বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে একদিন…
বছর শুরু হয়ে তিন মাস পার হয়ে গেল। কিন্তু ক্লাবের সবাই মিলে একটা ফিল্ড ট্রিপ এ যাওয়ার ফুরসত আর মিলছিলনা। ঢাকার ভেতর রমনা পার্কে আধাবেলার জন্য একটা নেচার ওয়াক হয়েছে ঠিকই কিন্তু দূরে কোথাও সারা দিনের জন্য একটা ফিল্ড ট্রিপ বা নেচার ওয়াকের জন্য সবাই সুযোগ খুঁজছিল। অবশেষে গত ৪ এপ্রিল ২০১৪ সে মাহেন্দ্রক্ষন এলো। বিপ্লব স্যার দুই মাস ধরেই আশ্বাস দিচ্ছিলেন; যাক তার বাস্তবায়ন এবার হলো। এবার তাহলে যাওয়া হবে গাজ়ীপুর, বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে।
আমরা ৫০ জন ক্লাবের সদস্য তৈরি ছিলাম, সাথে সালমান ভাই, দিপ্র ভাই, বিপ্লব স্যার আর ডন স্যার। চার তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় কলেজে আমাদের রিপোর্টিং ছিলো। আট-টার দিকে বাস ছাড়বে। কিন্তু কারো বদনজরও যেন আমদের যাত্রায় সঙ্গি হয়েছিলো। সিনেমার ভিলেনের মতো সেদিন আমাদের পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ৩ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটা হতে ৪ তারিখ সকাল ঠিক সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অবিরাম বর্ষন হলো। ভাগ্যিস সালমান ভাই রাতের বেলা সাবধান করে দেন, ফেবুতে তাই সবাইকে প্রস্তুতি নিয়ে আসার জন্য জানিয়ে দেই।
“যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে……”-দেখা হলো সবার সাথে সকল বাধা পেরিয়ে, ঠিক আট-টায়; কলেজে। রওনা দিলাম আমরা গাজিপুরের উদ্দেশ্যে। বাসে আমরা ৫০ জ়ন। ফার্মগেট-বনানী হয়ে বাস সাভারের রাস্তা ধরলো। দশটার দিকে আমরা পৌছলাম বহুল প্রতিক্ষিত গন্তব্যস্থলে। দুরত্ব আর দীর্ঘ সময় কোনটাই পাত্তা পায়নি বন্ধুদের ভিড়ে।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে সবাই অবাক হয় এর বিশালত্তা দেখে। ৪০০০ একর; পড়ে গিয়েছিলাম, এবার বিশ্বাস হল। শুরুতে চোখে পড়ল নয়নাভিরাম বাগান, কিছু প্রাণির মুর্তি (দেখে বাস্তব মনে হয়েছিল)।ঐরাবতি আর ময়ুরী-দুটি রেস্ট হাউস ছিল। কতৃপক্ষকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের ময়ুরী রেস্ট হাউস এ থাকতে দেয়ার জন্য। পুলকিত হই রেস্ট হাউসের সাজসজ্জা, আধুনিকতায়।কর্তৃপক্ষকে অশেষ ধন্যবাদ আমাদের চা দ্বারা আপ্যায়ন করার জন্য।
এক ঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার পর আমরা পার্ক পরিদর্শনে বের হই। প্রথমে আমরা সাফারি কিংডম এ যাই। এর পাশেই মূল সাফারি পার্ক অবস্থিত। সাফারি কিংডম এ আমরা সর্বপ্রথম এবং জীবনের প্রথম অসম্ভব সুন্দর ম্যাকাও পাখি এর সম্মুখীন হই। বড় খাচায় বন্দী নীল হলুদ রঙ এর ব্লু-ইয়েলো ম্যাকাও, গ্রীন উইংগড ম্যাকাও, স্কারলেট ম্যাকাও, গ্রে প্যারোট আরো বিরল প্রজাতির হরেক রকম পাখিদের ঘিরে ছিলো উৎসুক জনতার ভিড়।
এর পর আমরা মৎস্য একুরিয়ামে দিক পরিবর্তন করি। আবার চমকিত হই পিরানহা সহ অদ্ভুত কিছিমের মাছ দেখে। একে একে আমরা কুমির, মদনটাক, ঈগল, সাদা ময়ুর, নীল ময়ুর, ধনেশ, রাজ ধনেশ, কলমি, ফ্লামিংগো, উট পাখি, এমু, আলপাকা, ঘোটক, শকুন, গিরগিটি, অজগর, ক্যাঙ্গারু, বানর সাদা রাজহাস, কালো রাজহাস সহ আরও অনেক প্রাণিদের সাথে দেখা করি। দুইটার দিকে আবার বিশ্রামাগারে ফিরে আসা হয়।
আবার একটূ বিশ্রাম। এরপর ভুরিভোজ। আড়াইটার দিকে আমরা যাই টাইগার রেস্টুরেন্টে। যেখান থেকে বাঘ মামা কে একদম কাছ থেকে দেখা যায়। কাচ দিয়ে ঘেরা রেস্টুরেন্ট। আমদের খাবার দিয়ে দেয়া হল, সবাই ব্যস্ত; আর অমনি বাঘ মামা কাচ ঘেশে আমাদের কাছ দিয়ে গেলেন। পেটের ক্ষুধা ভুলে গিয়ে সবাই বাঘ মামার সাথে মুলাকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিপ্লব স্যার এর ভাষায়, “এত দিন আমরা টিভিতে দেখেছি বাঘ কিভাবে খায়, আর এবার বাঘ দেখে গেল আমরা কিভাবে খাই।” আরেকটি রেস্টুরেন্ট-ও ছিলো, লায়ন রেস্টুরেন্ট-যেখান হতে সিংহ মামাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। যাই হোক কর্তৃপক্ষকে আরেকবার ধন্যবাদ এত চমৎকার খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য।
মোরগ পোলাও দিয়ে ভুরিভোজ শেষে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি গ্রুপ ছবি তোলায়। বন্ধুত্ব আর ভ্রাতৃত্ব এর প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমরা ঐতিহ্যবাহী “ওওওওও……উই” রবে আত্মহারা হই। আমাদের সাথে সালমান ভাই, দিপ্র ভাই শরীক হন।
আর দেরি না করে আমরা সাফারি পার্ক এর উদ্দেশ্যে এবার রওনা দেই। কাঙ্খিত বাসের জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। সবুরে মেওয়া ফলে-তাই সবুর করলাম। কাঙ্খিত বাস আসার পর হুড়মুড় শুরু হয়ে যায়। বাস ৪০ সিটের ছিলো। তাই অনেককে দাড়িয়ে যেতে হয়। যাই হোক শুরু হলো আমাদের যাত্রা সাফারী পার্কে। শুরতে দেখা হলো সেই বাঘ মামা আর তার সঙ্গী সাথীর সাথে। মাইক দিয়ে গাইড আমাদের জানাচ্ছিলেন কোথায়, কোন পাশে কি আছে। এরপর পশুরাজ সিংহ। তার সহধর্মিণী আমাদের বাসের কাছে এসে সাক্ষাত করল। এরপর মায়া হরিণ আর চিত্রা হরিণ এর দেশে পারি দিলাম। জেব্রা আর জিরাফ এর সাথেও দেখা হলো। বিরাট এলাকা জুড়ে তাদের রাখা হয়েছে। সঙ্গী সাথীর অভাবও রাখা হয় নাই। প্রত্যেককে সিমেন্টের দেয়াল-বেষ্টনী দ্বারা আলাদা আলাদা ভাবে রাখা হয়েছে যাতে অযথা বিদ্রোহ সৃষ্টি না হয়ে যায়।
বাসচালকের প্রতিভায় ৪০ মিনিটের পথ ২০ মিনিটে ঘুরে এলাম। এরপর আর দেরি নয়। সবাই আমাদের নিজস্ব বাসে উঠে পরলাম। কলেজে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত সবাই রক আর অপেরা সংগীতে নিজেদের মুখরিত আর সেই সাথে বাহিরের মানুষদের করে রাখলাম জর্জরিত । সাড়ে আটটাইয় আমরা কলেজে এসে পৌছাই। এরপর বাড়ি ফেরার পথে খালি মনে পড়তেছিলো রবি ঠাকুরের সেই পংক্তি,
“ ………শেষ হয়েও হলোনা শেষ”
ইশ! যদি বাসচালক তখন আরেকটু আস্তে চালাতো……………
লিখেছেন- মহিদুল ইসলাম হৃদয়, প্রেসিডেন্ট (এডমিন), নটরডেম নেচার স্টাডি ক্লাব।
ছবি তুলেছেন- আনান সালমান।