ব্রোকেন বোন ট্রি- মধ্যরাতের হরর

চারিদিকে ঝলমলে জ্যোৎস্না চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে আর ঝির ঝিরে হালকা বাতাস পড়ার টেবিলে একটুও মন নেই কিন্তু ক’দিন পরেই প্রিটেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। টেবিলে বসে আছি মৃদু হারিকেনের আলোতে, একটা ছায়া দেখতে পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন! চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলেন Full free Studentship application কি শেখা হয়েছে? আমি খুব কষ্টে উত্তরে জানালাম জি বাবা হয়েছে। লিখে দেখানোর আদেশ হল পাশে বাবা বসে আছেন আমি লিখছি কিন্তু পরীক্ষক বাবা এতক্ষণে বুঝে গেছেন আমার ঠিকমত শেখা হয়নি। তিনি বলতে লাগলেন এই ছলু..ছলু..কই গেলি আমাকে একটা ছিটকি (বাঁশের কঞ্চি) দিয়ে যা এর মধ্যেই আমাদের অতি বিশ্বস্ত কাজের ছেলে ছলু ছিটকি নিয়ে হাজির, বাবা প্রথম শুরু করলেন যদি পড়াশোনা ঠিকমত না করো তাহলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও তারপর……!! যাই হোক এক পর্যায়ে তিনি থামলেন।

আমি পুনরায় মনোনিবেশ করলাম কিন্তু একটা কথা আমার মনে খুবই দাগ কেটেছিল “পড়াশোনা না করলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও” বার বার মনের সাথে যুদ্ধ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে বাড়ি থকে বের হয়ে যাওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ কেননা এখানে দু’টো রসায়ন কাজ করছিলো আগের দিন বিকালে আমার গোলাপ গাছের পরিচর্যা দেখে বাবা বলছিলেন পরীক্ষার আগে তোমাকে আমি আর এসব কাজে একবারের জন্যও দেখতে চাইনা আর আজ যোগ হল ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশীপ। নিঝুম রাত, ১০টা বাজে একা একা বের হয়ে গেলাম জ্যোৎস্নার আলোতে আমার গোলাপ গাছের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম আমাকে সুগন্ধ ছড়িয়ে ফুলগুলো বিদায় দিচ্ছিল তখন কি যে ভালো লাগছিলো তা এখানে ফুটিয়ে তোলা যদিও সহজ কাজ নয় তবে যে ছেলে সন্ধ্যার পর মায়ের আঁচল ধরে ঘরের বাইরে যায় সেই ছেলে বীরের বেশে একা একা নিঝুম রাতে বাড়ি পালাচ্ছে!! আজো ভাবলে আমার গায়ে শিহরণ লাগে আমি এই কাজ করতে পেরেছিলাম?

বাড়ি থেকে আনুমানিক ১মাইল (তখনো কিমি এর হিসাব আসেনি) যেতেই জ্যোৎস্নার আলো আধারিতে Oroxylum indicum গাছের মাথায় বিশালাকার সিমের মত ফল গুলিকে ঝুলতে দেখে মনে হচ্ছিলো ছোট বাচ্চাকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে সত্যি মিডনাইট হরর!! আমি ভয় কাটানোর জন্য গান ধরলাম, আমার হাওয়ার গাড়ি চইল্যা গেলো রে বন্ধু আইলো না….। গানে কি আর ভয় কাটে একটু এগোতেই শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ, ও মা গো বলে চিৎকার দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করলাম কাছাকাছি এসেই ভাবলাম তাহলে আমি কি হেরে যাচ্ছি? না তা হতে দেয়া যায় না। বাড়ির গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিলাম। মায়ের কান্না শুনতে পাচ্ছি আর বাবার কণ্ঠ “আসলে এভাবে বকা দেয়া ঠিক হয়নি” আহা আমার পালিয়ে যাওয়া সার্থক। কিন্তু গোয়াল ঘরের ধোঁয়ায় কতক্ষণ থাকা যায় চলে গেলাম পাশের বাড়িতে একটা পানের বরজে সারারাত কাটিয়ে মশার কামড়ে অস্থির হয়ে তাদের বৈঠক ঘরে খড়ের পালার উপর মহাসুখে নিদ্রায় মগ্ন, এর মধ্যেই আমাদের বিশ্বস্ত কাজের ছেলে ছলু আমাকে আবিষ্কার করে বাড়ি নিয়ে গেলো ও সে আমাকে অশ্বস্ত করলো বাবা কিছু বলবে না। ঘটনা এখানেই শেষ নয় বাড়ির আশে পাশের সহপাঠীরা পরদিন সকালে আমাকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করলো–কেউ বলছে হারিয়ে যাওয়া মুরগি, আবার কেউ বলছে পক্ষী খাঁচায় ফিরেছে ইত্যাদি। আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন কারণ Oroxylum indicum এর সাথে আমার এই বাস্তব স্মৃতি টুকু আপনাদের শেয়ার না করে পারছিলাম না।

এই গাছকে অঞ্চলভেদে বান্দর গাছ বলে এর ফল ঝুলে থাকলে বান্দরের মতই দেখায়। এছাড়াও একে মধ্যরাতের হরর বলা হয়। বাংলায় এটি সোনা গাছ ও কানাই ডিঙ্গা নামে পরিচিত তবে এর নাম কেন সোনা হল তার সঠিক কারণ আমার জানা নেই। একে ইংরেজিতে ব্রোকেন বোন ট্রি বলা হয় কেননা এর ফল পেকে যদি গাছের নিচে পড়ে তাহলে মনে হয় যেন কোন প্রাণীর হাড় ভেঙ্গে পড়ে আছে। এদের ফুলের আকারের উপর নির্ভর করে একে ইন্ডিয়ান ট্রুপমেট ফুল বলা হয়। যে ভাবেই এর নামকরণ করা হোক না কেন এই উদ্ভিদের ফল নিয়ে একটা মিথ আছে। কখনই এই বিশালাকার ফল বাড়িতে আনতে দেয়া হতো না কারণ হল এই ফল যার বাড়িতে যাবে সেখানেই কোন না কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি হবে। এই অপবাদে ঔষধি গুন সম্পন্ন এই উপকারী তরুটি আমাদের দেশ থেকে একেবারেই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আজকাল গ্রামাঞ্চলে গেলে এই বৃক্ষকে দেখাই যায় না, অনেককে জিজ্ঞেস করলে এই ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনা।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস এর উদ্ভিদতাত্বিক নামকরণ করেন Oroxylum indicum, এই উদ্ভিদে প্রাপ্ত ক্যামিকেল baicalein-7-O-diglucoside (Oroxylin B) এর উপর ভিত্তি করে এর গনের নামকরণ করা হয়েছে Oroxylum. এই প্রজাতিটি যেহেতু এই উপমহাদেশের ইন্ডিয়াতে বেশি দেখা যায় তাই এর স্পেসিসের নামকরণ করা হয়েছে indicum. এটি Bignoniaceae (Jacaranda family) পরিবার ভুক্ত পেরিনিয়াল পর্ণমোচী তরু যার আদি বাসস্থান আমাদের এই উপমহাদেশ। এটি ৮-১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, যা Bignonia indica ও Calosanthes indica সমনামেও অনেকের কাছে পরিচিত।

Oroxylum indicum এর বীজ ট্র্যাডিশনাল ইন্ডিয়ান আয়ুর্বেদিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূল ও বাকল এর রস বহু বছর ধরে বিখ্যাত টনিক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এর বাকল থেকে তৈরি ঔষধ রিউমেটয়েড আথ্রাইটিজের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এই উদ্ভিদে প্রাপ্ত উপক্ষারে এন্টি ক্যান্সার প্রপার্টিজ আছে বলে অনেকের ধারনা।

আশ্চর্যজনক বাহ্যিক চেহারার কারণে এই গাছকে ornamental উদ্ভিদ বলা হয়। লম্বা ফল মগডালে নিচের দিকে ঝুলে থাকে যাকে অনেকে সৌন্দর্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ রাতে এর ফল গুলি দেখতে ঝুলন্ত কাস্তে বা তলোয়ারের মত মনে হয়। এই উদ্ভিদের একমাত্র পলিনেটর হল বাদুড় কিন্তু এদের খাদ্যের অভাব ও বনাঞ্চলের কারণে বাসস্থান স্বল্পতা হেতু আজ বাদুড়ের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে ফলশ্রুতিতে যে কয়টি সোনা গাছ ছিল এদের ঠিকমত পরাগায়নের অভাবে আজ এই উদ্ভিদ এনডেঞ্জার প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।

ছবি: গুগোলের সৌজন্যে।