উদ্ভিদজীবন ও পলিনেটর

প্রজাপতি কর্তৃক পলিনেশন দেখানো হয়েছে ছবিটি HFRCH ক্যাম্পাস থেকে ধারনকৃত
আজ থেকে সব উদ্ভিদের পুস্পায়ন বন্ধ। কি ভয় পেয়ে গেলেন তো! সত্যিই ভয় পাবার মতই ব্যাপার। যদি এমন ঘটে তাহলে এই সভ্যতা, এই চাকচিক্যময় সুন্দর পৃথিবীর কি অবস্থা হবে! আমাদের মত উন্নত শ্রেণীর প্রাণীকুল কোথায় পাবে অক্সিজেন কোথায় পাবে আহার বস্ত্র বাসস্থান ঔষধ পথ্যাদি! আর যদি কখনো এমন হয় যে, সব পলিনেটর মিটিং মিছিল করে ধর্মঘট ডেকে একটা ঋতুতে সব রকমের পলিনেশন বন্ধ করে রাখে তাহলেই বা কি অবস্থা হবে(!) যদিও পৃথিবী প্রলয়ের আগে এরকম কিছু ঘটবে না তবু আমার ভাবনা, মাঝে মাঝে এই ভাবনা থেকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই ও নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করি প্রকৃতি পলিনেটরদের মিটিং মিছিল করার সামর্থ দিয়েছে বলেই দলবেধে কিচির মচির বা ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঝাকে ঝাকে একদিকে ছুটতে থাকে তবে ধর্মঘট ডাকার মত বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেনি কিন্তু এদের বাঁচিয়ে রাখার মত বুদ্ধি ও জ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছেন, আমরা কি সেটাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাচ্ছি?
- পাখি কর্তৃক পরাগায়নের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ছবি- গুগলের সৌজন্যে।
- ফুলের বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে। ছবি- গুগলের সৌজন্যে।
- বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পরাগ রেণু দেখানো হয়েছে। ছবি- গুগলের সৌজন্যে।
- বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পরাগ রেণু দেখানো হয়েছে। ছবি- গুগলের সৌজন্যে।
- প্রজাপতি কর্তৃক পলিনেশন দেখানো হয়েছে ছবিটি HFRCH ক্যাম্পাস থেকে ধারনকৃত।
আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বর্ষাকালে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর ব্যাঙ ডাকতো। সারা রাত প্রচুর বৃষ্টি হতো রাতে একদল মানুষ টর্চের আলো জ্বালিয়ে ব্যাঙ শিকারে নামতো ভোরের আলো ফুটলে এগুলোকে বাজারে বিক্রয় করে দিত। এখন আর ব্যাঙ নেই শিকারিও নেই, পরিনামে ফুড চেইন ভেঙ্গে দিয়ে ক্ষতি করেছি এদের উপর নির্ভরশীল প্রাণীদের; ঠিক তেমনি কিছু উদ্ভিদের যাদের পলিনেটর ছিলো ব্যাঙ। আর এই ব্যাঙ যে সব পোকামাকড়, মশা ও এদের লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকতো সেই সব পোকা মাকড়ের উৎপাত বেড়েছে যা মনুষ্য জীবনকে নাজেহাল করছে।
যেমন আজকাল মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে ফ্রিকোয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনের সময় মৌমাছিদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। আম্র কানন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে ও সুমিষ্ট নেকটার উৎপাদন করে পলিনেটরের অপেক্ষারত আর এদিকে কৃষক ভাই মহা খুশী এবার নিশ্চিত ফলন ভালো হবে কিন্তু বেচারা পলিনেটরের কোন দেখাই নেই। এটাকে কি ধর্মঘট বলবো নাকি আমরাই পলিনেটরকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছি। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলেরই জানা তবু কেন আমরা উদাসীন। এভাবে একটার পর একটা উদাহরন টেনে আনলে বিশাল পুস্তিকা রচনা করা সম্ভব।
পরাগায়নের জন্য যে সব বাহক বা এজেন্সিগুলো আছে তাদের কেবল উপস্থিতি থাকলেই পরাগায়ন ঘটবে না। আসলে তাদের সক্রিয়তার উপর ঘটনাটি নির্ভর করে। আর এদের সক্রিয়তা ঋতু পরিবর্তন ও দিবা রাত্রির বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে- যেমন ধরুন তাপমাত্রা ও আদ্রতা। আর দিবা-রাত্রির ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা, আদ্রতা, আলোর তীব্রতা, বায়ু প্রবাহ, পুষ্পরস ও পরাগ উৎপাদন, পলিনেটরের উপস্থিতি এবং এদের মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা নির্ভরশীল।
সঠিক ঋতুতে যদি সঠিক উদ্ভিদের নির্দিষ্ট বাহকের সক্রিয়তা একক ধারায় সংগঠিত হয় তাহলেই কেবল সুপরাগায়ন সম্ভব। তবে এখানে আলোর সময়কাল, আলোর তীব্রতা, তাপমাত্রা, বাতাসের আদ্রতা, মাটির আদ্রতা, পুষ্টির সরবরাহতা নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি অঞ্চলে যে সকল উদ্ভিদের মধ্যে পরাগায়ন ঘটবে তাদের ভূতাত্বিক অবস্থান ও তাদের উপস্থিতির ঘনত্বও বিশেষ ভাবে বিবেচ্য বিষয়। কারন একেক উচ্চতায় একেক রকমের পলিনেটরগুলো সক্রিয় থাকে। একটি উদ্ভিদ থেকে আর একটি উদ্ভিদের দুরত্ব কতটুকু তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেননা কিছু কিছু পরাগের আয়ুস্কাল মাত্র ৩-৪ মিনিট সুতরাং উল্লেখিত সময়ের মধ্যে পলিনেটর যদি পরাগযোগ ঘটাতে না পারে তাহলে পরাগরেণু মারা যাবে, পলিনেশন ঘটবে না। সুধী পাঠক সফল পরাগায়নের জন্য উদ্ভিদ ভেদে নির্দিষ্ট দুরত্ব ও পরস্পরের মধ্যে নির্দিষ্ট ঘনত্ব একটি বিশেষ ব্যাপার বটে।
এছাড়াও রয়েছে পতঙ্গপরাগী উদ্ভিদের সুনির্দিষ্ট পলিনেটর। তাদের সংখ্যা ও বিচরন বৈশিষ্ট্যাবলী এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয় উপস্থিত উদ্ভিদ সমূহের মধ্যে পলিনেটরের পছন্দ-অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সব উদ্ভিদের পুষ্পরস সব পলিনেটর পছন্দ করে না। পরাগের জীবনকাল (Longivity) পরাগায়নের জন্য বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সফল পরাগায়নের জন্য গর্ভমূন্ড কর্তৃক পরাগ গ্রহনের সময়কাল একটি বিশেষ ব্যাপার অর্থাৎ দিনে ও রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। যেমন প্রজাতি ভেদে কিছু কিছু উদ্ভিদের পরাগায়ন দিনের প্রথম অংশে বা দ্বিতীয় অংশে বা রাতে ঘটে থাকে। সার্থক পরাগায়ন ও নিষেক প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। বিভিন্ন পরিবেশগত বিষয়ের সাথে পলিনেটর সক্রিয় থাকে যখন এদের সাথে উদ্ভিদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে তখনই সঠিক কার্যক্রম ঘটে ও ভ্রূণ, বীজ তথা ফলন নিশ্চিত হয়।
পরাগায়ন উদ্ভিদজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; প্রকৃতির এই অধ্যায়টি যে দিন বন্ধ হয়ে যাবে সে দিন পৃথিবী ধ্বংশ হবে নিশ্চিত।
পলিনেটরঃ বিভিন্ন প্রকারের পোকা মাছি ও প্রানী।
লার্ভাঃ পোকার জীবন চক্রের একটি ধাপ।
ভ্রূনঃ ভ্রূন সৃস্টি হওয়ার আগে কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন হয় যেমন ডিম্বাণু বলতে জীবের স্ত্রীজননকোষ বুঝানো হয় যা জীবের যৌন জনন প্রক্রিয়ায় শুক্রাণুর দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে। ডিম্বাণু সাধারনত হ্যপ্লয়েড ক্রোমোসোম ধারন করে থাকে। নিষিক্ত (ফার্টিলাইজড) ডিম্বাণু ডিপ্লয়েড যা প্রথমে জাইগোট গঠন করে ও পরবর্তিতে ভ্রূন এবং শিশু জীবে পরিনত হয়।