আমাদের শেখর……..আর নেই
এভাবে কোনদিন একটি প্রবন্ধ লেখতে হবে, আশা করিনি। কারণ, আমাকে নিয়ে যার প্রথম লেখার কথা ছিল, তাকে নিয়েই আমাকে লিখতে হচ্ছে। এটিই বিধির বিধান, প্রকৃতির নিয়ম, নয়তির লিখন – এ অনন্ত চরাচরে, স্বর্গ-মর্ত ছেয়ে, সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন; যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। আসলে, আমাদের হাতে কিছুই নেই, যেটুকু আছে আমরা চেষ্টা করতে পারি মাত্র।
যাই হোক, আমাদের শেখরকে নিয়ে লিখতে বসে ভেবে পাচ্ছি না, কোনটি লিখবো বা কোনটি বাদ দিয়ে কোনটি লিখবো। ঠিকভাবে সবকথা লিখতে গেলে একটি স্বতন্ত্র বই লেখা হয়ে যাবে; আমরা হয়তো তা করবো ভবিষ্যতে, তবে তার আগে তার অপ্রকাশিত লেখাগুলো আমরা প্রকাশ করতে চাই। শেখর নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকৃতি বিষয়ক কলাম লিখতো, এবং আমাদের সকলের গুরু এবং এ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক দ্বিজেন সর্মা স্যারের সুবাদে সে পত্রিকায় উদ্ভিদদের উপর চমৎকার আর্টিক্যাল লিখতো, আর সে নিজে প্রাণিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে প্রাণিদের উপরতো লিখতোই। পরবর্তীতে মোকাররম হোসেন ও অন্যান্যরা এ পন্থা অবলম্বন করে এখনো তা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, শেখর যেরকম নিবেদিত প্রাণ হয়ে জনমনে প্রকৃতি মনষ্কতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লিখে গেছে, তা এখন বিরল। বর্তমানে দেখা যায়, এ ধরণের কিছু লেখার পর বা টিভিতে এক-দুটো প্রোগ্রাম প্রচারের পরই এ নিয়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় লোকজন লেগে পড়ে, যা ইতিপূর্বে কোন বিখ্যাত লেখক বা গবেষকরা করতেন না – আর আমাদের শেখরও তাঁদেরই দলে, সে সকল চিন্তা ভাবনা বা ভবিষ্যত পরিকল্পনার উর্দ্ধে থেকে নিরলস ভাবে লিখে গেছে, সাধনা করে গেছে; কোন দিকে তাকানোর সুযোগ যেন তার ছিল না, সৃষ্টির নেশা সবসময় তাকে তাড়িত করতো, হয়তো সে জনতো সে বেশীদিন থাকবে না, ক্ষণজন্মারা তাই করে। আর তার মতো সৃষ্টিধর্মীরা, শুধু সৃষ্টি করে যায়, পেছনে ফিরে তাকায় না, তাকানোর সময় তাদের থাকে না; সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে তারা আত্মহারা হয়ে পড়ে – আর যারা নতূন কিছু সৃষ্টি করেছে বা সমাজকে উপহার দিয়েছে, তারাই শুধু এর মর্ম বুঝে, অন্যরা শুধু বুঝে টাকা-পয়সা ভোগ-বিলাস। এজন্য এ ধরণের লোকেরা ঘরের লোকদের কাছে খুব একটা আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্য হিসেবে গন্য হন না, তবে পরে যখন অন্যরা তাদের মূল্যায়ন করতে শুরু করে, তখন তাদের কাজে মূল্য, কাছের লোকদের কাছে প্রতিভাত হয়।
নটর ডেম নেচার ষ্টাডি ক্লাবে শেখর আসে ১৯৮৬ সালের জুলাই-আগষ্টের দিকে। সে ১৯৮৮ সনে HSC পরীক্ষর্থী ছিল বিধায় তাকে আমরা ক্লাবের রোল দেই (88N14)| পরবর্তীতে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয় এবং তার রোল হয় (88NL01) এবং এরও অনেক পরে আমরা যখন আমাদের ক্লাবের গন্ডি ছাড়িয়ে জাতিয় পর্যায়ে ১৯৯৬ সনে নেচার ষ্টাডি সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ (NSSB)Ó গঠন করি, তখন সে আমাদের সক্রীয় প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের একজন হিসেবে স্বতষ্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং তার রোল হয় (0104FD04)| উল্লেখ্য, নটর ডেম কলেজে সে বিজ্ঞান বিভাগের Group – IV-এর ছাত্র ছিল এবং তার রোল ছিল 88402|
ওদের গ্রামের বাড়ী খুলনা জেলার, পাইকগাছা থানার কটিপাড়া গ্রামে, তবে সেখানে শেখর কমই থেকেছে, আমার জানামতে সেখানে কয়েক বছর পর পর একবার যেতো। ঢাকায় ওরা থাকতো বাসাবো এলাকার আহমেদ বাগে (১৪৪/২/এফ)। তাদের পুরো পরিবারই এখানে আছে বহুদিন থেকে। তার বাবা শ্রী গঙ্গারাম রায়, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, মা শ্রীমতি মঞ্জুশ্রী রায়, গৃহবধু। তার ভাই শিশির রায়, ভারতে বিখ্যাত সত্যজিত রায় ফিল্ম ইন্ডাষ্টিতে চাকুরি করে। তার পাঁচ বোন ও তাদের স্বামীরা বিভিন্ন পেশায় দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। শেখর ব্যক্তিগত জীবনে কাজ করতো জনতা ব্যাঙ্কে, সিনিয়র এক্সিকিটিভ অফিসার হিসেবে এবং অত্যন্ত সৎ, বিশ্বাসী ও আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে সে ব্যাঙ্কটির ইন্টারন্যাল অডিট ডিপার্টমেন্ট-২-এ কর্মরত ছিল। তার অফিস ছিল ৪৮, মতিঝিল, হেড অফিসের ৯ম তলায়। প্রথমে তার পোষ্টিং ছিল সিলেটের হাবিগঞ্জ এলাকার নবিগঞ্জ থানায়। তারও আগে সে মাষ্টার্স ডিগ্রী পাশ করার পর, কয়েক দিনের জন্য নটর কলেজে জীববিদ্যা পড়ায়। এর ভিতরে ব্যাঙ্কের সরকারী চাকুরী হওয়াতে তার পরিবার তাকে সেখানেই কাজ করতে বলে। তবে, আমি জানি, কোনখানেই সে মনমতো কাজ করতে পারছিলো না। সে চাইতো স্বাধীনতা, পাখি বা প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়ানো, তাদের দূর্লভ ছবি তোলা, তাদের উপর বই বা ইন্টারনেট ঘেটে দূর্লভ তথ্য সংগ্রহ করা ও লেখা। তার এ বহু আকাঙ্খিত দূর্লভ সুযোগটি এসে গেলো যখন তাকে ব্যাঙ্কের ইন্টারন্যাল অডিট ডিপার্টমেন্টে পোষ্টিং দেয়া হলো। চাকুরির সুবাদে, সরকারী খরচে তাকে যেতে হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরফলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রাণি ও উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণ ও তাদের দূর্লভ ছবি সংগ্রহ তার নিয়মিত কাজে পরিণত হয়, তার এই সংগ্রহ বিশাল। তাই সবসময়ই তার নিত্যসঙ্গী ক্যামেরা ও বাইনোকুলারটি তার সাথে সাথেই থাকতো।
তারপরেও, আরো একটা দূর্লভ নেশা তার ছিল, তাহলো পুরানো বই-এর দোকান থেকে সস্তা দামে দূর্লভ বই সংগ্রহ করা, যা তাকে একদিন সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী করে তোলে। তার সংগ্রহের তালিকায় বিশ্ববিখ্যাত প্রকৃতিপাঠ সংক্রান্ত বই থেকে শুরু করে বিশ্বকবির জীবনী পর্যন্ত দেশী-বিদেশী বহু বই রয়েছে। নটর ডেম কলেজে পাশ করার পর, প্রায় এক বছর শেখর বিভিন্নখানে ভর্তির জন্য ঘুরে বেড়ালো আর ক্লাবে ফটোগ্রাফী ও কম্পিউটারের ট্রেনিং নিল। তবে, অন্য কোথাও সে ভর্তি হতে পারলো না, তাই আমি তাকে, রনিকে (বর্তমানে বিমানের কার্গো ম্যানেজার) ও কৃষ্ণকে (বর্তমানে সহিদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনম্যান্ট কলেজের শিক্ষক) ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেই। তখনকার চেয়ারম্যান ছিলেন, প্রফেসর নাসিম বানু আপা, তিনি আমাদের সম্পর্কে জানতেন, তাই এদের ভর্তি সহজই হয়েছিল। ছাত্র অবস্থায় শেখর চার বছর তখনকার ধানমন্ডিস্থ জাপানী ভাষা ইনিষ্টিটিউটে, মিসেস কাজুকো ভূঁইয়ার কাছে জাপানী ভাষা শিক্ষা করে, সে সুবাদে সে ভাষায় লিখিত বইও তার সংগ্রহে স্থান পেয়েছে। শেখর তার জীবনের কামাই-এর বেশ একটা বড় অংশ খরচ করেছে বই কিনে ও নেচার ফটোগ্রাফী করে, আর বেশ কিছু খরচ হয়েছে তার ব্রেইন টিউমার চিকিৎসার পেছনে – কলিকাতা, বাঙ্গালোর, পুনে, মাদ্রাজ ইত্যাদিতে যোগাযোগ ও যাওয়া বা থাকা, চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ। মৃত্যুর সময় সে তার এ অমূল্য বই-এর সংগ্রহ তার প্রিয় সোসাইটিকে দিয়ে গেছে এবং আমরা আমাদের লাইব্রেরীর নামকরণ করেছি, শেখর রায় লাইব্রেরী, এখানে তার সংগ্রহ ছাড়া আরও বহু বই রয়েছে, যার অনেকগুলোই আমি সংগ্রহ করিয়েছি তার মাধ্যমে।
শেখরের জন্ম ১৯৭০ সনের ৭ই জানুয়ারী এবং সে আমাদের ছেড়ে চলে যায় বিগত ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩, রাত ৯:৫৫ মি.। মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকে সে ইউনাইটেড হাসপাতালে এক ভারত থেকে আগত ডাক্তারের মাধ্যমে ক্যামো-থ্যারাপি দিয়ে আসছিল। শেষবার এটি দেয়া হয়, বিগত ৫ই ফেব্রুয়ারীতে, কিন্তু তার পর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাকে আই.সি.ইউ-তে নেয়া হয়। তার নিউমোনিয়া হয়েছে বলা হয়, কিন্তু এক পর্যায়ে তার ন্যাজাল ফিডিং-এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানে নলদিয়ে খাদ্য দিতে গিয়ে, তা তার ফুসফুসে চলে যায় এবং সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখানকার কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের অবহেলার কারনে, সেখান থেকে তাকে ভর্তি করা হয় মিটফোর্ড হাসপাতালের আই.সি.ইউ-তে। সেখানে আমাদেরই এক সদস্য, ৩য় বর্ষের ছাত্র অনুরাজ বিশ্বাস অভিক, তার সার্বক্ষনিক দেখাশুনা করে। মৃত্যুর আগের দিন সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠে এবং তাকে আই.সি.ইউ. থেকে, জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি কারার জন্য বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, হঠাৎ পরের দিন বিকেলে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাকে আবার মিটফোর্ডে ভর্তি করা হয়; কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, শত চেষ্টার পরেও রাত ৯:৫৫মিঃ সে আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করে (সৃষ্টিকর্তা তার আত্মাকে চিরশান্তি প্রদান করুণ)। মৃত্যুর সময় শেখর রেখে গেছে তার স্ত্রী প্রনতী রায় (এক কলেজের শিক্ষিকা) এবং সাত বছর বয়েসী একমাত্র ছেলে প্রীয়ন্তু, যে মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে।
পরের দিন ঢাকাস্থ রাজারবাগে অত্যান্ত সুচারুরূপে তার শেষকৃত্ত ও দ্বাহ্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, আমাদের ক্লাবের পরিচালক মিঃ বিপ্লব দেব সেখানে যায়। পরে, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আরো দুজন সদস্য, রুবেল (গ্রামীন ফোনের কর্মকর্তা) ও অভিক (মিটফোর্ড মেডি. কলেজের ছাত্র) উপস্থিত হয়েছিল। আমি শারিরিক ও মানষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তাই আমি যেতে সাহস করিনি; তাছাড়া বেশ কিছুদিন থেকে আমিও চেক করাচ্ছিলাম; আমারও একটা অপারেশন জরুরী হয়ে পড়েছিল। শেখরও এ বিষয়টা জানতো এবং সবসময় আমার স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাকে তাগাদা দিতো, সপ্তাহে অন্তত একবার দেখা করে যেতো এবং কোন কোন সময় ছেলেকে নিয়ে আসতো। গত তিন-চার বছর থেকে যখনই সে ফিল্ড ওয়ার্ক বা ফটোগ্রাফী করতে যেতো, তার ছেলেকে সঙ্গে নিতো। এটা খুব ভাল অভ্যাস, বাচ্চাদের ছোট থাকতে প্রকৃতি মনষ্ক করে গড়ে তুললে পরে তারা অত্যন্ত মার্জিত জীবন যাপন করে।
আমার শেখরের শেষবার দেখা হয়, নটর ডেম কলেজে। সে তার শশুরকে নিয়ে এসেছিল ইউনাইটেড হাসপাতালে ভার্তির দুসপ্তাহ আগে। ইদানিং ভারত থেকে ফেরার পর তাকে একা বাসা থেকে বেরোতে দেয়া হতো না, আর অফিসে এসে সই করতে হতো মাত্র। তাই জানুয়ারীর শেষের দিকে সে যখন বলল দেখা করতে চায়, আমি খুব খুসি হয়ে তাকে আসতে বললাম। সে তার শশুর সাহেবকে নিয়ে আসলো। আমাদের তখন বাৎসরিক ফটোগ্রাফী ট্রেনিং-এর প্রস্তুতি চলছে। তারা বসলেন, ক্লাবের কিছু খাবার ছিল, আমরা সবাই খেলাম। শেখর বলছিল, শরীরটা ইদানিং দূর্বল হয়ে পড়েছে। ভারতের ডাক্তার তাকে আর সেখানে যেতে হবেনা বলেছেন এবং একজন ডাক্তার প্রতিমাসে ঢাকাস্থ ইউনাইটেড হাসপাতালে আসেন, তার মাধ্যমে ক্যামো-থ্যারাপী দিলেই চলবে, একথাও বলেছেন। এর পরের সপ্তাতে শেখর একা একাই এলো। আমি কিছু গিফট্ আইটেম তাকে দিলাম, সে সারা জীবন ক্লাবের জন্য অনেক করেছে, সে তুলনায় তাকে তেমন কিছু দেয়া হয়নি, অবশ্য সে নিজে কিছু পাওয়ার চেয়ে কাউকে কিছু দিলেই বেশী খুসি হতো। আর তাকে খুসি হতে দেখেছি যখন সে নতুন কিছু আবিস্কার করেছে – সে কোন পাখি বা প্রজাপতিই হোক, বা কোন উদ্ভিদ বা কোন দূর্লভ বই। যাওয়ার সময় আমাদের দুই সদস্যকে সাথে দিলাম (রওনক ও জুনায়েদ) যারা তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসলো। এর মধ্যে শুনলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি মেলা হবে, ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাতে, শেখর বলল সে সেখানে যাবে, ছবি তুলবে। আমি আমাদের আরেক আজীবন সদস্য ক্যাপ্টেন কাউসার মুস্তাফা (87NL01)-কে বললাম, যাতে শেখরের দেখাশুনা করে। কাউসার তার সাথেই ছিল; সেখানে আমাদের ক্লাবেরও একটি স্টল ছিল, যেখানে তারা বেশ কিছুক্ষণ থেকে শেখরকে বাসায় পৌঁছানোর জন্য সে আগে চলে আসে। অবশ্য সেখানে ইন্টস্ট্যান্ট বাটারফ্লাই স্ন্যাপিং প্রতিযোগিতায়, কাউসার প্রথম পুরষ্কার লাভ করে, সে চলে আসাতে তার হয়ে, তা গ্রহণ করে ক্লাবের সদস্যরা।
এই হলো শেখরের সাথে শেষ দেখা। আমাদের সদস্যরা বিশেষ করে কাউসার ও রুবেল হাসপাতালে তার পারিবারের সাথে সাথেই ছিল। অভিক মিটফোর্ডে তার অনেক দেখাশুনা করেছে। এমনকি সে সেখানে আই.সি.ইউ-তে উঠে বসে হাটাহাটিও করেছে, এখবর আমি ট্রেনে বসে অভিকের কাছ থেকে পেয়েছি। আমরা খুবই খুসি ছিলাম, তার উন্নিতি দেখে। ফেব্রুয়ারীর ১২ তারিখ তাকে ছেড়েও দেয়া হলো, তার স্ত্রী তাকে বাসায় নিয়ে গেলো, অন্য হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরের দিন বিকেল থেকে রাত প্রায় ৯:৫৫মিঃ পর্যন্ত তাকে মিটফোর্ডে জেনারেল ওয়ার্ডেই বিভিন্ন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়, কারণ আই.সি.ইউ-তে জায়গা ছিল না। আমি বিভিন্ন জায়গায় ফোন করছিলাম এবং রুবেল এক হাসপাতালের আই.সি.ই্উ খালি আছে এ খবর বলল। কিন্তু ততক্ষনে আমাদের শেখর মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাকে আর ধরে রাখা গেলো না। মৃত্যুর সময় নাকি বলছিল, হলো না, আর হলো না।
আমি জানি আসলো কি হলো না। শেখরের অনেক শখ ছিল, সে অনেক বই লিখবে, তাই সে বিভিন্ন ধরণের বই কিনেছে ও জ্ঞানার্জন করেছে। তার ইচ্ছা ছিল, যা বহুবার আমাকে বলেছে, সে অনেকগুলো ফিল্ড গাইড লিখতে চায়। আমরা উদ্দ্যোগও নিয়েছিলাম, সেই ১৯৮৯ সনের পর থেকে, কিন্তু নানা বাধা, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা, সুযোগের অভাব, চাকুরী নেয়া, বদলী, অডিটে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ানো আরও নানা কতকিছু আমাদের এধরণের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছে। নটর ডেম নেচার ষ্টাডি ক্লাবের পরে বাইরে আমরা সবাই মিলে নেচার ষ্টাডি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (এন.এস.এস.বি.) প্রতিষ্ঠা ও রেজিষ্ট্রেশন করি (২০০৪); শেখর এর একজন অন্যতম পরিচালক ছিল। আমাদের অনেক আশা ছিল যে এখান থেকে আমরা শুধু পাখি নয়, বরং সব ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণিদের উপর বই ও ফিল্ড গাইড প্রকাশ করবো; এ উদ্দ্যোগ এগিয়েও চলেছে, হয়তো অতি শীঘ্রই শেখরের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশের মাধ্যমেই এর যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু শেখরের তা দেখে যাওয়া হলো না। হয়তো আমার লেখা দেখে বুঝতে পারছেন, শেখর আমাদের ক্লাব ও সোসাইটির অনেকটা জায়গা জুড়ে অবস্থান করছিল, তার অবদান অসাধারণ যা ধন্যবাদ দিলে বা প্রশংসা করলে খাটো করে দেখা হবে। সে নিজেই ছিল একটি জীবন্ত বই, ফিল্ড গাইড, পত্রিকার আর্টিকেল বা ফোটোগ্রাফ। তার তৈরী করা সদস্যরা আজো ফিল্ডওয়ার্ক করছে, তার সম্পাদিত নিসর্গ আজো প্রকাশিত হচ্ছে তার অনুজদের হাতে, তার তোলা ছবিগুলো যদি স্থান করে নেয় বিখ্যাত ফিল্ড গাইড, বই ও ইন্টারনেটে, তবেই আসলে কিছু করা হবে। এগুলোই করার ইচ্ছা ছিল তার, করতে পারেনি, হয়ে উঠেনি – সময়, সুযোগ বা সহযোগিতার অভাবে। তার চারিপাশের লোকজন সবসময়ই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে সে ভুল করছে, কিন্তু আমরা জানি যে তারা চরম ভূল করেছে, তারা তাকে বুঝতেই পারেনি – হয়তো বুঝতে চেষ্টা করেনি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, শুধু আর্থিক দিক দিয়ে একজন মানুষকে যাচাই শুধু অজ্ঞানরাই করে, এটি জ্ঞানী লোকের কাজ নয়; কারণ, আমরা কাজের মাধ্যমে বেঁচেঁ থাকি টাকার মাধ্যমে নয়।
আর দেখা হবে না। আর কেউ এভাবে এসে বলবে না, স্যার, আজকে একটা দাও মেরেছি। জানেন, এ বইটা আমি এক বছর ধরে খুঁজছি, মাত্র আজকে পেলাম, তাও কত সস্তা। তো, বেটা কোন অবস্থায়ই এর কমে দিবে না, তাও নিলাম, কি করবো, এটাতো হাতছাড়া করা যায় না। আজ আর কেউ বলবে না, এই দেখেন স্যার, এটা কি এনেছি। একটা আপনার জন্য, আর এটা আমার জন্য। এভাবে সে তার ও আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহকে শক্তিশালী করেছে। মাঝে মাঝে পুরানো ঢাকা থেকে খাবার কিনে আনতো – আমি ও ক্লাবের অন্য সদস্যরা তা খেতাম। সে খেতে খুব একটা পছন্দ করতো না তবে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতো। আর খাবে কি, সে ছিল আজীবন নিরামিশ ভোজী, দাওয়াত খেতে বললেই বলতো, আমারতো স্যার খেয়ে লাভ নাই, কারণ গিয়ে শুধু শুধু বসে থাকতে হবে, তারচেয়ে বরং আপনারাই যান। তাই অন্য সদস্যরা দুষ্টুমি করে বলতো, শেখরদা, আপনার সাথে গেলে অনেক লাভ, ডাবল খাওয়া যায়। শেখরও খুব হাসতো – উপভোগ করতো রসিকতা।
আজকে অনেক কিছুই মনে হচ্ছে, সে থাকলে হয়তো যা হতো না। ক্লাবের একটা পুর্ণঙ্গ ইতিহাস আমাকে দিয়ে লেখানোর সখ ছিল তার, বহুবার তাগদাও দিয়েছে, কিন্তু আমার সমস্য ঐ একই, সবই হয় বড় দেরীতে। আজো তাই হচ্ছে। ছাত্রসদস্যদের তৈরী করা, ক্লাবের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ফিক্সিং, প্রকাশনা ইত্যাদির খেয়াল রাখতে গিয়ে আমার তেমন কিছু লেখার সময় হয়ে উঠেনি বহুদিন। আমি খেয়ালই করিনি দেখতে দেখতে বহুদিন কেটে গেছে। আসলে অনেক কিছুই বহু আগেই করা উচিৎ ছিল, তা হয়নি – তবে যা হয়েছে, তা হয়তো কোন কালেই হয়ে উঠতো না, যদি আমি গবেষণা বা লেখালেখিতে মন দিতাম। যেমন, এই শেখর ক্লাবেই প্রথম আর্টিক্যাল লিখতে শিখেছে, ফটোগ্রাফি শিখেছে, কম্পিউটার শিখেছে তারপর পত্রিকা সম্পাদনা করতেও শিখেছে। ক্লাবে বহু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে, সেগুলোর সিলেবাস লিখতে হয়েছে, তা ছাত্রদের উপর পরীক্ষা করে পরবর্তীতে পরিমার্জনও করা হয়েছে। আজকের সুন্দর চাররঙ্গা আমাদের প্রকাশনাগুলো অতীতের অসংখ্য প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ ও চিন্তাভাবনার ফসল। তবে, এখন অনেক অল্প সময়েই বহু ছাত্র তৈরী হচ্ছে, যোগ্যতা সম্পন্ন ভাবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে, যারা প্রকৃতি ও তার সম্পদের সঠিক সদ্ব্যবহার জানে এবং অন্যদেরকে এ বিষয়ে উদ্বোদ্ধ করতেও শিখেছে। তাদের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হচ্ছে শেখর নাথ রায়।
তাইতো তার নাফোটা ফুলগুলো একটা একটা করে ফুটতে শুরু করেছে। দেশ বরেন্য অধ্যাপক দ্বিজেন সর্মা তাকে নিয়ে তিনটা আর্টিকেল লিখেছেন, যা আর কারো ক্ষেত্রে হয়নি; তদুপরি এক নাম না জানা লতাকে তিনি শেখর লতা বলেছেন, তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? উল্লেখ্য, এ লতাটি দিনাজপুর থেকে সংগ্রহ করে শেখর স্যারের বাসায় নিয়ে এসেছিল, যা এখনো তাঁর টবে শোভা পাচ্ছে। তাছাড়া, এইতো সেদিন, ৪ নভেম্বর, ২০১৩ শিশু একাডেমীতে তাকে মরনোত্তর পুরষ্কার প্রদান করা হলো – তার হয়ে তা গ্রহণ করেছে তার একমাত্র সন্তান প্রীয়ন্তু। সামনে, পত্রিকায় প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত তার লেখাগুলো যদি আলোর মুখ দেখে তা কি তার জন্য একটি কম পাওয়া হবে? তাই যারা কাজ পাগল, শুধু কাজের জন্যই কাজ করে, তাদেরকেই লোকে মনে রাখে। শেখর আমাদের মনের মণিকোঠায় তার স্থান অনেক আগেই করে নিয়েছে, যা কখনো মুছে যাবার নয়। সে আমাদের মধ্যে ছিল, সে আছে, সে থাকবে – যতদিন ক্লাব আছে বা আমরা আছি, সে ঠিক আগের মতোই আমাদের মাঝে চিরঞ্জীব হয়ে বেঁচে থাকবে। তার কাজ, তার তৈরী করা সদস্য, তার প্রকাশনাগুলোই হবে তার প্রমাণ। যদিও এধরণের গুণি লোকেরা ক্ষণজন্মা হয়ে থাকে কিন্তু তারা নীরবে নিভৃতে সমাজের যে উপকার করে যায়, সমাজ বহুদিন ধরে তার ফলাফল ভোগ করে। তার মতো সমাজ হিতৈশী লোকজনের জন্যই আজকের সমাজ টিকে আছে; তাঁদের সংখ্যা যত বেশী হয়, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ গুনী হয়ে জন্মায় না, তাকে তৈরী করতে হয়, তাকে গুনী হতে হয়। তাই, এ ক্লাবে এবং এদেশের ঘরে ঘরে শেখর রায় তৈরী হোক এ কামনা করি।
মিজানুর রহমান ভূঁইয়া
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, নটর ডেম নেচার ষ্টাডি ক্লাব
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নেচার ষ্টাডি সোসাইটি অব্ বাংলাদেশ