মৃত্যুঞ্জয়ী উদ্ভিদ
আফ্রিকার গহীন অরন্যে এক ধরনের উদ্ভিদ বাস করে সাধারণ উদ্ভিদের মতই এদের বাহিরের চেহারাটা বেশ নিরীহ। এরা সর্পিল ডালাপালা মেলে উঁৎ পেতে বসে থাকে শিকারের আশায়,হঠাৎ ভুল করে কোন জীব জন্তু বা মানুষ এদের নাগালের মধ্যে গিয়ে পড়লেই সরু লিকলিকে ডালপালা গুলি প্রসারিত হয়ে অক্টোপাসের মত তাকে আস্টে পিষ্টে বেঁধে ফেলে। তারপর বিষাক্ত কাঁটার ঘায়ে শিকারকে আচ্ছন্ন করে ধীরে ধীরে তার রক্ত মাংশ হজম করতে থাকে। কয়েকদিন পর এদের বাহুপাশ শিথীল হলে দেখা যায় শিকারের হাড়গুলো শুধু অবশিষ্ট আছে। ঘোড়াসহ একজন ঘোড়সোয়ার কেও এরা এইভাবে হজম করার ক্ষমতা রাখে। ছেলেবেলায় দাদির মুখে আফ্রিকার জঙ্গলে প্রাপ্ত উদ্ভিদ সম্পর্কে এই রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক গল্প শুনে মনে মনে শুধু ভাবতাম কবে বড় হবো আর আফ্রিকার জঙ্গলে অবস্থিত মানুষ খেকো উদ্ভিদ সরেজমিনে পরিদর্শন করতে যাবো। কিন্তু বড় হয়ে যখন জেনেছি মানুষ খেকো গাছের সঙ্গে বাস্তবতার খুব অল্পই সম্পর্ক আছে। তখন এই গল্পগুলিকে একান্তভাবেই মানুষের চিন্তাশক্তি বা দুশ্চিন্তাশক্তির ক্রমবিকাশ বলেই মনে হয়েছে।
তবে কিছু কার্নিভোরাস উদ্ভিদ আছে যারা ছোট ছোট পোকামাকড়, ব্যাঙ ইত্যাদি প্রাণীকে ফাঁদে আটক করে তাদের খাদ্য গ্রহন করে। আমরা জানি প্রায় সকল উদ্ভিদেরই পুষ্টি গ্রহণ পদ্ধতি একই রকম হয়ে থাকে। অর্থাৎ এরা মাটিস্থ পানি ও খনিজ লবন এবং বায়ুর কার্বন ডাইঅক্সাইডকে(Co2) কাজে লাগিয়ে খাবার প্রস্তুত করে। কিন্তু কার্নিভোরাস উদ্ভিদ গুলো পুষ্টির জন্য প্রাণীর উপর নির্ভরশীল হয় অর্থাৎ সহজে বলতে গেলে এরা প্রাণীদের ভক্ষণ করে। কথাটা অবাস্তব মনে হলেও পৃথিবীতে অবস্থিত এমন উদ্ভিদ কেই মাংসাশী উদ্ভিদ (Carnivorous plants) বলে এবং এদের মধ্যে ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ (Venus Fly trap, Dionaea Muscipula) একটি অন্যতম উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদকে পতঙ্গভূক (Insectivorous Plants) উদ্ভিদও বলা হয়।
পৃথিবীতে উদ্ভিদই মনে হয় যেন আদর্শ অহিংস জীবন যাপন করে থাকে।এদের আক্রমণ করলে কোন প্রতি-আক্রমণ করে না এদের বংশ নির্বংশ করার পরিকল্পনা করলেও কোন প্রতিবাদ করে না। উদ্ভিদের অহিংস নীতির কারনেই হয়ত এরা বেঁচে থাকে শত শত বছর। জীব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে উদ্ভিদের আধিপত্য অব্যাহত আছে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর উদ্ভিদ নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য কত রকম কৌশল অবলম্বন করে তা নিয়ে বিজ্ঞানিরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সবকিছু উন্মুক্ত করতে পারেননি। ৪০-৫০ হাজার বছর পর্যন্ত ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা পদ্মের বীজ অনুকুল পরিবেশ পেলে অঙ্কুরোদগম হয়। এমন কথা শুনলে অনেকের ধারনা হবে এটাও আফ্রিকার মানুষ খেকো উদ্ভিদের মত শুধুই রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক গল্প।
পদ্মের বর্ণ, পাপড়ি,পাতা সবকিছুই সুন্দর,তাই আমরা যাকিছু সুন্দর তাকে পদ্মের সাথে তুলনা করি। সুলক্ষণা সুন্দরী নারীকে অনেকে পদ্মিনী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ভারতে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য পদ্মভূষণ উপাধি দেয়া হয়। শুনেছি পৃথিবী সৃষ্টির সূচনালগ্নে পদ্মের সৃষ্টি হয়েছিলো। বাংলাদেশের খালে বিলে পদ্মের বাসস্থান দেখা যায়। কবি সাহিত্যিকরা পদ্মের রূপ দেখে এদের সৌন্দর্য বর্ননা করতে সামান্য কৃপণতা করেননি। তারা বিমুগ্ধ চিত্তে লক্ষ্য করেছিলেন কোমল চাঁদের আলোর স্পর্শে পদ্ম দলমেলে কেমন হেসে উঠে, আবার প্রখর রোদের স্পর্শে কেমন কুণ্ঠিত হয়ে দল গুটিয়ে নেয়। পদ্ম একান্তভাবে ভারতবর্ষের উদ্ভিদ হলেও চীন জাপান অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় এদের পাওয়া যায় তবে ইউরোপে এদের আধিপত্য খুবই সীমিত।
কিছুদিন আগে বিজ্ঞানী মহলে পদ্মবীজের আয়ুষ্কাল নিয়ে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিলো। জাপানী বিজ্ঞানীরা হঠাৎ দাবি করে বসলেন তাঁরা দেখেছেন ১০-২০ হাজার বছরের পুরানো পদ্মের বীজ মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা অবস্থা থেকে উপযুক্ত পরিবেশে নিয়ে আসলে অঙ্কুরিত হতে পারে। কিন্তু সেদিন তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। বরং অনেকের কাছে তারা উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন। সম্প্রতি চীনে মাঞ্চুরিয়া হ্রদের তলদেশ থেকে ৪০-৫০ হাজার বছর পুরানো কিছু পদ্ম বীজ পাওয়া যায়,বীজের খোসাগুলো ফসিলে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। এই ফসিলের বৈশিষ্ট্য ও মাটির তলায় অবস্থানের খুঁটিনাটি বিবরণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা এদের প্রাক-ঐতিহাসিক সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
এরপর কয়েকজন বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে এই বীজগুলো ওয়াশিংটন ন্যাশানাল পার্কে এবং ক্যালিফোর্নিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনে অঙ্কুরিত করার চেষ্টা করা হয় এবং তাঁদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। প্রায় ৪০-৫০ হাজার বছরের দীর্ঘ নিদ্রা ভঙ্গ করে অবশেষে পদ্মের ভ্রুণ আবার বীজ থেকে বেরিয়ে বিকশিত কিশলয়ে সূর্যের আলো পান করছে। বিজ্ঞানীদের গবেষনায় এটাও প্রমানিত হয়েছে এই সুদীর্ঘ কাল ধরে বীজের মধ্যে ভ্রুণ সম্পুর্ন জীবিত অবস্থায় ছিলো নইলে এই অঙ্কুরোদগম সম্ভব ছিলো না। এই বেঁচে থাকার জন্য তাকে প্রতি মুহুর্তে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়েছে আর যথেষ্ট পরিমান বীজপত্রের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করতে হয়েছে। কিন্তু কোন বিশেষ শক্তির প্রভাবে বা রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রভাবে পদ্ম বীজ প্রায় ৫০ হাজার বছরের সুদীর্ঘ জীবন লাভ করলো সেটা জীব বিজ্ঞানীদের কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা কালে দেখেছিলেন পদ্ম বীজের খোসাটি পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিলো এবং বাহির থেকে পানি ও বাতাস প্রবেশ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে কিভাবে এই বীজ এত বছর বেঁচে ছিলো এই নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, হয়ত একদিন এই অন্ধকার উন্মোচিত হবে সাধারন মানুষ জানতে পারবে এই মৃত্যুঞ্জয়ী উদ্ভিদ সম্পর্কে।