মাধবীলতা ও মধুমঞ্জরি বিভ্রান্তি

লেখক- আজহারুল ইসলাম খান।

আপনাকে যদি ভুল নামে ডাকা হয় তাহলে নিশ্চই খুব মন খারাপ করবেন ও সংশোধন করার চেষ্টা করবেন থানা পুলিশ করবেন এফিডেবিট করবেন কিন্তু উদ্ভিদের হয়ত সে অনুভূতি নেই কিন্তু তরুপ্রেমীরা এর দায় এড়াতে পারবেন কি? আমি বছর খানেক যাবৎ কিছু কিছু ফিল্ড ওয়ার্ক করার চেষ্টা করেছি ফলাফল যা পেয়েছি ভয়াবহ ও বিষয়টি রীতিমতো গবেষনার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ও আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা যাকেই প্রশ্ন করেছি সবাই মধুমঞ্জুরি কে মাধবীলতা নামেই চেনে আর মাধবীলতা ডুকরে কাঁদে।

প্রাতঃভ্রমনের সময় আমার পরিচিত শতজনকে প্রশ্ন করছি এই তরুর নাম কি? সঠিক উত্তর মিলেনি কখনো। ভুল উত্তর মিলেছিলো। মধুমঞ্জরি আমার এহেন কর্ম দেখে একদিন আমায় ডেকে পাঠালো। ভিরু ভিরু পায়ে এগিয়ে গেলাম। সে আমায় তার নাম ভিভ্রাট নিয়ে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তার ব্যাথা বেদনার কথা আমাকে সুধালো,বন্ধু হিসেবে আমি তাকে আস্বস্ত করে আসলাম এই বিভ্রান্তির অবসান আমি ঘটাবোই। সে খুশি হয়ে তার সুললিত কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’ চরন শুনিয়ে দিয়েছিলো।

আমার দুয়ারে এসেছিল নাম ভুলি
পাতা-ঝলমল অঙ্কুরখানি তুলি
মোর আঁখিপানে চেয়েছিল দুলি দুলি
করুণ প্রশ্নরতা।
তার পরে কবে দাঁড়াল যেদিন ভোরে
ফুলে ফুলে তার পরিচয়লিপি ধরে
নাম দিয়ে আমি নিলাম আপন ক’রে–
মধুমঞ্জরিলতা।

প্রিয় পাঠক আমি কিছু বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে চাই। মধুমঞ্জরি/মধুমালতি ও মাধবীলতা কে নিয়ে জনমনে প্রচলিত আছে এই ৩টি একই ফুল। আমি বলি এখানে সম্পুর্ন আলাদা আলাদা দুটি ফুল। মধুমঞ্জরির সমনাম মধুমালতি আর মাধবীলতা সম্পুর্ন আলাদা গোত্রের একটি ফুল।

মধুমঞ্জরি/মধুমালতি(Quisqualis indica)—আমি Combretaceae পরিবারের বনেদি সদস্য। ইংরেজ সাহেবরা আমাকে সন্মান করে রেংগুনক্রিপার নামে ডাকে। আমি কাস্টল লতা জাতিয় পত্রমোচী উদ্ভিদ গ্রীস্ম ও বর্ষায় আমার লাল সাদা মিশ্রনের ফুলে সন্ধা বেলায় মাদকতা মিশ্রিত সুবাসে প্রেমিক যোগলদের আমার চারপাশে ঘুর ঘুর করতে দেখেছি।

সুধী পাঠক, মধুমঞ্জরি কথা বলতে বলতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে আমার সামনে নিয়ে আসলো তাঁকে নিয়ে দুচারটি কথা না বলে পারছি না।

নজরুলের সুরের ইন্দ্রজাল বাংলার বিদগ্ধ শ্রোতাগনকে নিঃসন্দেহে বিমুগ্ধ ও মোহগ্রস্থ করতে সক্ষম হয়েছে। রসিয়ার মন রাঙাতে নানান রকমের রাঙা রাঙা ফুলে সাজাবার যে আকুল আকাঙ্খা নায়িকার ছিল ঠিক তা-ই কবি তাঁর গানের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার প্রেমিকা তার প্রেমিককে প্রেম-ফুল দিয়ে হৃদয়ের ডালি ভরে দিতে চেয়েছেন। প্রিয় পাঠক খুব লোভ হচ্ছে আপনাদের গানের অংশবিশেষ একটু বলি– “বধু অন্তর মধু ঢেলে পিয়াব তোমায়। এ গানের অন্তরাটি ছিলো ‘বেল ফুল যদি ঝুরে, প্রেম-ফুল দিব ডালি ভরে”।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে আকর্ষণ সৃষ্টি সহ নিরব নরম মধুর প্রেমের আকুতি ফুটে উঠেছে নজরুলের গানে গানে। বিশেষ করে মধুমালতী ফুলকে কয়েক বার চয়ন করে নজরুল মনে হয় একে একটু বেশী মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন গানটি হলো…

কেন মনো বনে মালতী বল্লরী দোলে,
জানিনা জানিনা জানিনা
কেন মুকুলিকা ফুটে ওঠে পল্লব তলে,
জানিনা জানিনা জানিনা ॥
কেন উর্ম্মি মালা ঝরনার পাশে
সে আপন মঞ্জরী ছায়া দেখে হাসে
কেন পাপিয়া কুহু কুহু মুহু বোলে ॥
চৈতালি-চাঁপা কয় মালতী শোন
শুনেছিস বুঝি মধুকর গুঞ্জন
তাই বুঝি এত মধু সুরভী উথলে মধু মালতী বনে।

প্রিয় পাঠক কাজী সাহেব আমাদের ফুল নিয়ে এভাবেই তার সাহিত্যকে সমৃদ্ব করেছেন ও তুলে ধরেছেন অসংখ্য ফুল।

প্রিয় পাঠক মধুমঞ্জুরির সাথে আমার আলাপচারিতা এখনও শেষ হয়নি…
Malpighiaceae পরিবারের সদস্য মাধবীলতা(Hiptage benghalensis) কে নিয়ে মধুমঞ্জরিলতা নিজেই বর্ননা শুরু করলো। তোমরা কি জান মাধবীলতা বংগদেশীয় ফুল কিন্তু আজ তোমাদের অবহেলার কারনে সেও তার অস্থিত্ব নিয়ে চিন্তিত। মাধবীলতাও আমার মতই কাস্টল লতা জাতিয় উদ্ভিদ শীতে তার পাতা ঝরে যায় প্রায় পত্রহীন ডালপালায় থোকা থোকা সুগন্ধি যুক্ত সাদা রঙের ফুল ফোটায় যাহার স্থায়িত্ব খুবই স্বল্প সময়।
তাইতো কোন এক কবি লিখেছিলেন…

মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এলো
ফাগুন দিনের শ্রোতে।
এসেই বলে,যা ‘ই যা ‘ই যাই।

আমাকে তোমরা যত্রতত্র যেখানে ইচ্ছা দেখতে পাবে কিন্তু আমার জানামতে মাধবীলতা কে তোমরা দেখতে পাবে রমনা উদ্যানে। (মৎস্য ভবনের পাশের গেইট দিয়ে ঢুকে একটু সামনে এগুলেই তার দেখা মিলবে)। এতক্ষন আমার মধুমঞ্জরির সাথে আলাপচারিতা চলছিলো আপনারা আমার প্রতি বিরক্ত হবেন না প্লিজ।
প্রিয় পাঠক,
যেহেতু সুযোগ পেয়েছি তাই আরো দুটি ফুলের সাথে আপনাদের পরিচয় করানোর চেস্টা করছি।
আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আমরা কেউ কেউ এই দুটো ফুলকেও মধুমঞ্জরির সাথে মিলিয়ে বিভ্রান্তি সৃস্টি করি(অজানা বশত)।

মালতী লতা(Aganosma dichotoma) ইহা Apocynaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এটি চিরসবুজ কাস্টল লতা ও অনেক উপর পর্যন্ত আরোহন করে। বর্ষাকালে কাক্ষিক মঞ্জুরিতে কয়েকটি করে সাদা ফুল ফোটে।

মাধুরীলতা/কম্বেট্রাম(Combretum coccineum) ইহা Combretaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এর আদি বাসস্থান মাদাগাস্কার। ইহাও কাস্টল লতা জাতিয় উদ্ভিদ ও এর ঝাড় অনেক বড় হয়। কচি ডালপালা সবুজ ও বাদামী রোম বিশিস্ট। ডালের আগায় চ্যাপ্টা মঞ্জুরিতে কমলা লালে মিশানো ফুল আসা শুরু হয় হেমন্তে যা গ্রীস্ম পর্যন্ত থাকে।
যদিও বর্নিত সবকয়টি উদ্ভিদ কাস্টল লতা জাতিয় কিন্তু এদের ফুল নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে ও রঙে আলাদা আলাদা ফুল ফোটার সময়েও ভিন্নতা রয়েছে। পাতার ও ফুলের আকৃতিগত অনেক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সব কয়টির পরিবার ও গন আলাদা আলাদা।

প্রিয় পাঠক তবু এদের ভুল নামে ডাকলে আবারো মধুমঞ্জরি আমায় ডেকে পাঠাবে, আমি কি জবাব দিব(!)

ছবি ক্রমঃ
(১)মধুমঞ্জরি/মধুমালতি (Quisqualis indica)
(২)মাধবী লতা (Hiptage benghalensis)
(৩)মালতীলতা (Aganosma dichotoma)
(৪)মাধুরীলতা (Combretum coccineum)

সবগুলো ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া।