দুর্লভ লাল ঘুঘুু
লেখা ও আলোকচিত্র: আ ন ম আমিনুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরকৃবি) আমার অনুষদ অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স-এর কাছে একটা কলাবাগান আছে। ক্যামেরা হাতে ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ ক’বার বাগানের ভেতর পাখি ঢুকতে দেখেছি। ২ নভেম্বর ২০১০-এ পাখি দেখার সঙ্গী কামালকে নিয়ে প্রথম বাগানে ঢুকি। একটি চামচিকা ও দু’টি পাখির বাসার ছবি তুলি। একটি বাসা ছিল কলার কাঁদির উপর; নতুন বাসা। অন্যটি কাঁদির মাঝামাঝি ও পরিত্যক্ত। ৪ নভেম্বর ২০১০-এ আবার ঢুকলাম। এবার টার্গেট কলার কাঁদির উপরের বাসাটি। লুকিয়ে লুকিয়ে সাবধানে যাচ্ছি। হ্যাঁ, দেখেছি। আরেকটু এগুলাম। পজিশনটি ভালো হলো না, আঁড়াল থেকে ছবি তুললে ভালো হবে না। তাই একটু সামনের দিকে এগুনোর চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে শিকার উড়ে গেল। অনেক্ষণ অপেক্ষা করলাম; কিন্তু পাখিটি আর এল না। এরপর প্রতিদিনই লুকিয়ে লুকিয়ে বাগানে ঢুকতাম। বাসা থাকলেও পাখি নেই। তবে কি বিরক্ত হয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেল? এমনটা হলে খুব কষ্ট পাব। ৮ নভেম্বর ২০১০-এ আবারও গেলাম। তবে বেশ সাবধানে। হ্যাঁ, সে আছে। অতি সাবধানে তিনটি ছবি তুললাম। ১১ নভেম্বর দেখলাম বাসায় দু’টি ডিম।
এরপর ঈদের ছুটিতে বাসায় চলে এলাম। বেশ লম্বা ছুটি। ছুটির পর ভারতে একটা কনফারেন্স। এরপর ২ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে থেকে শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দশদিনের শিক্ষা সফর। কাজেই পাখিগুলোর খোঁজ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ফার্ম ম্যানেজার ওয়াহেদ মল্লিক সাহেবকে ফোন করে এদের দিকে নজর রাখতে বললাম। কারণ কলা পাকার সময় হয়েছে। শ্রমিকদের কোন বিশ্বাস নেই। ২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বাগানে ঢুকলাম। কিন্তু বাসা বা পাখি কিছুই দেখলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারকে ফোন করলাম। উনি বললেন একদিন শ্রমিকরা কলা কাটার সময় একটি বাচ্চাসহ বাসাটি উদ্ধার করে তাকে জানায়। এরপর তার নির্দেশে পাশের কলাগাছে বাচ্চাসহ বাসাটি রেখে দেয়। পরবর্তীতে মা-বাবা এসে খাইয়ে-দাইয়ে বাচ্চাটিকে বড় করেছে ও শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটি উড়ে যেতে পেড়েছে।
এতক্ষণ যার কথা বললাম সে হলো লালঘুঘু বা লাল রাজঘুঘু। অনেক এলাকায় জংলাঘুঘু নামেও পরিচিত। রংপুর অঞ্চলে শনি ঘুঘু ও বাগেরহাটে মটর ঘুঘু নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Red turtle বা Red collared dove। বৈজ্ঞানিক নাম Streptopelia tranquebarica। লালঘুঘুর দু’টি জানা উপপ্রজাতির মধ্যে এদেশে Columba tranquebarica humilis উপপ্রজাতিটিই দেখা যায়। গোলাপি-মেরুন ডানার পুরুষটি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর।
লালঘুঘু ছোট আকারের পাখি। লম্বায় ২৩ সেমি, যার মধ্যে লেজই ৯ সেমি। স্ত্রীটি পুরুষটির চেয়ে কিছুটা ছোট। পুরুষটির মাথা নীলচে-ধুসর। পিঠ ও ডানার পালক গোলাপি-মেরুন। ডানার পিছনের অংশ কালচে। লেজের পালক ধূসর, তবে পালকের কিনারা কালচে। লেজের নিচটা সাদা। বুক ও পেট হালকা গোলাপি। স্ত্রীটির রঙ পুরাপুরি অলাদা; দেহের উপরের অংশ গাঢ় হলদে-বাদামি ও নিচের অংশ হালকা হলদে-ধূসর। উভরেরই গলার পিছনে একটি কালো চিকন কলার আছে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চোখের রঙ বাদামি, ঠোঁট কালো, পা বেগুনি-লাল বা বেগুনি-কালো ও নখ কালো। বাচ্চাগুলোর দেহের উপরের অংশ ও বুকের রঙে হলদে আভা থাকে। ডানার পালকের আগা লাল ও গলায় কোন কলার নেই।
ঝোঁপ-জঙ্গল, খোলা মাঠ, গ্রাম বা আশেপাশে বড় বড় গাছ আছে এমন কৃষিজমিতে এদের দেখা মেলে। এদেশের প্রায় সবখানেই লালঘুঘু দেখা গেলেও তিলাঘুঘুর মতো বেশি সংখ্যায় চোখে পড়ে না। সাধারণত জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। কৃষিজমি, খামার, ঘাসপূর্ণ মাঠ, ঝোঁপ, বনের প্রান্ত বা গ্রামে হেটে হেটে খাবার সংগ্রহ করে। ঘাস ও আগাছার বীচি, শস্যদানা, গাছের কুঁড়ি ও কচি পাতা খায়। ভোরবেলা ও গোধূলিতে বেশি তৎপর থাকে। তবে প্রয়োজনে দুপুরেও খাবার সংগ্রহ করে। এরা ‘ক্র-উ-উ-উ-উ’ বা ‘গুউ-গুউ-গুউ’ স্বরে ডাকে। একসময় প্রচুর সংখ্যায় দেখা গেলেও ঘুঘুশিকারিদের অত্যাচারে ও ঝোঁপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় বর্তমানে এদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।
এরা সারাবছর প্রজনন করতে পারে। সাধারণত গাছের পাতাওয়ালা শাখায় ঘাস ও কাঠিকুটি দিয়ে বাসা বানায় ও তাতে স্ত্রীটি দু’টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয় মাত্র বার দিনে। বাসা বানানো থেকে শুরু করে ডিমে তা দেয়া ও বাচ্চাদের খাওয়ানো সবকিছুই স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলেমিশে করে।