসে হালনাগাদ করে জনগণের জন্যেও উন্মুক্ত করেছে এবং যখন ই অন্য কেউ সে লোকেশনের ধারে কাছে যাচ্ছে, জিপিএস এর মাধ্যমে ট্র্যাক করে তাদের মোবাইলে ইমার্জেন্সি এলার্ট পাঠানো হয়েছে।এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পারল সে কোনভাবে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রোগীর পথ দিয়ে গেছে কিনা, আর গেলেও সে সাথে সাথে টেস্ট সেন্টারে গিয়ে টেস্ট করে জেনে নিচ্ছে সে আক্রান্ত হল কিনা। ফলে আমাদের মত বিশাল সময়ব্যাপী লকডাউনেও তাদের পড়তে হয়নি।

পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে গবেষকরাও বসে নেই। বেশ কিছু ভ্যাক্সিন এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তেমন ই একটি হল mRNA-1273। এটি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে কোড করে। অন্য সব ভ্যাক্সিনের মতই, এটি প্রতিরক্ষাকারী, রোগদানকারী নয়। কোন ওষুধকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এবং রোগ দমনে কার্যকরী প্রমাণ করতে হলে একে ৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই mRNA-1273 আপাতত মাত্র ধাপ ১ এ আছে। মার্চের ৩ তারিখে প্রথম ৪৫জন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির (পুরুষ এবং গর্ভবতী নয় এমন নারী) ওপর এ ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয়। আশা করা যাচ্ছে, ২০২১ এর জুন মাস পর্যন্ত লেগে যাবে সব ধরণের যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করতে।

চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেয়া যে এন্টিভাইরাল ওষুধটার কথা এখন বলব, নাম Remdesivir। এটি ইতিমধ্যেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ধাপ ৩ এ সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৪৪০জনে এটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর ট্রায়াল ডিজাইন টা আগেরটা থেকে কিছুটা ভিন্ন। যারা নিশ্চিতভাবেই জানে যে তারা কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই এটি প্রয়োগ করা হবে।  এটি ডাবল ব্লাইন্ড, অর্থাৎ যাকে দেয়া হচ্ছে এবং যে মনিটর করছে, কেউ ই জানেনা যা ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্তবাহী শিরায় ওষুধ টা কাকে দেয়া হয়েছে! কারণ, এখানে ট্রায়ালে ২ গ্রুপে ভাগ করে ফেলা হয়। এক গ্রুপ হল কন্ট্রোল গ্রুপ, যাদেরকে Remdesivir এর মতই দেখতে হুবুহু “কিছু একটা” (সাধারণত নিরপেক্ষ কিছুই দেয়া হয়।প্রতিটা ওষুধে তাদের সক্রিয় উপাদানের সাথে অনেক নিষ্ক্রিয় উপাদান ও যোগ করে দেয়া হয় ওষুধের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য। সেরকম ই নিষ্ক্রিয় উপাদানের সমন্বয়ে, কিন্তু Remdesivir এর সক্রিয় উপাদানকে বাদ দিয়ে ওষুধের অনুরূপ ফর্মুলা ড্রাগ বানিয়ে কন্ট্রোল গ্রুপকে দেয়া হয়।একে প্লেসিবো ইফেক্ট বলে। ) দেয়া হয়, কিন্তু আদতে সেটা Remdesivir নয়! শুধু বাহ্যিকভাবে দেখতে তারা অনুরূপ। আরেক গ্রুপ থাকে টেস্ট গ্রুপ, যাদের আসলেই Remdesivir দেয়া হচ্ছে। ফলাফলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ঃ মুখ্য ফলাফল ও গৌণ ফলাফল। মুখ্য ফলাফল এর অন্তর্ভুক্ত হল Remdesivir দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রোগী মৃত্যুবরণ করল কিনা, হাসপাতালে গেল কিনা, সুস্থ হল কিনা। গৌণ ফলাফল হল আক্রান্ত হবার দিন থেকে ২৯ দিনের মধ্যে ALT, AST, Creatinine, Glucose, Hemoglobin ইত্যাদির পরিবর্তন পরিমাপ করা। এই সব যদি ব্যাটে বলে মিলে যায়, তাহলেও এই পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হতে আশা করা যাচ্ছে ২০২৩ লেগে যাবে, অন্তত ওয়েবসাইট তাই বলছে।

আরেকটি এন্টিভাইরাল ওষুধ যা ধাপ ২ উত্তীর্ণ হয়েছে, তার নাম Deferoxamine।এটিও আগেরটির মতই ডাবল ব্লাইন্ডেড ট্রিট্মেন্ট। এ ওষুধের মূল উপাদান হল ডেসফেরাল, যা মূলত শরীরের লৌহ উপাদানকে আটকে ফেলে, যাকে আমরা বলি chelate করে ফেলা। ৩ থেকে ৯৯ বছর বয়সী কোভিড ১৯ পজিটিভ রোগীদের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হচ্ছে, অবশ্যই তাদের অনুমতি সাপেক্ষে। এটিও আগেরটির মতই রক্তবাহী শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে দেয়া হয়। এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হবার সম্ভাব্য সময় ২০২১ এর মার্চ! বেশ দেরি।

যেহেতু এখনো কিছুই নিশ্চিতভাবে আবিষ্কৃত হয়নি, ততদিন পর্যন্ত লকডাউনে বসে আসুন নিজেরা বাঁচি , পৃথিবীটাকে বাঁচাই ! আর যদি দক্ষিন কোরিয়ার মতই এত কড়াকড়ি লকডাউনে থাকতে না চান, তবে তাদের মতই aggressive testing method এ যেতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা আর কার্যকরী পদক্ষেপ, সাথে অবশ্যই জনগণের চেষ্টাই নির্ধারণ করবে মৃত্যুর মিছিলে আরো কত প্রাণ ঝরে যাবে, নাকি আবারও প্রাণের বাংলাদেশ দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে হাসবে আগের মত হাজারো মুখরিত প্রাণ বুকে ধরে। সেই সুদিন আসুক শিগগির ই!

 

তথ্যসূত্রঃ

১।  COVID-19 Dashboard by the Center for Systems Science and Engineering (CSSE) at Johns Hopkins University. (Last updated: April 17, 2020 5.38 p.m). Retrieved from  https://www.arcgis.com/apps/opsdashboard/index.html#/bda7594740fd40299423467b48e9ecf6

২। Vox. (April 1, 2020). “Coronavirus is not the flu. It’s worse”. Retrieved from https://www.youtube.com/watch?v=FVIGhz3uwuQ&t=14s

৩। Vox. (April 10, 2020). “The big lesson from South Korea’s coronavirus response”. Retrieved from https://www.youtube.com/watch?v=BE-cA4UK07c&t=6s

৪। National Institute of Allergy and Infectious Diseases (NIAID). (April 13, 2020). “Safety and Immunogenicity Study of 2019-nCoV Vaccine (mRNA-1273) for Prophylaxis SARS CoV-2 Infection (COVID-19)”. NIH. Retrieved from https://clinicaltrials.gov/ct2/show/NCT04283461

৫। National Institute of Allergy and Infectious Diseases (NIAID). (April 6, 2020). “Adaptive COVID-19 Treatment Trial (ACTT)”. NIH. Retrieved from https://clinicaltrials.gov/ct2/show/NCT04280705

৬। Dr. Yadollah Shakiba, Kermanshah University of Medical Science. (April 6, 2020). “Application of Desferal to Treat COVID-19”. NIH. Retrieved from https://clinicaltrials.gov/ct2/show/NCT04333550?cond=COVID-19&draw=2&rank=1