ভুট্টার রঙ ও ইতিহাস
আমরা রঙিন হতে চাই কাউকে রাঙাতে পছন্দ করি। আর কথায় আছে মনে রঙ থাকলে সব কাজে নাকি একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করা যায়, যার ফলাফলও হয় রঙিন। আমাদের দেশে এক সময় ভুট্টা খুবই অবহেলিত একটি ফসল ছিল,কেউ এর চাষাবাদ করতো কিনা জানিনা, হয়ত বয়োজেষ্ট দের জিজ্ঞেস করলে এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আজকাল আমাদের দেশে মানুষের খাদ্য ও পশু খাদ্য হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে ফলে চাষাবাদও বৃদ্ধি পেয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
•
Corn শব্দটি এসেছে পুরানো জার্মান ও ফ্রেঞ্চ শব্দ থেকে। ১৬ শতাব্দির আগে
প্রধান শষ্য হিসেবে জার্মানিতে চাষ করা হতো। আবার ইংল্যান্ডে,স্কটল্যান্ডে ও আয়ারল্যান্ডে একে oats হিসেবে চাষাবাদ করা হতো।কলম্বাস যখন আটলান্টিক থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ভুট্রাকে(Zea mays) প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন তখন এদিকে রেড ইন্ডিয়ার প্রধান ফসলি দানা শষ্য ছিলো এটি। তার পর থেকেই একে ইন্ডিয়ান কর্ন বলা শুরু হয়।
•
ভুট্রার ইতিহাস আসলেই খুব আশ্চর্যজনক কেননা আজ আমরা যাকে কর্ন হিসেবে জানি তা অতীতে কর্ন হিসেবে পিরিচিত ছিল না। পৃথিবী পরিবর্তনের সাথে সাথে এর পরিচিতি পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ভুট্রা। ধান ও গমের প্রাকৃতিক ভাবে জংলী ভ্যারাইটি ছিল যা এখনো প্রকৃতিতে জন্মে কিন্তু জংলী ভুট্রা বলতে কিছু ছিল না। ভুট্টা সম্পুর্ন ভাবে মানুষের তৈরি একটি দানা শস্য। আমরা আজ যে ভুট্টা থেকে মজাদার খাবার প্রস্তুত করি সেই ভুট্টা আসলে Teosinte ও Gamagrass নামক দুটি ঘাসের সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর ফলাফল।
•
জেনেটিক পর্যবেক্ষন করে এটা আজ প্রমানিত যে এই প্রতিটি ঘাস ভুট্টা র evolution এর সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে। এইজন্যই আগেকার ভুট্টার মত দেখতে কিন্তু ভুট্টা নয় এমন ঘাস গুলোকে teosinte বলা হতো। এবং এগুলো ছিলো অত্যন্ত ছোট দানা শস্য। সম্প্রতি ফ্লোরিডা থেকে একটি আর্টিকেলে প্রকাশিত হয়েছে যে এই সব ভুট্টা ৫৩০০ বিসি তেও চাষাবাদ করা হতো এবং তখন এদের বাম্পার ফলন হতো। তখনকার দিনে এইসব উদ্ভিদ ছিল অত্যন্ত পরিবর্তনশীল এবং ২ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। পরবর্তিকালে জেনেটিক্যালি মডিফাই করে এদের উচ্চতা কমিয়ে আনা হয় যেন অল্প বাতাসে নুয়ে না পড়ে। যার ইতিবাচক ফলাফল ছিল আমরা অধিক ফলন পেতে শুরু করেছিলাম।
•
ভুট্টা যেহেতু ঘাস তাই এদের নোড ও ইন্টারনোডাল (nodes and internodal) বৃদ্ধি আছে। বিজ্ঞানিরা এটা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন যে প্রতি পূর্ন চাঁদে ভুট্টা একটি নোড ইউনিট পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এই রকম তিনটি পূর্ন চাঁদের চক্রে এরা পরিপুর্ন যৌবন লাভ করে। ভুট্টায় অনেক রকমের রঙিন জিন এর উপস্থিতি আছে। নতুন প্রজন্মের glass gem corn এ এত রঙের বৈচিত্রতা দেখা যায় যা অন্য কোন জাতের ভুট্টা তে পাওয়া যায়না। তবে আজকাল জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে রেড ইন্ডিয়ানরা কিছু বিচিত্র রঙের ভুট্টা উদ্ভাবন করেছে যাদের রঙে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এমনও জাত আবিষ্কার হয়েছে যে একটি ছড়াতে সব বর্ণের ভুট্টা’র উপস্থিতি বিদ্যমান। বিষয়টি যে কাউকে আনন্দ দেয় বৈকি
•
বহু বছর ধরে সিলেক্টিভ breeding এর ফসল হলো এই strain এর ভুট্টা। বৈজ্ঞানিক ইতিহাস থেকে জানা যায় একজন বিজ্ঞানি এই পরীক্ষা চালিয়ে শেষ করার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তারই ধারাবাহিকতায় তার উত্তরসুরি অন্য একজন বিজ্ঞানী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই দৃষ্টিনন্দন ভুট্টার জন্ম দিতে পেরেছেন।ভুট্টা হলো খাদ্য শস্য অর্থাৎ ক্ষুদ্র ফল যার শক্ত বীজ আছে। এই ফল একটি পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ভুট্টা হলো cereal grain কারন আজকের এই দৃষ্টিনন্দন ভুট্টার উৎপত্তি হয়েছে এক প্রকার ঘাস থেকে।
•
বংশগতিবিদ দের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফসল হলো এই অগনিত বিভিন্ন রঙের ভুট্টা। প্রতিটি শস্যে ভিন্ন ভিন্ন বীজ থাকে সুতরাং প্রতিটি বীজ একদিন আলাদা আলাদা উদ্ভিদে পরিনত হয়।ভুট্টার পুং পুষ্প থেকে পোলেন গ্রেইন বাতাস বা অন্য পলিনেটরের সাহায্যে স্ত্রী পুষ্পে পতিত হয়।প্রতিটি pollen grain এর স্পার্ম সেল আছে এরা সকলেই মাইটোসিস ও মিয়োসিস এর মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। এই প্রক্রিয়াটি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
•
স্ত্রী পুষ্প গুলো সিল্কি কর্ন সদৃশ। প্রতিটি সিল্কি কর্ন আলাদা আলাদা ওভারির সাথে সংযুক্ত থাকে।প্রতিটি ডিম্ব আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটি মাতৃ উদ্ভিদের জিনোম।আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটি স্ত্রী পুষ্প বাতাসের সাহায্যে বা অন্য পলিনটরের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পুং পুষ্প হতে নির্গত পরাগ রেণু দ্বারা পরাগায়িত হতে পারে। বলার কিছুই নেই এখানে সকল স্ত্রী পুষ্পের জন্য একজন মাত্র পিতা থাকে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু একই ছড়ায় বিভিন্ন রঙের ভুট্টা উদ্ভাবনের কারনটি এক রঙের ভুট্টার ঠিক উলটো, অর্থাৎ একটি স্ত্রী পুষ্পে যখন পলিনেশন ঘটে তখন একাধিক পিতার(পুং পুষ্প) পোলেন গ্রেইন একটি মাত্র স্ত্রী পুষ্পে পতিত হয়।
•
সুতরাং আমরা রেড ইন্ডিয়ান উদ্ভাবিত ভুট্টা তে কালারফুল জিন দেখতে পাই যার পলিনেশন ঘটে মাত্র একজন পিতা কর্তৃক ও এর বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভুট্টা র দানাতে বিভিন্ন রঙের উপস্থিতিতে। এটাই হলো সংক্ষিপ্তাকারে রঙীন ভুট্টার রঙের কারন।
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
কবিগুরু কি তখন জানতেন এই রঙের খেলাটি ঘটবে(!)
ছবিঃ সংগৃহীত।
লেখকঃ আজহারুল ইসলাম।