গহীন অরণ্যে জীবন্ত সেতু লিয়ানা

সর্পিল আকার ধারন করা লিয়ানা

আজ আমার সিরুর কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের বাড়িতে বেশ বড় সুপারি বাগান ছিলো প্রতি বছর নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে পাকা সুপারি বাজারে বিক্রি করার হিড়িক পড়ে যেতো এমন সময় সিরু এসে হাজির হতো। সে বিশাল বাগানের একপাশের একটি গাছে উঠে আর নামতো না,একটু শরীর ঝুলিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলে যেতো এভাবেই বানরের মত এই গাছ থেকে ওই গাছে নিজেকে ট্রান্সফার করে তখন আমাদের অনেক আনন্দ দিয়েছে। ছেলেবেলায় সিরু ছিলো আমাদের কাছে হিরু, কত কল্পনা ছিলো ইচ্ছে ছিলো আমিও বড় হয়ে সিরুর মত এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাবো, বাচ্চাদের অনেক আনন্দ দিবো! সিরু হয়ে উঠাই ছিলো আমার প্রতিজ্ঞা ও প্রথম পছন্দ। যাই হোক আমার সিরুর মত হয়ে উঠা হলো না সুপারি গাছের একহাত উপরেও কখনো উঠতে পারিনি।

কিছুদিন আগে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে গিয়েছিলাম সেখানে অনেক পুরানো কিছু গাছের মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবে লিয়ানা এক গাছকে আরেক গাছের সাথে বনে বসবাস কারি প্রানীদের চলাচলের জন্য সংযোগ স্থাপন করে দিয়েছে যাকে দেখলে মনে হয় প্রাকৃতিক সেতু। আসলে লিয়ানা হলো এক প্রকার কাষ্ঠল লতা যা অনেক মোটা হয় ও অন্য গাছের উপর বেয়ে উঠে নিজেদের বংশ বিস্তার করে। তবে লিয়ানা শ্রেণীবিন্যাসকৃত কোন নির্দিষ্ট উদ্ভিদের গন,পরিবার বা প্রজাতি নয় অর্থাৎ একাধিক পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিকে একত্রে আমরা লিয়ানা বলতে পারি।

লিয়ানার উপর দিয়ে বানর হেটে যাচ্ছে

গহীন অরন্যে এইসব লিয়ানা বনের ইকোসিস্টেম ও ফুড চেইনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যেমন কিছু মাংশভোজী প্রানীরা অন্য প্রানীদের উপর নির্ভরশীল এমতাবস্থায় এই সব লিয়ানাকে নির্ভর করে শিকার ধরে অথচ লিয়ানা না থাকলে কখনোই শিকার ধরতে পারতো না। এছাড়া যে সকল মানুষ বনের উপর সরাসরি নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা গহীন বনের মধ্যে নদী পাহাড় পাড়ি দেয়ার জন্য লিয়ানাকে ব্যবহার করে জীবন্ত সেতু তৈরি করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে সক্ষম হয়।

লিয়ানার তৈরি জাল

গহীন অরন্যে লিয়ানা ও অন্য উদ্ভিদের মধ্যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। স্বাভাবিক ভাবে লিয়ানা পরাশ্রয়ী ও আরোহী কাষ্ঠল লতা তাই এদের প্রধান ও একমাত্র ভরসা হলো অন্য বৃক্ষ, কিন্তু বৃক্ষ এদের এড়িয়ে চলার চেস্টা করে। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন লিয়ানার অত্যাচারে অনেক উদ্ভিদ বাঁকা হয়ে উপরের দিকে বৃদ্ধি পায় আবার নাছোড়বান্দা লিয়ানা কখনই আশ্রয়দাতা উদ্ভিদকে ছাড়তে চায় না। এই প্রতিযোগীতার মধ্যে যে যাকে পরাজিত করতে পারে তারই জয় হয়। তবে কিছু কিছু উদ্ভিদ লিয়ানার শিশু অবস্থা টের পেয়ে এলিলো কেমিক্যাল নিঃসরণ করে ফলে শুরুতেই এদের বিস্তার রোধ হয়ে যায়। এখানেও প্রকৃতি বিজ্ঞানি চার্লস ডারউইনের বিখ্যাত উক্তিটি প্রযোজ্য “সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট”।

বেত জাতীয় লিয়ানা

বনজীবি মানুষ গুলো তাদের খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য সরাসরি লিয়ানার উপর নির্ভরশীল। কারন কিছু বেত জাতীয় লিয়ানা পাওয়া যায় যা দিয়ে মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরি করা হয় তারা এই সব লিয়ানা সংগ্রহ করে চড়া দামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া বাসস্থান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে এইসব লিয়ানা ব্যবহার করে। লিয়ানা গুলো চমৎকার ভাবে বাঁকানো শেপ নিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে পরিপক্ক অবস্থায় এইসব লিয়ানা বিভিন্ন প্রকার শোপিস, আসবাবপত্রের ডিজাইনের জন্য ব্যবহার কল্পে মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে বিক্রয় করা হয়।

লিয়ানার তৈরি জীবন্ত সেতু

এছাড়া বিভিন্ন প্রকার মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট তৈরিতে বিশেষ কিছু লিয়ানা ব্যবহার করা হয় যা অত্যান্ত উঁচু মূল্যে বিক্রয় করা হয়। আজকাল বিজ্ঞানিরা মানবদেহে ভাঙ্গা হাড়ের বিকল্প হিসেবে লিয়ানা ব্যবহারের চেষ্টা করছে, তবে এই বিষয়টি এখনো গবেষনার পর্যায়ে আছে, হয়ত একদিন এমন সুসংবাদ আমরা পেয়ে যাবো যে, লিয়ানাকে মানুষের হাড়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে কোন বাধা নেই।

দ্বিখন্ডিত আকারের লিয়ানা

আশ্চর্য ব্যাপার হলো গহীন অরণ্যে এইসব লিয়ানা গুলো প্রায় ৫০০ থেকে ৪০০০ ফিট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে ও ৫০-৬০ বছর ধরে এরা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বনে বসবাসরত প্রানীকুলের জন্য অক্সিজেন(O2) সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বিশাল বন তার বক্ষে ধারন করে থাকে বিশাল এক প্রাণীকুলের সুতরাং এদের জন্য দৈনন্দিন প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে এই লিয়ানা বনে বসবাসকারী প্রাণীকুলের মোট খাদ্য চাহিদার ৬০% যোগান দিয়ে থাকে। একটা ব্যাপার খুবই পরিস্কার যদি লিয়ানার বংশবৃদ্ধি কমে যায় তাহলে খাদ্য ঘাটতিতে অনেক প্রয়োজনীয় প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এককথায় বলা চলে গহীন অরণ্যের ইকোসিস্টেম তথা পরিবেশের জন্য লিয়ানা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সিরু হলো একজন মানুষের নাম, তার ভাল নাম ছিল সিরাজ, এলাকার লোকজন তার নাম সংক্ষিপ্ত করে সিরু বলে ডাকতো। বর্তমানে সে বেঁচে নেই।

ছবিঃ গুগলের সৌজন্যে।