পাউবোর ‘গণ গাছহত্যা’


24 April, 2016

সোহেল হাফিজ, বরগুনা:

বরগুনা সদর উপজেলার পায়রা নদীর পাড়ের ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য পুরনো বাঁধের প্রায় ৯ হাজার (১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী) গাছ কাটা হচ্ছে। এ নিয়ে বন বিভাগ কোনো আপত্তি তোলেনি। তবে স্থানীয় লোকজন একে দেখছে ‘গণহত্যা’ হিসেবে। তাদের দাবি, গাছ কাটা পড়বে প্রায় ২০ হাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাউবোর অধীনে এক হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিআইপি কোস্টাল ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বাঁধ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। আগে বাঁধের কাজ হতো শ্রমিকের হাতে। এখন এসব কাজ করা হবে যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে। যন্ত্র পরিচালনার জন্য বাঁধের ওপরের দীর্ঘ গাছগুলো নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ বাঁধের কাজ শ্রমিকের মাধ্যমে করানো হলে এসব গাছ না কাটলেও চলত। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, মহাসেনসহ বিভিন্ন দুর্যোগে এসব গাছ জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে স্থানীয় লোকদের নানাভাবে সুরক্ষা দিয়েছে। এসব গাছ কাটা পড়লে পরিবেশের জন্য যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনি দুর্যোগের ক্ষেত্রে বিপদাপন্নতা বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়া এসব গাছ ঘিরে শত প্রজাতির পাখির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। সদর উপজেলার ছোনবুনিয়া গ্রামের সবুজ বেষ্টনী বনায়ন কমিটির সভাপতি মোতালেব সিকদার (৬০) বলেন, ‘২০ বছর ধইরা এসব গাছ বড় বানাইছি। কত শত পাখপাখালির নিরাপদ বাড়িঘর ছিল। বইন্যা-বাদলেও (ঝড়-বন্যায়) এই সব গাছ আমাগো কত উপকার করছে। সিডরের সময় এই সব গাছপালা না থাকলে আরো বহুগুণ মানুষের মৃত্যু হইত। অথচ নির্বিচারে এহন এই সব গাছপালা কাইট্টা ফালান লাগদে আছে। মেশিন (এক্সকাভেটর) দিয়া এই বেড়িবাঁধ না বানাইয়া যদি লেবার (শ্রমিক) দিয়া কাম করা যাইত, তয় এত গাছ কিছুতেই কাডা লাগদে না (লাগত না)।’ বরগুনার প্রবীণ সমাজসেবক সুখরঞ্জন শীল বলেন, ‘নির্বিচারে সব গাছ একযোগে কেটে ফেলার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এতে জীববৈচিত্র্যের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনি দুর্যোগ-ঝুঁকি বেড়ে যাবে শতগুণ।’ বন বিভাগ নির্বিকার বন বিভাগের বরগুনা অফিস সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত বেড়িবাঁধগুলোতে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী প্রায় ৯ হাজার গাছ কাটার জন্য ইতিমধ্যে দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এসব গাছ কাটার কাজ চলছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বন বিভাগের হিসাব মতে গাছের পরিমাণ ৯ হাজার হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হবে। বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, এসব গাছকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক ধরনের গাছ সংরক্ষিত (রিজার্ভ ট্রি)। পাখপাখালির নিরাপদ আবাসভূমি হিসেবে এসব গাছ কখনো কাটার কথা নয়। তা ছাড়া মা (মাদার ট্রি) হিসেবে নির্ধারিত ফলদ গাছ রয়েছে, যা নিজস্ব নিয়মে তাদের বংশ বিস্তার করে। এ ছাড়া শুধু কাঠের জন্য এক ধরনের গাছ নির্ধারণ করা থাকে, যা নির্দিষ্ট সময় পরে বিক্রি করার বিধান রয়েছে। অথচ এক্সকাভেটর দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে সব ধরনের গাছ কাটা হচ্ছে। সম্প্রতি ছোনবুনিয়া এলাকার পায়রা নদীর তীরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট-বড় বনজ, ফলদ ও পাখিকুলের জন্য নির্ধারিত সব গাছ কেটে তা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তুলছে ২০-২৫ জন শ্রমিক। বন বিভাগের হিসাবের চেয়ে কেটে ফেলা গাছের সংখ্যা অনেক বেশি বলে যে অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়ে বরগুনার সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) খগেন চন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘অভিযোগটি ভিত্তিহীন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি নীতিমালা মেনে এসব গাছ কাটা হয়েছে। ওই সব স্থানে আবার সরকারি নিয়মেই গাছ রোপণ করা হবে।’ পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশালের পরিচালক সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর গাছ কাটার বিষয়ে ছাড়পত্র দেয় না। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগ ভালো বলতে পারবে। তবে বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য কেন গাছ কাটতে হবে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।’ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগের সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, ‘বেড়িবাঁধের ওপর পরিকল্পিত সবুজ বেষ্টনী দুর্যোগ থেকে উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে থাকে। নির্বিচারে পাখপাখালির জন্য নির্ধারিত রিজার্ভ ট্রি কিংবা মাদার ট্রি বলে চিহ্নিত ফলদ গাছ কাটা হলে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর ফলে দুর্যোগ-ঝুঁকি যেমন বাড়বে, তেমনি হুমকির মুখে পড়বে শত প্রজাতির পাখপাখালিসহ গাছনির্ভর অন্যান্য জীববৈচিত্র্যও।’

Source: www.kalerkantho.com/print-edition/priyo-desh/2016/04/25/351235

Photo Source: www.prothom-alo.com/