হারিয়ে যাওয়া সারসাপারিলা পানীয় ও কুমারী লতা
লেখক- আজহারুল ইসলাম খান।
আমি জানি প্রথমেই আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে কেন এই উদ্ভিদের নাম কুমারী লতা হলো। সুধী পাঠক এর নামকরনের কারন এই লেখার কোন অংশে উল্লেখ করবো। তার পূর্বে এই উদ্ভিদের অন্য দিক গুলো তুলে ধরতে চেস্টা করছি। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় একে Smilax Sp বলা হয়। এই জেনাসের প্রায় ৩০০-৩৫০ টি প্রজাতি আছে। এদেরকে সাধারনত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এরা Smilacaceae পরিবারভুক্ত একবীজপত্রি সপুস্পক কাঁটা যুক্ত climbing পেরিনিয়াল শক্ত কাস্টল লতা জাতিয় উদ্ভিদ। ইংরেজীতে এদেরকে ওয়াইল্ড সারসাপারিলা, ইন্ডিয়ান সারসাপারিলা বা ব্লাক ক্রিপার বলা হয়। এছাড়াও Catbriers, Greenbriers, Prickly-ivys ও smilax নামে পরিচিত। আমাদের দেশে কুমারীলতা বা কুমারীকা নামেই অধিক পরিচিত তবে কোথাও কোথাও বুলকুমিয়া, বেড়াল আচড়া নামেও এই উদ্ভিদ পরিচিতি লাভ করেছে।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি কুমারীলতা শক্ত লতানো, কাটাযুক্ত আরোহী উদ্ভিদ। পাতার অগ্রভাগ সরু, বৃন্তদেশ গোলাকার,পাতার উপরের দিক মসৃণ। গ্রীষ্ম, বর্ষায় মনকাড়া ফুল ফোটে। এর কচি ডগার রঙ খুবই আকর্ষনিয়, দেখলে মনে হয় যেন সদ্য স্নাত এক রূপসী দাঁড়িয়ে হাতচানি দিচ্ছে। আগেকার দিনে অবিবাহিত মেয়েদের PMS এর ব্যাথা নিরাময়ে এই লতার কচি ডগা পিষে রস খাওয়ানো হতো এতে যেহেতু চমৎকার ফলাফল পাওয়া যেতো তাই এর বাংলা নামকরন করা হয় “কুমারীলতা” বা “কুমারিকা”। এছাড়াও এই উদ্ভিদে স্মাইলাসপারিক এসিড পাওয়া যায় তাই উদ্ভিদ বিজ্ঞানি কার্ল লিনিয়াস এতে প্রাপ্ত উল্লেখিত এসিডের উপর ভিত্তি করেই এই গনের নামকরন করেছেন Smilex L.
কুমারীলতার (Smilex regelii) বাকল থেকে সারসাপারিলা (Sarsaparilla)কোমল পানীয়, চা, বিয়ার ও এর রাইজোম থেকে সোডা তৈরি করা হতো যা সারা পৃথিবীতে খুবই সমাদৃত ছিলো। ১৯ শতাব্দিতে প্যাটেন্ট মেডিসিন হিসেবে আমেরিকায় Sarsaparilla পানীয় খুবই জনপ্রিয় ছিলো। তখনকার সময় একে স্কিন ও রক্তের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান মনে করা হতো। এটি আমেরিকান কালচারে খুবই জনপ্রিয় পানীয় ছিলো। Sarsaparilla পানীয় venereal disease এর প্রতিরোধক কারন এর diuretic প্রভাব আছে ফলে যৌনসহবাসের পরে urethra কে পরিচ্ছন্ন করতে সহায়ক ভুমিকা রাখে।
বর্তমানে sarsaparilla বিয়ার হিসেবে পান করা হয়। এর অল্প করেকটি ব্রান্ড আমেরিকাতে পাওয়া যায়। তবে এই পানীয় আগে প্রচুর পাওয়া যেতো কিন্তু এখন আর সব দেশে পাওয়া যায় না। এখন sarsaparilla ফ্লেভারের ড্রিংকস পাওয়া যায় তাতে Smilex Sp ব্যবহার করা হয় না। বলা যায় আসল sarsaparilla এখন খুব কম প্রস্তুত করা হয়।
১৮২০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত কুমারী লতা USP তে সিফলিসের ঔষধ হিসেবে রেজিস্টার্ড ছিলো। কুমারীলতায় স্যাপোনিন, রেসিন, ডায়োসজেনিন, ট্যানিন, সিটোস্টেরল, কিউমারিন, রুটিন, স্মাইলাসপারিক এসিড সহ বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান এর মূল থেকে পৃথক করা হয়েছে। এই উপক্ষার গুলো সিফিলিস,গনোরিয়া,বাত,পায়ের ব্যথা, ফুলে যাওয়া, রক্ত-শুন্যতা,আমাশয় ও জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এর রাইজোম শুকিয়ে পাউডার করে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। জ্যামাইকান কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যাতে ৪ রকমের Progesterone থাকে। একটি সমিক্ষায় দেখা যায় Smilax flavonoids অটোইমিউনি(autoimmune)ডিজিজে ফলপ্রসু। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে আমেরিকার কিছু গবেষক যথাক্রমে দাবি করেছেন Smilax এর রাইজোম লিভার ক্যান্সারের বিরুদ্বে কার্যকরি ও এন্টি ভাইরাল ফলাফল প্রদর্শন করে। তবে এই নিয়ে এখনো গবেষনা চলছে,হয়ত সেদিন খুব দুরে নয় বিজ্ঞানিরা স্মাইলেক্স থেকে ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধির ঔষধ আবিস্কার করবেন। সুধী পাঠক, আমরাও সেই আশায় বুক বেধে রইলাম।
Smilax প্রতিকুল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে,আগুনে পুড়িয়ে দিলেও এর রাইজোম থেকে পুনরায় নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। পাখি ও অন্য ছোট জীব জন্তু এর পরাগায়ন ঘটায় ও বীজের বিস্তার ঘটায় ফলে নতুন উদ্ভিদের জন্ম নেয়। সাধারনত কুমারীলতা অন্য উদ্ভিদের উপর এর কাটা ও আকর্ষির সাহায্যে ভর করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।
★PMS=প্রি-মিন্সস্ট্রুয়াল সিনড্রোম।
★USP=ইউনাইটেড স্টেটস ফার্মাকোপিয়া।
★Progesterone=Progesterone(প্রোজেস্টেরন)এক প্রকার হরমোন যা মেয়েদের ওভারিতে উৎপন্ন হয় এবং প্রেগনেন্সিতে সহায়তা করে।
★ফ্ল্যাভোনয়েড=ফ্ল্যাভোনয়েড(Flavonoids)হলো উদ্ভিদের খুবই গুরুত্ববাহী রঞ্জক (Pigment) যাহা ফুলের রঙ তৈরী করে, পরাগায়ন কারী প্রানী দের আকৃস্ট করার জন্য ফ্লাভোনয়েড হলুদ,লাল ও নীল রঙের পাপড়ীর ডিজাইন তৈরী করে। কিছু উঁচু (Higher plants) শ্রেনীর উদ্ভিদে ফ্ল্যাভোনয়েড UV (আল্ট্রা ভায়োলেট) রেডিয়েশান কে ফিলট্রেশন করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ফ্ল্যাভোনয়েড উদ্ভিদের রাসায়নিক মেসেঞ্জার, শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রক এবং সেল(Cell) চক্র ইনহিবিটরের কাজ করতে পারে।
★Venereal disease= এক ধরনের রোগ যা নারী পুরুষের যৌন সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন বীজ্জ(semen) অথবা ভেজাইনাল ফ্লুইড নিঃসরনের মাধ্যমে ছড়ায়।
সতর্কীকরণঃ যে কোনো ভেষজ ঔষধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।