পোকা মাকড়ের ভোটাধিকার

ছবিতে বিভিন্ন রঙের ফুল দেখানো হয়েছে। ছবিটি Kaniz Khan আপা কতৃক ধারনকৃত।

ছবিতে বিভিন্ন রঙের ফুল দেখানো হয়েছে। ছবিটি Kaniz Khan কর্তৃক  ধারনকৃত।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিকাল প্রায় ৫ টা কোন অবস্থাতেই সময় কাটছিল না ভাবলাম যেহেতু কাছাকাছি আছি একটু বোটানিক্যাল গার্ডেনে পায়চারি করে আসি। যথারীতি পায়ে হেটে যাত্রা শুরু করলাম ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের সামনে যেতেই কয়েকজন পথ শিশুর খেলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম ওরা মার্বেল খেলছে সাথে পাশের দুটি বালক “খোকার প্রশ্ন” কবিতাটি আবৃত্তি করছে। মনোযোগ দিয়ে কবিতাটির আবৃত্তি শুনে আমি আপ্লুত কারণ এইসব পথ শিশুদের যেমনি নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ঠিক তেমনি নেই পুষ্টিকর খাদ্য,বস্ত্র ও বাসস্থান তবু এদের কণ্ঠে আবৃত্তির ধরন আমায় মুগ্ধ করেছে। পুনরায় আবৃত্তি করার অনুরোধ জানিয়ে পাশের দোকান থেকে ক’টি চকোলেট ও ২লিটার মিরিন্ডা উপহার দিয়ে আমি চলে গেলাম।

আচ্ছা মাগো বল দেখি,
রাত্রি কেন কালো।
সূর্যি মামা কোথায়
থেকে,
পেলেন এমন আলো।
ফুলগুলি সব নানান
রঙের,
কেমন করে হয়।
পাতাগুলি সবুজ কেন,
ফুলের মত নয়।
চিনি কেন মিষ্টি এত,
তেঁতুল কেন টক।……

ধীর গতিতে হাঁটছি এমন সময় দেখা হল বোটানিক্যাল গার্ডেনের মালী রফিক ভাই এর সাথে সে আমাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্যার কেমন আছেন কিন্তু তাকে বেশী পাত্তা দিতে পারলাম না কারণ কানে শুধুই কবিতার দু’টো চরণ বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।

ফুলগুলি সব নানান রঙের, কেমন করে হয়।
পাতাগুলি সবুজ কেন,ফুলের মত নয়।

ফুল কেন বা কিভাবে রঙিন হয়? গোলাপ কেন লাল ও ভায়োলেট ব্লু হয়? আমরা ফুলের রঙে রূপে পরমানন্দ লাভ করি। কিন্তু প্রকৃতির এই রূপ রঙের পিছনে যে বৈজ্ঞানিক কারণগুলি রয়েছে তা সকলের জন্য উন্মোচন করতে চাই। এখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি তা হল যে কারণে ফুল রঙিন হয় ঠিক সেই একই কারণে একজন মানুষও বাদামী বা কুঁকড়ানো চুল নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে অথবা চোখের রঙ বদলিয়ে ব্লু করেন, রঙিন পোশাক পরিধান করেন কখনো ঠোঁটে লাল লিপস্টিক পরিধান করেন।

ফুলের রঙ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যেমন দেখা যায় গোলাপের রঙ লাল এবং গাদার রঙ হলুদ হয়ে থাকে। সবই এক ধরনের pigment থেকে পাওয়া যায় যা নির্ধারণ করে উদ্ভিদের বংশগতিয় জিনোম। ফুলের রঙ লাল,গোলাপি,পিঙ্ক, নীল বা পার্পল যাই হোক না কেন এর জন্য প্রধান ভূমিকা পালনকারী পিগমেন্টের নাম হল anthocyanin যা এক প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য যাকে flavanoids বলা হয়। এই ফ্লাভোনয়েডস এর জন্যই এত রঙ এতো ভালোলাগা এতো ভালোবাসা এতো বাহারি ফুলের আগমন ঘটে।

উদ্ভিদে আরও কিছু পিগমেন্ট আছে যেমন carotenoids যাদেরকে টমাটো ও গাজরে পাওয়া যায় যা প্লাস্টিডে হলুদ,লাল ও কমলা রঙ তৈরি করে। ক্লোরোফিল খুবই পরিচিত এক প্রকার পিগমেন্ট যা সব ধরনের বৃক্ষ পত্রাবলীর সবুজ রঙ সরবরাহ করে। এই সব বৈজ্ঞানিক পরিভাষা গুলি মানুষের সাথেও সম্পর্কিত। উদ্ভিদ তাদের জিনে এইসব উল্লেখিত পিগমেন্টগুলি বহন করে যা জন্মের আগেই নির্ধারিত হয় ফুল কি ধরনের রঙ নিয়ে জন্ম লাভ করবে। যেমন একজন মানব শিশু কি রঙের চুল,চোখ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নিবে তাও জন্মের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায় তার পূর্ব পুরুষের জিনে বহন কৃত জিনোমের বৈশিষ্ট্যাবলীর উপর। এখানে উদ্ভিদ বা প্রাণী যাই হোক না কেন জেনিটিক কোড বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

পাখি,বিভিন্ন রকমের পোকা মাকড় ও মৌমাছি এই সকল উজ্জ্বল রঙের মোহে আকৃষ্ট হয় এটা সকলেরই জানা তবু এই প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে কিছুটা তুলে ধরতেই হচ্ছে। মানুষ পরস্পরকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন রকমের সাজগোজ করে যেমন কোট,টাই পরিধান করে লিপস্টিক ব্যবহার করে ঠোঁটের রঙ পরিবর্তন করে,বিভিন্ন রকমের সুগন্ধি ব্যবহার করে,চুলের স্টাইলে পরিবর্তন আনে যেন দেখা মাত্রই প্রিয়জন দের পরস্পরকে পছন্দ হয় ঠিক তেমনি উদ্ভিদ তার জিনোমে সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্যাবলী দিয়ে চাকচিক্যময় বাহারি ফুল ফুটিয়ে ও বিভিন্ন রকম সুগন্ধ ছড়িয়ে বিভিন্ন প্রকার পাখি, পোকামাকড় ও মৌমাছিদের আকৃষ্ট করে যেন পলিনেটর হিসেবে এরা এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটায়।

পরাগায়নের পর আমরা যা পাই ফুল ফল খাদ্য শস্য সবকিছুই আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রধান নিয়ামক। ফুল ছাড়া কি আমাদের একদিনও চলে? বিয়ে, জন্মদিন, প্রথম দেখা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, মৃত্যু কোথায় নেই ফুলের ব্যবহার! আর এই সবকিছুই হয় পোকামাকড়ের ভোটাধিকার প্রয়োগের ফলে। পোকামাকড় ভোটাধিকার প্রয়োগ না করলে পলিনেশন থমকে যাবে, থমকে যাবে আমাদের সভ্যতা। এখন মধুমাস চলছে বিভিন্ন রকমের মৌসুমি ফলের মিষ্টি সুগন্ধ বাতাস ভারি করে তুলছে, এমন সময় কাউকেই খোঁজে পাওয়া যাবে না যে এইসব ফলে রসনা তৃপ্ত করেনি। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবেছি এ সবকিছুই পোকামাকড়ের ভোটাধিকার প্রয়োগের ফসল। পরিশেষে বলা যেতে পারে আমরা বেঁচে আছি পাখি, পোকামাকড় ও মৌমাছি এদের দয়ায়।