হরেক রকম কচু

Elephant Ear Taro

ফুল সহ কচু গাছ

বেটাকে এমন কচু দিয়েছি টের পাবে আজ। পাঠক একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন তাইনা? ধরুন আপনি একটি কাজ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন কিন্তু যথাসময়ে কাজটি না করে যিনি আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার সামনে উপস্থিত হলে প্রথমেই যা শুনতে হয় “কাজটি করেননি কেন?” “তাহলে কি কচু করেছেন”। আমার এক প্রয়াত শিক্ষক(সর্বজন শ্রদ্বেয়) ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিতে পারলে বৃদ্বাংগুলি দেখিয়ে বলতেন বাসায় কি কচু করেছো। আর উত্তর ভুল হলে আরো রেগে যেতেন তখন তিনি ৩ বার বলতেন কচু শিখেছো,কচু শিখেছো এবং কচু শিখেছো। সুধী পাঠক যদি কাউকে বলা হয় “বেটা তুই একটা কচু”। একটু ভেবে দেখুন অবস্থা কি হবে(!) থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াতে পারে। কথায় কথায় কচু শব্দটি অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ব্যবহার করা হয়। এই কচুর এত গুনাগুন তারপরেও কেন কচু শব্দটিকে ব্যাঙ্গাত্বক ভাবে ব্যবহার করা হয় আমার জানা নেই। কচু দিয়ে ইলিশ রান্না করলে আপনি আমি খুশি হয়ে যাই কিন্তু যখনই কচু শব্দটি আপনাকে আমাকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করা হয় তখন আমরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠি। কারন হিসেবে এর ব্যখ্যা আমার জানা নেই। তবে কবি গুরু কচুকে বিশেষ সম্মান দিয়ে কবিতা রচনা করতে ভুল করেননি।

Elephant Ear Taro1

মান কচু

“অধিকার বেশি কার বনের উপর
সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর।
বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল,
গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল।
পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া,
বর্ণে আমি দিগ্‌বিদিক রেখেছি কাড়িয়া।
গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব,
গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব।
কচু কহে,গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে,
হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে।
মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর,
প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।”

সুধী পাঠক “বাংলার আগাছা পরিচিতি” নামক বইতেও কচুকে তুচ্ছ করে আগাছা হিসেবে দেখানো হয়েছে। যা হোক রাস্তায় এই তুচ্ছ মানকচুর(কোন কোন এলাকায় ফেনকচু বলে) সাথে দেখা তাকে নিয়ে লিখবো কিন্তু তার আগে বাংলাদেশে কি কি প্রকারের কচু পাওয়া যায় একটু দেখে নেই।
বাংলাদেশে অনেক রকমের কচু পাওয়া যায় যেমন –

১.বন কচু।
২.বিষ কচু।
৩.কাঁটা কচু।
৪.মুখী কচু।
৫.শোলা কচু।
৬.ওল কচু।
৭.মান কচু।
৮.মোকাদ্দম কচু।
৯. সাল কচু।
১০. দুধ কচু।
১১. ঘেঁটু কচু।
১২. রক্ত কচু।
১৩. পঞ্চমুখী কচু
১৪. মৌলবী কচু।
১৫.গাঢ় কচু ও
১৬.ছাতি কচু ইত্যাদি।
মান কচু বহুবর্ষজীবি সপুস্পক একবীজপত্রি উদ্ভিদ। ইংরেজীতে একে Giant Taro বা Elephant Ear Taro বলা হয়। এর গুনগত মান অন্য কচুর চেয়ে ভাল এতে গলা চুলকানোর পরিমান অন্য কচুর তুলনায় কম খেতেও স্বুস্বাদু তাই হয়ত একে মান কচু নামকরন করা হয়। এর পাতার আকৃতির কারনে একে ইংরেজীতে হাতির কান নামকরন করা হয়েছে। বর্ষাকালে এই কচুর পাতা গ্রামাঞ্চলে ছাতি হিসেবে ব্যবহ্নত হতো বিধায় কোন কোন অঞ্চলে একে ছাতি কচু বলে। মানকচুর ডাটা অনেক মোটা হয় যা কেটে নিলে ফেনার মত লেটেক্স বের হয় আর এ কারনেই অনেকে একে ফেন কচু বলেন। সাধারণত কচু গাছ হয় বাড়ির আশে পাশে, রাস্তার ধারে, স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় বেশীর ভাগই লাগাতে হয় না এমনিতেই জন্মে। আমাদের দেশে শাক হিসাবে কচুর প্রচলন বহু আগে থেকে। মানকচু আমাদের দেশে চাষ করা হয়। সুইডিস উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস এই কচুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি তিনি অতী যত্নে এর শ্রেনিবিন্যাস করেছেন ও দ্বিপদ নামকরন করেছেন।
Family:Araceae
Genus:Alocasia
Species:A. macrorrhizos
Botanical name: Alocasia macrorrhizos L
আমরা সকলেই জানি কচুতে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ আছে। কচু খেলে শরীরে রক্ত হয়। প্রেগনেন্ট মহিলাদেরকে কচুশাক খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয় কারন কচুশাক থেকে প্রাপ্ত আয়রন Fetus এর cognitive functions কে উন্নীত করনে সাহায্য করে।
কচু শাক সব মৌসুমেই পাওয়া যায়। শরীরে রস বাত হলে,রাতকানা ও Stomatitis এ কচু শাক খুবই উপকারী। কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে “ভিটামিন এ” থাকায় রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত উপকারী। কচু আঁশ জাতীয় হওয়ায় এটি কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে।কচুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম যা আমাদের হাড় শক্ত করতে সহায়তা করে।চুলের ভঙ্গুরতা বন্ধেও কচুর উপকারিতা অনেক।কচুতে আয়োডিনের পরিমাণও অনেক।যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি রয়েছে তাদের জন্য কচু অনেক উপকারী।কচুর লতিতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরাও নিশ্চিন্তে খেতে পারেন এটি।
কচুর এত গুণাগুণ। সুধী পাঠক আসুন আমরা একত্রে বলি

বেশী করে কচু খাও
যদি আয়রনের ঘাটতি মেটাতে চাও।
ভিটামিন “এ” এর ঘাটতি হলে
কচুশাক খাবারের ম্যানুতে রাখলেই চলে।

পরিশেষে একটি গল্প বলে শেষ করছি। আমি তখন দশম শ্রেনীর ছাত্র। আমার বাবার বন্ধু আঃ জব্বার স্যার Jonathan Swift এর লেখা Gulliver’s Travels পড়াতেন। একদিন ক্লাসে হোম ওয়ার্ক ছিলো Gulliver এর চাইল্ডহুড মুখস্ত করা। স্যার ছিলেন রাসভারী মানুষ। যথারিতি মুখস্ত পড়া ধরছেন তাও আবার স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে বলতে হয়। একে একে আমার পালা আসলো কিন্তু সমস্যা হলো আমার মুখস্ত হয়নি তাও ধুরু ধুরু বুকে স্টেজে উঠলাম বলা শুরু করলাম Gulliver the third of five sons of his parents…….। তারপর আর মনে নেই এমন সময় দেখলাম স্যার বই খুলে মিলিয়ে নিচ্ছেন আমি কি বলছি। যেহেতু আমি স্যারের চেয়ারের পাশেই দাঁড়িয়ে বলছি সুতরাং বইএর লেখাগুলো স্পস্ট দেখা যাচ্ছিলো আমিও সু্যোগের সৎ ব্যবহার করছি কিন্তু বিধি বাম। আমাদের সহপাঠী ছিলো স্যারের মেয়ে “চায়না”। হঠাৎ সে বলে দিলো আজহার দেখে বলছে। ঠিক তখনই স্যার বই বন্ধ করে বললেন আবার বলো প্রথম থেকে আমি শুরু করলাম Gulliver the third of five sons of his parents…….। যথারিতি আর পারছিনা। স্যার রেগে অগ্নিময় হয়ে বললেন গতকাল বাড়িতে কি কচু করেছো? আমি চুপ। আশে পাশে বেত লাঠি কিছুই নেই দপ্তরী নবীহুসেন ভাইকে ডাকা হলো সেও কিছুই না পেয়ে মান কচুর ডাটা নিয়ে এলো স্যার তাই দিয়ে শুরু করলেন সুধী পাঠক ব্যথা তেমন পাইনি কিন্তু ঘন্টা খানিক পরে টের পেয়েছিলাম যেহেতু কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে।
টীকাঃ
Taro–Araceae পরিবারভুক্ত উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি কে Taro বলা হয়। এটি হলো সাধারন নাম।
Fetus–বাচ্চা মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাকে Fetus বলে।
Cognitive Functions developments– বুদ্বি মেধা উন্নীত করন।
Stomatitis–মুখগহ্বরে প্রদাহ বা ঘা।